নয়া দিল্লি: রাত পোহালেই সবার নজর থাকবে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের (Uttar Pradesh Assembly Elections 2022) দিকে। জাতীয় রাজনীতিতে একটি অতি প্রচলিত কথা রয়েছে, দিল্লির রাস্তা যায় উত্তর প্রদেশ হয়ে। বৃহস্পতিবার সেই যোগী রাজ্য়ের প্রথম দফার বিধানসভা নির্বাচন। আর তার আগে বুধবার রাত আটটার সময় সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের সঙ্গে এক খোলামেলা আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (PM Narendra Modi)। উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগের মুহূর্তে প্রায় ৭০ মিনিট দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে একাধিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের প্রসঙ্গও।
উত্তর প্রদেশ, পঞ্জাব এবং গোয়ার নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক দলের মধ্যে জাতিগত বিভাজন দেখা গিয়েছে। সেই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “টিকিট বিলির ক্ষেত্রে জাতিগত একটি বিভাজনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।। কোন সম্প্রদায়ের থেকে কত শতাংশ ভোট পাওয়া যাবে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমাদের এই বিষয়টির পরিবর্তন করা উচিত। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঐক্যের প্রয়োজন।”
রাজ্যসভা বা লোকসভায় কংগ্রেসকে একাধিকবার আক্রমণ শানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এদিকে কংগ্রেসের দাবি, রাহুল গান্ধী যা যা প্রশ্ন করেছেন তার কোনও জবাব দেননি প্রধানমন্ত্রী। উল্টে কংগ্রেসকেই আক্রমণ শানিয়েছেন তিনি। আর এই প্রসঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আক্রমণ করার মতো ভাষা আমি জানিও না, বলিও না। তথ্যভিত্তিকভাবে আমি সংসদে কথা বলি। আমি আক্রমণ করি না, নরমভাবে বলি। আমি প্রত্যেকটি বিষয়ে তথ্যভিত্তিক কথা বলেছি। আর যে শোনেনই না, যিনি সংসদে বসেনই না, তাঁকে আমি কী জবাব দেব?”
কিছুদিন আগেই পঞ্জাবে গিয়ে ফিরোজপুরের কাছে মাঝরাস্তায় আটকে গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী কনভয়। সেই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি ইস্যুতে কোথাও কিছু বলছি না। সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে। এই বিষয়ে আমি যে কোনও বিবৃতি দিই তা তদন্তকে প্রভাবিত করবে। এটি ঠিক নয়।”
উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের প্রথম দফার ঠিক একদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারে বার বার উঠে আসে যোগীরাজ্যের কথা। উত্তর প্রদেশের নাগরিক সুরক্ষার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যখন কেউ উত্তর প্রদেশের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেন, তখন তাঁরা আগের সরকারের মাফিয়া রাজ, গুন্ডা রাজের সময় তাদের কী সমস্যার মধ্যে থাকতে হত, সেই কথা ভাবেন। সেই সময় বাহুবলীরা সরকারের বদান্যতা ও আশ্রয় পেত। মহিলারা বাইরে বেরোতে পারতেন না।”
উত্তর প্রদেশের সেকাল আর একালের তুলনা করে নমো বলেন, “আজকাল মহিলারা বলেন যে তাঁরা সন্ধ্যা নামার পরেও বাইরে বেরোতে পারেন। নাগরিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই বিশ্বাসের কোনও বিকল্প হয় না। উত্তর প্রদেশে একটা সময় ছিল যখন গুন্ডারা যা খুশি করতে পারত, আজ তারা আত্মসমর্পণ করছে। যোগী আদিত্যনাথ নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং এর সঙ্গে কোনও আপস করেননি।”
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “যদি যোগীজির কঠোর পরিশ্রম এবং সফল পরিকল্পনাগুলির দিকে তাকানো যায়, তাহলে আমি এটা বলতে পারি, তাঁর স্কিমগুলি এতই দুর্দান্ত, যে তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন।”
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আরও বলেন, “সরকারের ব্যবসা করার কোনও ইচ্ছা নেই। এর কাজ হল দরিদ্রদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার কথা ভাবা, তাঁদের জন্য ঘর ও শৌচাগার তৈরি করা, তাঁদের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, তাদের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করা, রাস্তা তৈরি করা, ছোট কৃষকদের কথা ভাবা। এগুলিই আমাদের কাছে অগ্রগণ্য।” প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “এটাকে কেউ যদি আপনি সমাজতন্ত্র বলে, আমি তা মেনে নিচ্ছি। আর মেকি সমাজতন্ত্র হল পরিবারতন্ত্র। আপনি কি লোহিয়াজি, জর্জ ফার্নান্ডেস, নীতীশ কুমারদের পরিবারকে দেখছেন? তাঁরাই হলেন আসল সমাজতন্ত্রী। আমি চিঠি পেয়েছি যে সমাজবাদী পার্টির ঘনিষ্ঠ ৪৫ জন কিছু না কিছু (সরকারি) পদে আছেন। এই পরিবারতন্ত্র গণতন্ত্রের জন্য ভয়ঙ্কর।”
কৃষকদের ইস্যুতেই বুধবার নিজের ভাবনার কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বললেন, “আমরা কৃষকদের মন জয় করতে এসেছি, তাই করেছি। আমি ছোট কৃষকদের কষ্টের কথা বুঝি। কৃষকদের সুবিধার জন্যই কৃষি আইন নিয়ে আসা হয়েছিল, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে তা ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।”
উল্লেখ্য, সম্প্রতি পঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ কে হবেন তা নিয়ে তুমুল জলঘোলা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি উত্তর প্রদেশ, পঞ্জাব এবং গোয়ার নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক দলের মধ্যে জাতিগত বিভাজন দেখা গিয়েছে। সেই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “টিকিট বিলির ক্ষেত্রে জাতিগত একটি বিভাজনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।। কোন সম্প্রদায়ের থেকে কত শতাংশ ভোট পাওয়া যাবে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমাদের এই বিষয়টির পরিবর্তন করা উচিত। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঐক্যের প্রয়োজন।”
ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “একটি পরিবার যখন একটি গোটা প্রজন্ম ধরে একটি দল পরিচালনা করে, সেখানে কেবল রাজত্ব থাকে, গতি থাকে না। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে শুরু করে, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, উত্তর প্রদেশ এবং তামিল নাড়ুতে আপনি একই প্রবণতা দেখতে পাবেন। এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু।”
উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে একটি প্রচলিত কথা রয়েছে, এখানকার ভোটাররা নাকি একটি দলতে পর পর দুই বার জেতান না। সেই প্রসঙ্গে এএনআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “আমরা ২০১৪ সালে জিতেছিলাম। তারপরে ২০১৭ সালে এবং ২০১৯ সালে আমাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনা হয়েছিল। তাই পুরানো সেই তত্ত্ব (একটি দল উত্তর প্রদেশে টানা নির্বাচনে জয়ের পুনরাবৃত্তি করতে পারে না) উত্তর প্রদেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা আমাদের মেনে নিয়েছেন।২০১৪ সালে, ২০১৭ সালে এবং ২০১৯ সালে। তাঁরা আমাদের কাজ দেখে ২০২২ সালেও আমাদেরই বেছে নেবেন।”
বিরোধীদের দিক থেকে মাঝেমধ্যেই অভিযোগ করতে শোনা যায়, বিজেপি আঞ্চলিক দাবি দাওয়াকে গুরুত্ব দেয় না। বুধবার সেই ভুল ভাবনাও ভাঙলেন নমো। বললেন, “আমরা বিশ্বাস করি- দেশের অগ্রগতির জন্য আমাদের আঞ্চলিক দাবি দাওয়াগুলির সমাধান করতে হবে। আমিও একজন মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম এবং রাজ্যের চাহিদা বুঝতে পেরেছিলাম। আগে, (বিদেশ থেকে) ভারতে আসা নেতারা শুধুমাত্র দিল্লিতেই যেতেন, কিন্তু আমি তাদের বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ে গিয়েছি।”
সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “আমরা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে বিশ্বাস করি। কিন্তু কিছু নেতা ‘বিভাজনের’ নীতি নিয়ে চলেন…আমরা দেশের ১০০টিরও বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেলা চিহ্নিত করেছি। আজ, এই জেলাগুলির মধ্যে কয়েকটি অনেক প্যারামিটারে জাতীয় গড়কে অতিক্রম করে গিয়েছে৷ এটাই হল আঞ্চলিক দাবি দাওয়াগুলিকে পূরণের একটি উপায়।”
সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “বিজেপি বার বার হারের মুখ দেখার পর জিততে শুরু করেছে। আমরা যখন কোথাও জিতি, তখন আমরা একেবারে তৃণমূল স্তরের মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করি। তাঁদের মন জয় করতে কোনও খামতি রাখি না। আমরা ক্ষতির মধ্যেও আশার আলো খুঁজি। আমাদের জন্য, নির্বাচনগুলি নিজেদের পালিশ করার জন্য এক খোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো।”
সম্প্রতি সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রসঙ্গে অনেক মন্তব্য করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেই নিয়ে বিরোধীরা পাল্টা তির্যক মন্তব্যও করেছে। সেই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “কারও বাপ-ঠাকুরদার বিরুদ্ধে কথা বলিনি…প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন আমি তাই বলেছি…এটা দেশের জানার অধিকার রয়েছে। তারা বলে আমরা নেহেরুজির কথা উল্লেখ করি না। যদি আমরা করি, তাহলেও অসুবিধা! “
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্যাবিনেটের অন্যতম সদস্য অজয় মিশ্র টেনির পদত্যাগের দাবি তুলছেন বিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিছু মুখ খোলেননি। বুধবার সেই প্রসঙ্গে মোদী বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট যে কমিটি গঠন করতে চেয়েছিল তদন্তের জন্য, তার জন্য রাজ্য সরকার সম্মতি দিয়েছে। রাজ্য সরকার স্বচ্ছভাবে কাজ করছে।”
“যেখানেই বিজেপিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেখানেই আপনি সরকারবিরোধী নয় বরং সরকারের পক্ষেই মত পাবেন। বিজেপি সবসময়ই ‘প্রো-ইনকাম্বেন্সি’ নিয়ে নির্বাচনের ময়দানে নামে।” সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বললনে প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিজেপি সর্বদা মানুষের সেবায় জড়িত। ক্ষমতায় থাকলে আমরা ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ মন্ত্র নিয়ে কাজ করি। আমি সব রাজ্যে বিজেপির এক ঢেউ দেখতে পাচ্ছি। আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হব এবং পাঁচটি রাজ্যের মানুষ আমাদের সুযোগ করে দেবেন তাদের সেবা করার।”
বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে প্রধানমন্ত্রীর কথায় উত্তর প্রদেশের প্রসঙ্গ যে উঠে আসবে, তা অনেকটাই অনুমান করা যাচ্ছিল। উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা আগেও ‘দুই জনের’র খেলা দেখেছি। তাঁদের এমন অহংকার ছিল যে তাঁরা ‘গুজরাটের দুই গাধা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিল। উত্তর প্রদেশের মানুষ তাঁদের উচিত শিক্ষা দিয়েছে। আর একবার তাদের সঙ্গে ‘দুই ছেলে’ আর একজন ‘বুয়াজি’ ছিল। সেই বারও তা তাঁদের জন্য বিশেষ কাজে আসেনি।”