কাঞ্চনা মৈত্র (kanchana moitra)। হ্যাঁ, এই নামে দর্শক তাঁকে চেনেন নিশ্চয়ই। দীর্ঘ কেরিয়ারে সেই পরিচিতিই তিনি তৈরি করেছেন। কিন্তু জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘যমুনা ঢাকি’র ‘রাগিনি’ অর্থাৎ যমুনার পিসি-শাশুড়ি তিনি। অথবা ‘সাঁঝের বাতি’ ধারাবাহিকের ‘ঝুম্পা’ অর্থাৎ চারুর সৎ মা-রূপে কাঞ্চনা পৌঁছে গিয়েছেন আপনার ড্রইংরুমে। তাঁর ভিলেনের অভিনয়ে মুগ্ধ দর্শক। কিন্তু শুধু আপনার ড্রইংরুমেই নয়। নিজের বাড়িতেও নাকি তিনি ভিলেন! আড্ডায় শেয়ার করলেন সে সব কথাই।
আপনার ২০ বছরের কেরিয়ার। অধিকাংশই কি নেগেটিভ চরিত্র?
টেলিভিশনের কথা যদি বলেন, তাহলে ৭৫ শতাংশ চরিত্রই নেগেটিভ।
এখনও কি ইন্ডাস্ট্রিতে নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় নিয়ে কোনও ছুৎমার্গ আছে?
দেখুন, ২০২১-এ চলে এসেছি আমরা। ২০২০ নমো-নমো করে পেরিয়ে গিয়েছি। ২০২১-এ গোটা বিশ্বের নিরিখে অভিনেত্রী হিসেবে আমার মনে হয় ভাল অভিনয়ের দাম আছে। আমি দীর্ঘদিন নেগেটিভ চরিত্র করার পরও নির্দ্ধিধায় বলতে পারি, বাংলার মানুষ যেভাবে প্রোটাগনিস্টদের ভালবাসা দেন, তেমনই ভালবাসা আমিও পেয়েছি।
আরও পড়ুন, আমাকে কি খুব বদমাইশদের মতো দেখতে?: রুকমা রায়
দীর্ঘদিন নেগেটিভ চরিত্র করা অর্থাৎ সেই চরিত্র হয়ে ওঠা, তবেই তো পারফরম্যান্স ভাল হয়। এর কোনও প্রভাব ব্যক্তিজীবনে পড়েছে?
না, একদমই ব্যক্তি জীবনে এর প্রভাব পড়ে না। কারণ অভিনয়টা অভিনয়ের মতোই সামলাই। আমি প্রফেশনাল। উদাহরণ দিয়ে বলি, বিকাশ রায় ‘বিয়াল্লিশ’ নাটক যখন করছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মারছেন এমন দৃশ্য ছিল। উনি পুলিশের চরিত্র করেছিলেন। দর্শক আসন থেকে জুতো ছুড়ে মারা হয়েছিল তাঁকে। উনি সেই জুতো মাথায় নিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা আমার জীবনের সেরা পুরস্কার।’ ব্যক্তি বিকাশ রায়ের জীবনে তো তার কোনও প্রভাব পড়েনি। অথবা এতদিন ধরে যারা বিখ্যাত নেগেটিভ চরিত্র করছেন, তাদের তো প্রভাব পড়েনি। মানুষ আর অভিনয় দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। অভিনয়টা খুব সৎ ভাবে করি। তার মানে এটা নয়, আমি মানুষটা এরকম। আমি সব সময় দর্শকদের বলি, আমি যেগুলো পর্দায় করি, আপনারা কিন্তু এটা করবেন না (হাসি)।
টেলিভিশনের পর্দায় কাঞ্চনা।
দর্শকদের থেকে সরাসরি কী ধরনের ফিডব্যাক পেয়েছেন?
আমি যখন জেলাতে বা গ্রামে অনুষ্ঠান করতে যাই, আমাকে সব মহিলারা বলেন, ‘আহ! কী করছেন, এবার একটু ছেড়ে দিন।’ অথবা রাগত স্বরে বলেন, ‘এত জ্বালাবেন না মেয়েটাকে…’ এত মিষ্টি করে বলেন, আমি হেসে ফেলি। আবার কোনও বয়স্ক মহিলা গাল টিপে বলেন, ‘তোমার হাসিটা কী সুন্দর, তুমি কী করে এত বদমায়েশি কর!’ এটাও ভালবাসা। একটা বিশেষ ঘটনার কথা মনে পড়ছে…
প্লিজ বলুন…
আমি ঢাকা কালীবাড়িতে খুব যাই। একদিন মন দিয়ে প্রণাম করছিলাম। এক বয়স্ক ভদ্রলোক পিছন থেকে এসে বলেছিলেন, ‘আর কী চাইছেন, মা তো আপনাকে সবই দিয়েছেন। আপনার অভিনয় ক্ষমতাই তো মায়ের আশীর্বাদ। আর কিছু চাওয়ার দরকার নেই। আমরা আপনাকে ভালবাসি।’ এটা এত ইন্সপায়ারিং… এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে উনি কথাটা বলেছিলেন, সে জায়গায় আমরা সকলেই খুব রিক্ত। মন্দির এমন একটা জায়গায়, যেখানে সত্যিকারের মানুষের মতো থাকি। খুব ভাল লেগেছিল।
আরও পড়ুন, মেয়ে বলেছে, মা তুমি কিন্তু ঝগড়া করবে না: অর্পিতা মুখোপাধ্যায়
বাড়িতে প্রিয়জনেরা আপনার পারফরম্যান্স দেখে কী বলেন?
