Sleep Internship: চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি তো কী! ঘুমিয়ে 1 লাখ জিতলেন কলকাতার আবাদূর, স্লিপ ইন্টার্নশিপে অংশ নিতেই বিয়ে, সন্তানও…
Kolkata Sleep Intern: পার্ক সার্কাসের আবাদূর সিদ্দিকি, শুধু ঘুমিয়ে জিতলেন 1 লাখ টাকা পুরস্কার। 100 দিন ধরে 900 ঘণ্টা ঘুমের ইন্টার্নশিপ শুরু করার সময়ে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আর ইন্টার্নশিপ শেষের মুহূর্তে খবর এল, বাবা হতে চলেছেন তিনি। ঘুম নিয়ে সুহানা সফরের কাহিনিটা আবাদূর ভাগ করে নিলেন টিভি 9 বাংলার সঙ্গে।
সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়
Abadur Siddiqi: ঘুম নিয়ে বাঙালি মোটেই সিরিয়াস নয়। বাড়ির ছেলে বা মেয়ে সূর্যোদয়ের পরে ঘুমনো মানেই জুটবে বকুনি। ক্লাসে গিয়ে ঢুললে স্যারের তীর্যক মন্তব্য। স্যার ঢুললে তাঁকে নিয়ে পড়ুয়াদের হাসিঠাট্টা। ঘুম নিয়ে বাঙালি কেন, ভারতবাসী, এমনকি বিশ্ববাসীরও গদাইলস্করি চাল আজকের নয়—বহু দিনের। বাংলার চালচিত্র সবথেকে বেশি ফুটে উঠেছে তার গানে। ঘুম নিয়ে বাঙালির দূরছাই মনোভাব দশকের পর দশক ধরে বাংলা গানে ধরা দিয়েছে। রবি ঠাকুরের গানে ঘুম এসেছিল দিনের শেষেই (‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’)। শিলাজিৎ মজুমদার তো সোজা বলে দিয়েছিলেন, ‘তোদের ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা।’ চন্দ্রবিন্দুর গানে শোনা গিয়েছিল, ‘ঘুম ঘুম ক্লাসরুম’। তবে এবার আর দিনের শেষে বা বাড়ি গিয়ে ক্লাসরুমের থেকেও বেশি ঘুম নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস হওয়ার সময় এসে গিয়েছে। কারণ, সারা দিনের এই একটা সময়ই আমাদের সঙ্গে কী হচ্ছে, তা জানতে পারি না আমরা। গভীর ঘুম, কম গভীর ঘুম, হাল্কা ঘুম, তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব—ঘুমের এই হরেক কিসিম সম্পর্কে আমাদের এখন যথেষ্ট সচেতনতা দরকার।
এই নন-সিরিয়াসনেসের ফলাফল যে কী হতে পারে, তা হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখিয়েছে দেশেরই এক স্টার্ট-আপ সংস্থা। স্লিপ ইন্টার্নশিপে বহু শিক্ষানবিশকে সুযোগ দিয়েছিল বেঙ্গালুরুর ‘ওয়েকফিট’ নামক সেই স্টার্ট-আপ। 5.5 লাখ প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিল ওয়েকফিটের স্লিপ চ্যাম্পিয়নশিপে। স্লিপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন শ্রীরামপুরের ত্রিপর্ণা চক্রবর্তী। সেই ত্রিপর্ণাই ভারতের প্রথম স্লিপ চ্যাম্পিয়ন, যাঁকে নিয়ে বিগত কয়েক দিন ধরে তুমুল আলোচনা চলছে। তবে ওই স্লিপ চ্যাম্পিয়নশিপে 5.5 লাখ প্রতিযোগীর মধ্যে যে 4 জন ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিলেন, সেই তালিকায় শ্রীরামপুরের ত্রিপর্ণার সঙ্গে ছিলেন কলকাতার পার্ক সার্কাসের আবাদূর রহমান সিদ্দিকি। বিজয়ী ত্রিপর্ণা যেখানে 5 লাখ টাকা পুরস্কার জিতেছেন, ফাইনালিস্ট আবাদূর সেখানে 1 লাখ টাকা পেয়েছেন একই পরিমাণ ঘুমিয়ে—পরপর 100 দিন, প্রতিদিন 9 ঘণ্টা করে।
গাছ বড় করতে দরকার জল, খাবার আর নির্দিষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ। কিন্তু ইচ্ছের গাছ বড় করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। ঠিক যেমনটা পার্ক সার্কাসের আবাদূরের ক্ষেত্রে। আবাদূর নিজের স্টার্ট-আপ গড়বেন বলে টাকা পয়সা এককাট্টা করছিলেন, দরকার ছিল আরও কিছু টাকার। ঠিক করেছিলেন, কয়েকদিন চাকরি করে বাকি টাকাটা জোগাড় করে নেবেন। লিঙ্কডইন খুলে সার্চ-ও শুরু করলেন। হঠাৎই তাঁর নজরে পড়ে স্লিপ ইন্টার্নশিপ নিয়ে ওয়েকফিটের পোস্টে। শুধু ঘুমোতে হব, সবার সেরা ঘুমালে 5 লাখ টাকা পুরস্কার। পোস্টটি দেখার পরেই খোঁজ শুরু করে দেন আবাদূর।
প্রথমে সিভি পাঠাতে হয়। তাঁর সিভি শর্ট-লিস্টেডও হয়ে যায়। তারপরই ইন্টারভিউর জন্য ডাকে আসে আবাদূরের। ঘুমের ইন্টার্নশিপ, তার আবার ইন্টারভিউ—পুরো ব্যাপারটাই আবাদূরের কাছে ঘুমঘোরের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। ইন্টারভিউয়ে প্রথমেই আবাদূরের কাছে প্রশ্ন আসে, ‘ঘুমের জন্য তুমি কীভাবে সময় বের করবে?’ পরের প্রশ্নটা ছিল, ‘দিনে কতক্ষণ ঘুমাও’? তারপর এল আরও কঠিন এক প্রশ্ন, ‘5 লাখ টাকা দিয়ে তুমি কী করবে?’ এই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে স্লিপ ইন্টার্নশিপে অংশ নেওয়ার কল্কেটাও পেয়ে যান আবাদূর।
2021 সালের জুন মাসে ওয়েকফিটের স্লিপ ইন্টার্নশিপ সিজ়ন 2-এর দ্বিতীয় ব্যাচটি শুরু হয়। প্রথম সিজ়নে যেখানে 1.7 লাখ অংশগ্রহণকারী ছিল, দ্বিতীয় সিজ়নে সেই সংখ্যাটাই এক ধাক্কায় 5.5 লাখ হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন কলকাতার আবাদূর রহমান সিদ্দিকি। ঘুম নিয়ে আবাদূর খুব একটা সিরিয়াস ছিলেন না ঠিকই, তবে ঘুম তাঁর কাছে আরাধনার থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। বাইকার, উদ্যোগপতি, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আবাদূর TV9 বাংলাকে বললেন, “আমি যখন ইন্টারভিউয়ে বসেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম আমাকে হয়তো বলা হবে সারাদিন কঠিন পরিশ্রমের পর সবশেষে নিদ্রা যেতে। আর পরিশ্রম করতে যে কাজগুলো দেওয়া হবে, আমি সেগুলো করতে না পেরে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যাব!”
ঘুমও যে একটা কাজ, তা আমরা জানি, বুঝি, বোঝেন 27 বছরের আবাদূরও। কিন্তু তা নিয়ে যে একটা সিরিয়াস লেভেলে আলোচনা হতে পারে, ইন্টারভিউতে ঘুম নিয়ে এত প্রশ্ন করা হতে পারে, তা আবাদূরের কাছে কিছুটা দিবাস্বপ্নের মতোই ছিল। পার্ক সার্কাসের এই যুবক আর একটি কাজ খুব মনযোগ সহকারে করেন, তা হল বাইকিং। আমরা যেখানে অফিসে চটজলদি পৌঁছে যেতে বাইকের আশ্রয় নিই, ঠিক সেখানে আবাদূর সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাইক চালাতে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর কথায়, “আমি বাইক চালাই। কারণ এটা আমার কাছে একপ্রকার মেডিটেশেন। আমি ঘুম থেকে উঠে বাইক রাইডিংয়ের জন্য নিজেকে রেডি করি। তারপর হাই-স্পিডে বাইক চালাই। একাগ্রতার সঙ্গে বাইক চালাতে গিয়ে একটা আলাদা শক্তি পাই আমি। যেখানে খুশি যেতে পারি, যা খুশি করতে পারি।”
তা সেই ঘুমসফর শুরু হল। টানা 100 দিন, প্রতিদিন 9 ঘণ্টা বা তার কিছুটা কম করে ঘুমনোর সফর। 2021 সালে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ যখন ঊর্ধ্বগগনে, সেই জুন মাসেই ঘুমের ইন্টার্নশিপ শুরু হয় আবাদূরের। রোজ রাত 1 টায় ঘুমাতে যেতেন আবাদূর। ওয়েকফিটের তরফে তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল একটি ম্যাট্রেস, আর একটি ফিটবিট (স্মার্টওয়াচ)। সেই স্মার্টওয়াচেই ছিল প্রাণভোমরা, থুড়ি ট্র্যাকার, যা আবাদূরের ঘুম পরীক্ষা করে রিমোট উপায়ে বেঙ্গালুরুর সংস্থার কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিত। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। আবাদূর কেমন ঘুমোতেন, তার রিপোর্ট বেঙ্গালুরুতে পৌঁছে যেত ওই স্মার্টওয়াচের মাধ্যমে।
এভাবেই কেটে গেল আবাদূরের স্লিপ ইনটার্নশিপের 100 দিনের সুহানা সফর। 5.5 লাখ প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথমে 15 জনকে শর্টলিস্ট করা হয়। সেখান থেকে ফাইনালে পৌঁছে যান চারজন। সেই চারজন ফাইনালিস্টের মধ্যে বাংলার দুজন, বাকিরা দেশের অন্য প্রান্তের। শ্রীরামপুরের ত্রিপর্ণা চক্রবর্তী, পার্ক সার্কাসের আবাদূর রহমান সিদ্দিকি,বিলাসপুরের কুশাগ্রা শর্মা এবং দেরাদুনের যোগেশ ভাট—এই চারজন ওয়েকফিট স্লিপ ইন্টার্নশিপের ফাইনালে উঠেছিলেন। 24 অগস্ট এই ইন্টার্নশিপের ফলাফল ঘোষিত হয়। চ্যাম্পিয়ন হন ত্রিপর্ণা, তাঁর স্লিপ এফিসিয়েন্সি স্কোর 95 শতাংশ। সামান্যর জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি আবাদূর, তাঁর স্লিপ এফিসিয়েন্সি স্কোর ছিল 93 শতাংশ।
সামান্যর জন্য যে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি, তা নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই তাঁর। ফাইনালিস্ট হওয়ার জন্য 1 লাখ টাকাও পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু টাকা বা চ্যাম্পিয়ন হতে না পারা, এগুলির থেকে আবাদূরের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বের ছিল আলাদা একটা অভিজ্ঞতা: ঘুমের প্রতি কীভাবে ডেডিকেটেড হওয়া যায় সেই বিষয়টা অনুধাবন করা। TV9 বাংলাকে বললেন, “স্লিপ ইন্টার্নশিপের এই জার্নিটা আমার কাছে একটা রোলার কোস্টার রাইডের মতো ছিল। ইন্টার্নশিপে যোগ দেওয়ার ঠিক 4 সপ্তাহের মধ্যে আমার বিয়ে হয়। সেই কারণে আমার চারপাশে নিশ্চিন্তে ঘুমের জন্য একটা পরিবেশও তৈরি হয়ে যায়। আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই।”
কিন্তু সব যখন ঠিকই ছিল, তখন স্কোর কমে গেল কীভাবে? আবাদূরের উত্তর, “ইন্টার্নশিপ চলাকালীন একদিন আমি ট্র্যাভেল করছিলাম। সেই দিন আমার ঘুমের গভীরতাও অনেকটা কম ছিল, কমে গিয়েছিল ডিউরেশনও।” সেই যে একবার স্কোর নেমে গেল, তারপর অনেকটা মেক-আপের চেষ্টা করেও আর স্লিপ ‘এফিসিয়েন্সি স্কোর’ বাড়াতে পারেননি আবাদূর।
এই স্লিপ ইন্টার্নশিপ আবাদূরকে অনেক ফোকাসড করে দিয়েছে সবদিক থেকে। তাঁর কথায়, “আমার ঘুম আগের তুলনায় এখন এতটাই ভাল হয়ে গিয়েছে যে, কাজের সময় আমি আউট অফ দ্য বক্স কিছু ভাবতে পারি। আমি কেন, প্রতিটা মানুষের জন্যই তা সত্যি। জীবনে ভাল কিছু করতে, অর্জন করতে পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। 100 দিনে স্লিপ ইন্টার্নশিপ বিষয়টা আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।”
100 দিনের স্লিপ ইন্টার্নশিপ যে আবাদূরের বিনিদ্র রাত নিদ্রামুখর করেছে, ঘুমিয়ে 1 লাখ টাকা এনে দিয়েছে, জীবনটাকে অন্য ভাবে বাঁচার একবগ্গা মনোভাবটাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে বা স্টার্ট-আপ স্টার্ট করার স্বপ্টা সফল করেছে, তা নয়। তার থেকেও অনেক বেশি, এই ইন্টার্নশিপেই ভালবাসার মানুষটার হাতে আংটি পরিয়েছেন তিনি। তার থেকেও বড় কথা, এই ইন্টার্নশিপ চলাকালীন সময়েই আবাদূরের জীবনে এসেছিল আর একটা সুখবর: বাবা হতে চলেছেন তিনি…!
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস