ঢাকা: ৫ অগস্ট আচমকাই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন শেখ হাসিনা। আর তারপর থেকেই বাংলাদেশে শুরু হয়েছে চূড়ান্ত নৈরাজ্য। যার চরম মাসুল দিতে হয়েছে হিন্দু-সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দাবি, ৫ ও ৬ অগস্ট হিন্দুদের বহু বাড়িতে হামলা হয়েছে। হিন্দুদের দোকানপাট ভাংচুর করা হয়েছে। হামলা হয়েছে বেশ কয়েকটি মন্দিরে। ইসকনের মন্দিরে হামলা হয়েছে। এই নিয়ে ঢাকায় বিক্ষোভও দেখিয়েছেন হিন্দুরা। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, বারবার কেন তাদেরকেই হিংসার শিকার হতে হয়? আসলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই, তলে তলে সেই দেশের একাংশের মানুষ, দেশটিকে মুসলিম দেশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল।
হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশি হিন্দুদের অভিযোগের অন্ত নেই। তবু অধিকাংশ বাংলাদেশি হিন্দুই সমর্থন করেন হাসিনার আওয়ামি লিগকে। এর অন্যতম কারণ, ২০১১ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক বিষয় হিসেবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার পাশাপাশি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় পুনরুদ্ধার করেছিলেন। বাংলাদেশকে ফের ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তাই, হাসিনার নেতৃত্বে একটা নিরাপত্তার বোধ ছিল হিন্দু ও অন্যান্য বাংলাদেশি সংখ্য়ালঘুদের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর বাবা, ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান। তবে মাঝে একটা বড় সময়, পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশও ছিল এক মুসলিম দেশ। বাংলাদেশকে মুসলিম দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন জেনারেল হুসেইন মহম্মদ এরশাদ। কে তিনি?
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান। ১৯৮২ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র ১১ বছর পরই, এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেছিলেন তিনি। সেই থেকে গত শতাব্দীর নয়ের দশকের গোড়া পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষমতা ছিল তাঁরই হাতে। শেখ হাসিনার আগে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এরশাদই পরিচিত ছিলেন “স্বৈরাচারি” হিসেবে। মজার বিষয় হল, বাংলাদেশের এই স্বৈরশাসকের জন্ম হয়েছিল ভারতেই এবং আরও ভনির্দিষ্ট করে বললে এই বাংলায়। তাঁর বাবা, মকবুল হুসেইন ছিলেন আইনজ্ঞ। কোচবিহারের মহারাজার মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, কোচবিহারেই জন্ম হয়েছিল এরশাদের। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের সময়, এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে বাবা মকবুল হোসেন এবং মা মজিদা খাতুন বর্তমান বাংলাদেশে বা সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন।
রংপুরের কারমাইকেল কলেজে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন এরশাদ। ১৯৫০ সালে তিনি স্নাতক হন। এরপর, সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে তিনি পাকিস্তানের কোয়েটার কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ এবং কোহাটের অফিসার ট্রেনিং স্কুলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পাশ করার পর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁকে। তবে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়াননি তিনি. আবার পাক বাহিনীর হয়ে লড়াইও করেননি। যুদ্ধ শুরু সময় তিনি ছুটিতে ছিলেন। এরপর তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিরা যখন ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে এরশাদও বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
১৯৭৫-এ বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান, জেনারেল জিয়াউর রহমান, এরশাদকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মনোনীত করেছিলেন। বস্তুত, অল্প সময়ের মধ্যেই জিয়াউর রহমানের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন এরশাদ। বাংলা ভাষায় তিনি খুব ভাল বক্তৃতা লিখতে পারতেন। তাই দ্রুত তিনি জিয়াউর রহমানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও সামরিক উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন। ১৯৭৮-এ তাঁকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং বাংলাদেশের সেনাপ্রধান পদে উন্নীত করেন জিয়া। জিয়ার হত্যার পর, ১৮৮২ সালে নির্বাচিত বাংলাদেশ সরকারকে সরিয়ে তিনি দেশের ক্ষমতা দখল করেছিলেন। সামরিক শাসন জারি করে দেশ শাসন করা শুরু করেছিলেন।
এভাবে চার বছর চলেছিল। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে গণতান্ত্র ফেরানোর ঘোষণা করেন এরশাদ। সাধারণ নির্বাচনও করেন। জাতীয় পার্টি নামে নিজের এক দল গঠন করে সেই দলের প্রার্থী হিসাবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। জিতে, পরের পাঁচ বছরের জন্য তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। অনেকেই মনে করেন, এরশাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত জেনারেল জিয়াউর রহমানের মতামত অনুসারেই। সাতের দশকে বাংলাদেশ সংবিধানের যে ইসলামিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন জেলারেল জিয়া, তাকেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এরশাদ। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে, দেশের সংবিধান বদলে বাংলাদেশকে মুসলিম দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তার আগে পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক নীতি ছিল।
১৯৯০ সালে গণবিক্ষোভের চাপ এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর সমর্থনের অভাবে তিনি অস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেকটা এখনকার শেখ হাসিনার মতোই। ক্ষমতা হারানোর পর এরশাদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনি জেল থেকেই ভোটে লড়েছিলেন। রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তবে, বিএনপি তাঁকে কখনই মুক্তি দেয়নি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও তিনি পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছয় বছর কারাবন্দি থাকার পর, প্রথম আওয়ামি লিগ সরকারের সময় ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি। তাঁর জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে ভেঙে গিয়েছিল। মূল ধারার দলটির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি, বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় পার্টি। ২০১৯-এর জুলাইয়ে তাঁর মত্যু হয়।
শেখ হাসিনার বিদায়ের পর, এখন আবার জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি এবং জামাতে ইসলামির মতো চরমপন্থী দলগুলির বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারে রাজনৈতিক দল হিসেবে মূলত তাদেরই প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সেই সঙ্গে মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসও। এই পরিস্থিতিতে কি জন্ম হবে আরও এক এরশাদের? বাংলাদেশ আবার ধর্মনিরপেক্ষ থেকে হয়ে যাবে মুসলিম দেশ?
আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)