ও বাবা! বাড়ির লোকের কাছে আমি পৃথিবীর সেরা ভিলেন। আমার মায়ের কাছে আর কর্তার কাছে আমি পৃথিবীর সেরা ভিলেন। কারণ আমি আমার জীবনের যত রকম চাহিদা, ‘এটা চাই’, ’ওটা হয়নি কেন’, এগুলো তো বাইরে করতে পারি না। বাড়িতে এসে করি। তাই আমি বাড়িতে পৌঁছলেই ওরা তটস্থ হয়ে থাকে। আমি বাড়ি ফিরলেই বলে, ‘উফ বাবা! কেন তোর শুটিং তাড়াতাড়ি শেষ হল।’ তাই বাড়িতে আমি মাঝেমাঝেই ভিলেন।
আপনি ওদের বিরক্ত করেন বলে, আপনিই ভিলেন, তাই তো?
সত্যিই ওদের আমি এত বিরক্ত করি… এমন ঘটনাও হয়েছে, মা আর আমার কর্তা চুটিয়ে আমার নামেই পিএনপিসি করছিলেন। হঠাৎ আমি ঘরে ঢুকে পড়েছি। তারপর ভুরু নাচিয়ে বলেছি, ‘কী আমার নামেই কথা বলা হচ্ছে তো’, তখন মা ‘মোটেই না’ বলেই মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। আর কর্তা সিরিয়াল দেখতে শুরু করে দিল।
সমস্যা নয়, সমাধান খুঁজতে ভালবাসেন কাঞ্চনা।
বাস্তবে নেগেটিভ ঘটনাকে কীভাবে সামলান?
আমি বিশ্বাস করি, যে মুহূর্তটা খারাপ সেটা সারা জীবন থাকবে না। ভাল মুহূর্তও যেমন সারা জীবন থাকে না, খারাপ মুহূর্তও সারা জীবন থাকতে পারে না। আর এখন যদি খারাপ হয়ে থাকে, নিশ্চিতভাবে সামনে ভাল কিছু অপেক্ষা করছে। মনের মধ্যে পজিটিভ ভাইব বজায় রাখি। এটা একটা অভ্যেস। এটা সকলকে বলি, নিজেকে ছোট-ছোট বিষয়ে ভাল রেখে সব সময় পজিটিভ থাকুন। আর খুব নেগেটিভ মানুষদের সঙ্গে মিশবেন না। সমস্যা সকলের আছে। কিন্তু যাঁরা সব সময় সমস্যা বা হতাশার কথা বলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না। আমার বয়সে এসে আর সমস্যার কথা বলতে ভাল লাগে না। বরং সমাধানের কথা বলতে ভাল লাগে। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীর কঠিনতম সমস্যারও সমাধান রয়েছে।
আরও পড়ুন, শুটিং না থাকলে আমি গদাধরের সঙ্গে ক্রিকেট খেলি: অয়ন্যা
কেরিয়ারের কোনও নেগেটিভ ঘটনার কথা জানতে চাইব, যেটা পজিটিভ ভাবে পেরিয়ে এসেছেন?
খুব জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘জন্মভূমি’র সেকেন্ড পার্ট হয়েছিল। ইয়ং জেনারেশনকে নিয়ে। তখন আমি সবে ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছি। কাজ খুঁজছি। আমাকে সেই ফ্লোরে ডাকা হয়। মেক-আপ করে সকাল থেকে বসেছিলাম। সন্ধেবেলায় ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো হল। যিনি পরিচালক ছিলেন, তাকিয়েও দেখলেন না। আমি আদৌ অভিনয় করতে পারি কি না অথবা আমাকে কেমন দেখতে লাগছে, কিছু্ই দেখলেন না। কোথাও বোধহয় প্রি-অকুপায়েড ছিলেন। তাই বললেন, ‘না, একে দিয়ে চলবে না।’ সারাদিন ওই গেট-আপের মধ্যে বসে থাকার পর শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। আমাকে বলা হল, আপনাকে দিয়ে হবে না। অনেক কাজই আমাদের জীবনে হয় না। কিন্তু ওই ঘটনাটা কনফিডেন্সে ধাক্কা দিয়েছিল। মানসিকভাবে ভীষণ আঘাত পেয়েছিলাম। বাড়ির ছাদে গিয়ে খুব কেঁদেছিলাম। পরে মনে হয়েছিল, ওই কান্নাটা বা ওই কষ্টগুলোও জরুরি। কারণ এগুলোই জেদ বাড়িয়ে দেয়। আমি সেটা ওভারকাম করেছি। কিছু পজিটিভ আউটকামও পেয়ে গিয়েছি।
আরও পড়ুন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ‘ফিরকি’তে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে: আর্যা