প্রায় একমাস আগে, ৫ অগস্ট, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন শেখ হাসিনা। তার আগে গত একমাস ধরে চলেছিল ছাত্র আন্দোলন। যা তিনি কঠোর হাতে দমন করার চেষ্টা করেছিলেন। ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালিয়েছিল পুলিশ-সেনা। এমনকি, হেলিকপ্টার থেকেও গুলি চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ। শুধু ওই একমাসই নয়, তাঁর শাসনকালে বন্দি করে, গুম করে, হত্যা করে – বিভিন্নভাবে বিরোধী কন্ঠস্বর রোধ করেছেন তিনি। কাজেই তিনি ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর, তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ও আপামর জনতার ক্ষোভের প্রকাশ স্বাভাবিক বলেই মনে করেছে মানুষ। কিন্তু, ওই একই সময়ে ভাইরাল হয়েছিল আরও এক ছবি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা তথা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তির মাথায় মারা হচ্ছে হাতুড়ির বাড়ি!
শুধু এক জায়গাতেই নয়, জায়গায় জায়গায় মুজিবের মূর্তির উপর ক্ষোভ উগরে দিয়েছে বাংলাদেশের আন্দোলনকারীরা। ভাঙা হয়েছে ম্যুরাল, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর বসতবড়ি তথা জাদুঘরে। সকল আন্দোলনকারীর এতে সমর্থন ছিল তা নয়। তবে, দেশের যেখানে যেখানে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ছিল, সবই আজ ধ্বংস। এমনকি, বিদেশের মাটিকে থাকা বিভিন্ন বাংলাদেশি হাইকমিশন থেকেও খুলে ফেলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ছবি। হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভটা মেনে নিতে পারলেও, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ অনেকেই মানতে পারেননি। পু্রশ্ন উঠেছে, মুজিব কী দোষ করলেন? কেন ভাঙা হচ্ছে তাঁর মূর্তি?
আসলে বাংলাদেশে হাসিনা বিরোধী একটা বড় অংশ মনে করে, হাসিনা যে স্বৈরাচার চালিয়েছেন, তার বীজ বপন করে গিয়েছিলেন শেখ মুজিবই। জীবিত থাকলে, হাসিনার মতো স্বৈরাচারি শাসন চালাতেন তাঁরা বাবাও। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পর, সেই পথেই হাঁটছিলেন তিনি। আর তারই ফসল ছিল ‘বাকশাল’। অনেকেই মনে করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের এই বিতর্কিত পদক্ষেপের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল বাকশালের বীজ। যাকে জল-সার দিয়ে বটবৃক্ষে পরিণত করেছিলেন তাঁর কন্যা। কী এই বাকশাল? কেন বাকশাল নিয়ে বিতর্ক? সত্যিই কি স্বৈরাচারী শাসন চালাতে চেয়েছিলেন মুজিব?
বাকশাল কথাটি শুনলে মনে হতে পারে, বাঘ-সিংহ না জানি কি! আসলে এটা হল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামি লিগ’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুজিব। কিন্তু, কয়েক বছরের মধ্য়েই তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, দেশের সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে, বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তিনি। এমনকি, নিজের আওয়ামি লিগ দলও উঠিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি নতুন দল, ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামি লিগ’। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, দেশে আর কোনও দল করা যাবে না। ওই বছরের ২৬ মার্চ, ঢাকায় এক জনসভায় মুজিব বলেছিলেন, ঘুনে ধরা সমাজ পাল্টানোর লক্ষ্যেই বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে, কোন প্রেক্ষাপটে তিনি এই একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেন, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে।
বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, প্রথমে বহুদলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন মুজিব। কিন্তু, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন মুজিব। সেই পরিস্থিতিই তাঁকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পথে নিয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে কলকারখানা সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রাস্তাঘাট বা পরিকাঠামো বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোষাগার ছিল শূণ্য। সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল দেশ জুড়ে চূড়ান্ত নৈরাজ্য।
এই নৈরাজ্য তৈরির দায় কার, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দুর্নীতিই শেখ মুজিবের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রশাসন থেকে শুরু করে আওয়ামি লিগ দলের মধ্যেও একটা ভাঙন তৈরি হয়েছিল। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে আওয়ামি লিগ ভেঙে তৈরি হয়েছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নামের একটি দল, যারা বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি করেছিল। এই অবস্থায় সহমতের দলগুলিকে পাশে চেয়েছিলেন শেখ মুজিব। সেজন্যই তিনি বাকশাল করেছিলেন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অতিবামপন্থীদের সশস্ত্র তৎপরতাও চলছিল। আওয়ামি লিগের নেতারা নৈরাজ্যের জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং অতিবাম দলগুলিকেই দায়ী করে। তাদের জন্যই স্বাধীনতা লাভের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী গণতন্ত্রের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়নি বলে দাবি করেন তাঁরা। সেই কারণে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক – সব দিক থেকেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। এই অবস্থায় সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে দেশ শাসন করা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই জন্যই তিনি বাকশালের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের মতে, বাকশাল ছিল দ্বিতীয় বিপ্লব। মুজিবও এই দাবি করতেন। কিন্তু, সত্যিই কি বাকশাল বিপ্লব ছিল? নাকি ছিল স্বৈরতন্ত্র?
বাকশালে বেশ কিছু বৈপ্লবিক ধারণার প্রবর্তন করা হয়েছিল। এর দুটি প্রধান কর্মসূচি ছিল। প্রথমটি ছিল অনেকটাই আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে হওয়া ভূমি সংস্কারের মতো। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছিলেন মুজিব। সেই সমবায়ে জমির মালিকরা তাদের জমি দেবেন। রাষ্ট্রের অর্থে সেই জমিতে চাষ করবে ভূমিহীন কৃষক। সেই জমিতে যে ফসল হবে, তা জমির মালিক, কৃষক এবং রাষ্টের মধ্যে তিন ভাগে ভাগ করা হবে। আর শিল্পের ক্ষেত্রে, কারখানা পরিচালন কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখার কথা বলা হয়েছিল। সেই প্রতিনিধিই শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করবেন। এছাড়া, জেলায় জেলায় গভর্নরের নেতৃত্বে কাউন্সিল গঠন করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে চেয়েছিলেন মুজিব। সব মিলিয়ে আওয়ামি লিগ নেতাদের দাবি, তিনি জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তিনি। মুজিব নিজেও বলতেন, একদলীয় শাসনটা সাময়িক, সবকিছু ঠিক হলেই ফের গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসবেন তিনি।
তবে, এর বিরোধীরা বলেন বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেয়েছিল মুজিবের স্বৈরাচারী রূপ। আওয়ামি লিগ-সহ সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করায় বিরোধিতার কোনও জায়গা ছিল না। রাষ্ট্র, সরকার এবং দল মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। মানে, দলের বিরোধিতা করলে বলা হত রাষ্ট্রের বিরোধিতা। সরকারের বিরোধিতা করলে বলা হত রাষ্ট্রের বিরোধিতা। এই বিরোধিতা করায় হাজার হাজার লোককে জেলে ভরা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যম ছিল সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। নিয়ন্ত্রণাধীন মাত্র চারটি সংবাদপত্র বাদ দিয়ে, সব পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিচারক, আমলা সবাই ছিল একই দলের সদস্য। সবাইকেই বাকশালে যোগ দিতে বাধ্য করা হত। যে কৃষক-শ্রমিকের নামে এই দল গঠন করা হয়েছিল, তার সঙ্গে কৃষক-শ্রমিকদেরই কোনও সম্পর্ক ছিল না বলে দাবি করেন অনেকে। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যেই বাকশাল গঠন করেছিলেন মুজিব, দাবি সমালোচকদের।
আওয়ামি লিগ বিরোধীদের অনেকেই মনে করেন, বাকশাল পদক্ষেপ সম্পূর্ণ ভুল ছিল। এই ধরণের একদলীয় শাসন বাংলাদেশ কেন, উপমহাদেশের মানুষই দেখেনি। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করাকে তাই সাধারণ মানুষ মনে নিতে পারেনি। এছাড়া, শেখ মুজিব যেভাবে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তার জন্য প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক শক্তি ছিল না তাঁর হাতে। তবে, আওয়ামি লিগের নেতারা সবসময় বাকশালকে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির জন্য আদর্শ ভিত্তিক কর্মসূচি বলে এসেছে। তাদের দাবি, বাকশাল পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে। কিন্তু, তার আগেই ওি বছরের ১৫ অগস্ট হত্যা করা হয় মুজিবকে। তাই ভালমন্দ বিচার করার মতো যথেষ্ট সময়ই পায়নি বাকশাল। এই ব্যবস্থা টিকে ছিল মাত্র ২৩২ দিন।