রাজনীতি থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও, দেশের যে সব রাজনৈতিক চরিত্র সাধারণের আকর্ষণের কেন্দ্রে থেকেছে তার মধ্যে অন্যতম প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। যে পরিবারের দাপুটে মহিলা রাজনীতিকদের দেখতে অভ্যস্ত দেশের মানুষ, সেই পরিবারের নতুন প্রজন্মের মশাল যে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীই বহন করবেন, এমনটা আশা ছিল অনেকেরই। মনমোহন জমানা শেষে যখন মদীর উত্থান শুরু, কংগ্রেস সমর্থকেরা তখনও আশা করেছিলেন, একজনই পারে খেলা ঘুরিয়ে দিতে। তিনি রাহুলের ছোট বোন। কিন্তু দুই সন্তানের মা হিসেবে সক্রিয় রাজনীতির ময়দান থেকে দূরেই ছিলেন তিনি। ২০১৯- এ তাঁর রাজনৈতিক অভিষেক। আর তার তিন বছর বাদে ১০ মার্চের ফলাফল দেখে অনেকেই আশাহত হয়েছেন। মেরে-কেটে ২ টি আসন আসতে পারে কংগ্রেসের ঝুলিতে। শুধু তাই নয়, প্রশ্ন উঠেছে প্রিয়াঙ্কার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও।
২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনের মাস কয়েক আগেই আসরে নামেন প্রিয়াঙ্কা। অনেকেরই মনে আছে, যোগী রাজ্যের রাজপথে শোভাযাত্রা করে প্রিয়াঙ্কাকে পরিচয় করিয়েছিল কংগ্রেস। দলের কর্মীরা ভেবেছিলেন, নতুন মুখ, নতুন চমক মরা গাঙে বান আনতে পারে। তবে গোটা রাজ্যের নয়, কেবলমাত্র পূর্ব অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কংগ্রেস কর্মীরা অনেকেই নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। নতুন নেত্রী,তাঁর জনপ্রিয়তায় আশা রেখেছিলেন তাঁরা। ক্রমে মোদীকে জবাব দেওয়ার অভ্যাস তৈরি করলেন। সক্রিয় হলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। স্পষ্ট হিন্দিতে তাঁর ভাষণ নজরও কাড়ল। কংগ্রেসকে অক্সিজেন জোগানোই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
সে বারও কোনও মিরাকল দেখেনি উত্তর প্রদেশ। লোকসভা নির্বাচনে খারাপ ফল হয় কংগ্রেসের। এমনকি দীর্ঘদিন গান্ধী পরিবারের হাতে থাকা আমেঠিতেও হেরে গেলেন খোদ রাহুল গান্ধী। যদিও তার জন্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে দুষল না কংগ্রেস। প্রথমত মাত্র তিন মাস আগে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, দ্বিতীয়ত, ১৯৮৯- এর পর যে রাজ্যে কংগ্রেস আর ক্ষমতায় আসেনি, সেখানে জয়ের আশাও ছিল না খুব বেশি।
গেরুয়া দূর্গ ভাঙা যে খুব একটা সহজ নয়, তা বুঝে গিয়েছিল কংগ্রেস। তবে, বিধানসভা নির্বাচনের আগে গোটা রাজ্যের দায়িত্ব পড়ল প্রিয়াঙ্কার কাঁধে। অন্তত ৩০০ কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে প্রচার সারলেন তিনি। বিশ্লেষকদের মতে, রাম-রাজ্যে ধর্মের তাস খেলে প্রায় সব রাজনৈতিক দল। সেখানে অন্য পন্থা নিলেন প্রিয়াঙ্কা। যোগী-সাম্রাজ্য ভাঙতে হাতিয়ার করলেন মেয়েদের। তৈরি করলেন নতুন স্লোগান লড়কি হুঁ, লড় সকতি হুঁ। মহিলা ভোটারদের সমর্থন জোগাড় করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু কোনও লাভ হল না।
শুধু স্লোগানই নয় হাথরাসে গণধর্ষণ-কাণ্ডে নির্যাতিতার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। করোনা পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার জন্য বাসের ব্যবস্থাও করে দিলেন তিনি। লখিমপুর খেরি যাওয়ার পথে যখন তাঁকে আটক করল পুলিশ, তখন প্রিয়াঙ্কার মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর ছায়াও দেখেছিলেন অনেকে। কিন্তু, তাঁর হাত ধরে কংগ্রেস যে ঘুরে-দাঁড়াতে পারল না, তা কার্যত পরিষ্কার হয়ে গেল আরও একবার।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস শিবিরেও প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন প্রিয়াঙ্কা উদ্ধত, কর্মীদের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি। কেউ বলেছেন, তিন বছরেও দলকে সংগঠিত করতে পারেননি তিনি। এ ছাড়া প্রিয়াঙ্কা গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টাকে অনেক বর্ষীয়ান নেতাই ভালো চোখে দেখেননি, প্রশ্ন উঠেছে পরিবারবাদের।
উত্তর প্রদেশে বিজেপির ব্যাপক সাফল্য একদিকে যেমন প্রিয়াঙ্কার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে দিল্লির রাজনীতিতে নিয়ে যাওয়া হতে পারে প্রিয়াঙ্কাকে। তবে, ইন্দিরার প্রতিফলন যাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁরা যে আশাহত হলেন, তেমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল।