বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো! এই বুঝি কী হয় কী হয়…মামলার ফাঁসে থমকে বিপজ্জনক বাড়ির সংস্কার

TV9 Bangla Digital | Edited By: tista roychowdhury

Dec 18, 2021 | 1:11 AM

Kolkata: কলকাতা শহরে যে পরিমাণ পুরনো বাড়ি রয়েছে, সেই বাড়িগুলির মালিকরা যদি সংস্কার করতে শুরু করেন তাহলে তাঁদের নিজস্ব গ্যাঁট থেকেই লক্ষ লক্ষ টাকা বেরিয়ে যাবে।

বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো! এই বুঝি কী হয় কী হয়...মামলার ফাঁসে থমকে বিপজ্জনক বাড়ির সংস্কার
হাড়পাঁজর বের করা চেহারা নিয়ে পুরবাসীকে সাবধান করছে সে। অলংকরণ: অভীক দেবনাথ।

Follow Us

সা য় ন্ত  ভ ট্টা  চা  র্য

কলকাতা: কথায়  বলে ‘মরা হাতি লাখ টাকা’। কিন্তু হাতির বদলে যদি আস্ত বাড়ি এসে জোটে তবে তা আশঙ্কারই বটে। অন্তত শহরের জরাজীর্ণ পুরসভার নোটিসওয়ালা  বাড়িগুলোর দশা এমনই।  এই দেওয়ালে আজ ফাটল ধরেছে, তো ছাদের ঘরে কাল অশ্বত্থের চারা! বাড়ির মালিক হোন বা ভাড়াটে, বুকে বল নিয়ে কোনওরকমে দিন গুজরান। কারণ, রেন্ট কন্ট্রোলের মামলায় ফেঁসে গিয়েছে বাড়ির সংস্কার।

তিলোত্তমা শহরে এমনই নানা ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ দেখা যায় উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্তে। প্লাস্টার ফেটে বুকের লোহার পাঁজর বের করা সেইসব বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফুটপাত বদল করেন কোনও সাবধানী পথচারী। তবু কেন এই সব বাড়ি ভাঙা হয় না? নানা সময়ে এর জন্য আর্থ-সামাজিক যুক্তি দেন পুর-কর্তারা। দুয়ারে আরেকটা পুরভোট (Kolkata Municipality Election 2021)। বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে এই বিপজ্জনক বাড়িগুলো নিয়েও প্রশ্ন কলকাতার নাগরিকদের মনে। কী বলছে পুরসভা?

বিপদের নাম বাড়ি! 

শহরে বাড়ছে বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে পড়ার সংখ্যা। একইসঙ্গে বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটেদের মনে আশঙ্কার সঙ্গে বেড়েই চলেছে একরাশ হতাশা। কলকাতা শহরে যে পরিমাণ পুরনো বাড়ি রয়েছে, সেই বাড়িগুলির মালিকরা যদি সংস্কার করতে শুরু করেন তাহলে তাঁদের নিজস্ব গ্যাঁট থেকেই লক্ষ লক্ষ টাকা বেরিয়ে যাবে। কিন্তু সেই টাকার জোগানটা থাকাটাও অত্যন্ত জরুরি। বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটেদের নিত্তনৈমিত্তিক দ্বন্দ্বের থেকেও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ভাড়া। বাড়িওয়ালারা ভারতের কাছ থেকে এতটাই কম টাকা ভাড়া হিসেবে পান বা পর্যাপ্ত ভাড়া পেলেও ওই বাড়ি সংস্কারে এতটা গুরুত্ব কম দেন, যে দুদিকেই সংকট তৈরি হয়।

কী বলছে পুরসভার হিসেব? 

কলকাতা পুরসভার হিসেব বলছে, শহরের বুকে প্রায় ২৫০০ বাড়ি বিপজ্জনক। যার মধ্যে প্রায় ১৫০ বাড়ি অতি বিপজ্জনক। কিন্তু সেই বাড়িগুলোর সংস্কার কোন পথে, জানেন না বাড়িওয়ালা অথবা ভাড়াটেরা। অর্থনৈতিক সংকটে সেই বাড়িগুলোর জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। আর সংস্কার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঝড় বৃষ্টি হলেই সেই নির্মাণ গুলো ভেঙ্গে বিপর্যয় দেখা দেয়। কলকাতা পুরসভা একের পর এক বিপদজনক বাড়িগুলোকে নিয়ে নিয়মকানুন করলেও তা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সেই তৎপরতা দেখা যায়নি। ফলে বিপদ বেড়েছে তিনগুণ আকারে।

বাড়িভাড়া আইন

১৯৯৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইনের ১০ ও ১১ নম্বর ধারায় বাড়িওয়ালা নতুন নির্মাণের জন্য‌ পুরোনো বাড়ি ভেঙে ফেলতে পারেন কিন্তু সেখানে বেশ কিছু শর্ত চাপানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ভাড়াটিয়াকে নতুন নির্মাণের জন্য‌ সাময়িকভাবে উচ্ছেদ করা যেতে পারে তবে নির্মাণ হয়ে গেলে তাঁকে ফের নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গাই ফিরিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ তাঁকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া অবশ্য‌ পুরোনো ভাড়ায় থাকতে পারবেন না। তাঁকে নতুন হারে ভাড়া দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে নতুন ভাড়ার হার স্থির হয় জমির বার্ষিক মূল্য‌ এবং নির্মাণখরচের বার্ষিক মূল্য‌ের যোগফলের বার্ষিক ৬.৭৫ শতাংশ।

অর্থাৎ ধরে নেওয়া যাক কোনো জমির বার্ষিক মূল্য‌ ৫০ হাজার টাকা এবং নির্মাণখরচের বার্ষিক মূল্য‌ ৫০ হাজার টাকা। তাহলে বার্ষিক ভাড়া হবে ১ লক্ষ টাকার ৬.৭৫ শতাংশ বা ৬৭৫০ টাকা। এর ওপর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য‌ ১০ শতাংশ এবং ব্য‌বসায়ী ভাড়াটিয়া হলে ১০০ শতাংশ কমার্শিয়াল সারচার্জ এবং বসবাসের ভাড়াটিয়া হলে ২০ শতাংশ পুরকর (সর্বোচ্চ) ভাড়াটিয়াকে দিতে হবে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে নতুন বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে পুরোনো ভাড়াটিয়ার অনেকটাই ভাড়াবৃদ্ধি হবে।

সংস্কারে অনীহা !

প্রশ্ন উঠেছে, ভাড়া যদি এতটাই বৃদ্ধি পেতে পারে তাহলে পুরোনো বাড়ির বাড়িওয়ালারা বাড়ি সংস্কার করছেন না কেন।
বাড়িওয়ালাদের প্রায় ২৫০ কোটি টাকা এই মুহূর্তে রেন্ট কন্ট্রোলারের দপ্তরে জমা আছে। কলকাতা হাইকোর্টের রেজিষ্ট্রার বিতর্কিত বাড়িভাড়া রেন্ট কন্ট্রোলে জমা দেওয়ার পরিবর্তে বাড়িওয়ালার নামে আলাদা ব্য‌াঙ্ক অ্য‌াকাউন্টে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই নির্দেশ কার্য়কর হয়নি। এদিকে রেন্ট কন্ট্রোলারের কাছে জমা পড়া টাকা বহুদিন যাবৎ ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।

১৯৯৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ বাড়িভাড়া আইনে ভাড়াবৃদ্ধির সব দায়িত্ব কন্ট্রোলারকে প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে বছরের পর বছর মামলার পাহাড় জমে একটি মামলার নিষ্পত্তি হতে ৮-১০ বছর লেগে যায়। যে কারণে ভাড়াবৃদ্ধির বিষয়টি বিশ বাঁও জলে তলিয়ে যায়। বাড়িভাড়া আইনের ১৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল প্রতি চার বছর অন্তর ভাড়াবৃদ্ধির হার পুনর্বিবেচনা করা হবে। আইন চালু হওয়ার সময় অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকে আজও পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধির হার পুনর্বিবেচনা করা হয়নি। ফলে ভাড়ার হার বৃদ্ধির কোনো সুযোগ পুরোনো বাড়ির বাড়িওয়ালাদের নেই।

পুরকরের বৃদ্ধি

পুরকরের বাড়বাড়ন্তও বাড়িওয়ালাদের মানসিক বীতরাগের কারণ। কলকাতা পুরসভা ভাড়ার ৪০ শতাংশ হারে পুরকর আদায় করে থাকে। এর মধ্য‌ে ভাড়াটিয়ার প্রদত্ত ২০ শতাংশ কর ও কমার্শিয়াল সারচার্জও রয়েছে। একে ভাড়া কম, তার ওপর করের অর্থও যদি বাড়িওয়ালাকে দিতে হয় তাহলে তাঁর পক্ষে সম্পত্তি দেখভাল করাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

পুর আধিকারিকদের অনেকেই জানাচ্ছেন, বিপজ্জনক জেনেও বাড়িগুলিতে লোকজন বসবাস করায় অনেক সময়ই তা ভাঙার কাজ সুষ্ঠু ভাবে করা যায় না। কারণ, নোটিস দেওয়ার পরেও অনেকেই সেখান থেকে সরতে চান না। ফলে ভাঙতে গিয়ে অনেক জায়গায় পুরকর্মীদেরই প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। অথচ বিপজ্জনক বাড়ি সংস্কার করা হবে ইতিমধ্যেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পুর কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনে ওই বাড়ির বাসিন্দাদের থাকার জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থাও করে দেবে পুরসভা।

চিরকালীন দ্বন্দ্ব…

পুরকর্মীদের কাজে বাধাদানের একটি বড় কারণ মালিক-ভাড়াটের গোলমাল। যার ফলে সেই বিপজ্জনক বাড়িগুলির পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। যদিও বিপজ্জনক বাড়ি সংস্কারের পরে বৈধ ভাড়াটেদের জায়গা দিতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে পুর প্রশাসন। বাড়ির মালিকেরা সংস্কারের পরে যদি ভাড়াটেদের জায়গা দিতে না চান, তা কখনওই মানা হবে না বলে মত পুর কর্তৃপক্ষের।

এক পুর আধিকারিকের কথায়, ‘‘বাড়ি ভেঙে যখন সংস্কার করা হবে, তখন সেই নতুন নকশায় বৈধ ভাড়াটেদের নাম, তাঁদের সাক্ষর রাখা থাকবে। যাতে সংস্কারের কাজ শেষ হয়ে গেলে তাঁরা সেখানে তাঁদের জায়গা পান। তবে পুর কর্তৃপক্ষের এই আশ্বাস দেওয়ার পরেও অনেক জায়গাতেই মালিক-ভাড়াটের সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। ফলে আটকে যাচ্ছে পুরনো বাড়ির বিপজ্জনক অংশ।

দুয়ারে ‘দাদারা’!

এই বাড়িগুলি সংস্কারের ক্ষেত্রে আরও একটি সমস্যা যেটা রয়ে যায়, তা অবশ্যই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। কোনও মালিক যদি ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ ‘ট্যাগ’ মেলার পরে বাড়ি সংস্কার করার জন্য উদ্যোগী হন, তাহলে দুয়ারে হাজির হন রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে থাকা “দাদারা”। এই অনিমন্ত্রিত অতিথিদের ‘দাবি-দাওয়া’ মেটাতে গিয়ে রীতিমতো ওষ্ঠাগত হয় বাড়ির মালিক বা ভাড়াটেদের প্রাণ। সেই আবদার মিটিয়ে তাই বাড়ি সংস্কার করতে অনেকেই পিছিয়ে আসেন। তাই ভাঙা বাড়ি পড়ে থাকে ভাঙা দশায়।

কলকাতা পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, বিপজ্জনক বাড়ি সংস্কারের জন্য একাধিক পুর আইন রয়েছে। এমনকী বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে ফেলে নতুন বাড়ি তৈরীর সময় ইউনিট এরিয়া অ্যাসেসমেন্ট সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও ভাড়াটে এবং মালিকের মানসিকতা এবং কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের কর্তাদের একাংশের সক্রিয়তার অভাবে শহরের বিপজ্জনক বাড়ির চরিত্র বদল হয় না।

 

Next Article