Women’s Day 2022: অভিনন্দন পুলিশ! ১৫ ঘণ্টা পরে গ্রেফতার, ৫০০ টাকায় জামিন, সাত খুন মাফ, কিন্তু শহরে নারীর নিরাপত্তা?

Mar 09, 2022 | 3:46 PM

Swaralipi Chatterjee Actress: নারীর পাশে নারী থাকতে পারে, কিন্তু নারীর সমস্যায় পুলিশ এগিয়ে আসতে পারে না? আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এ শহরে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুললেন অভিনেত্রী ও মহিলা উদ্যোগপতি স্বরলিপি চট্টোপাধ্যায়।

Women’s Day 2022: অভিনন্দন পুলিশ! ১৫ ঘণ্টা পরে গ্রেফতার, ৫০০ টাকায় জামিন, সাত খুন মাফ, কিন্তু শহরে নারীর নিরাপত্তা?

Follow Us

কয়েক দিন আগে দক্ষিণ কলকাতার এক কফি শপের মালকিনকে চাঁদার নামে রীতিমতো হেনস্থা করা হয়। ঘটনাটা জানাজানি হতে পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে, পরক্ষণে ছেড়েও দেয়। বিচারের বাণী তখন থেকে নীরবে নিভৃতে কেঁদেই চলেছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে টিভি ৯ বাংলার জন্য কলম ধরলেন সেই কফি শপের ওনার স্বরলিপি চট্টোপাধ্যায়।

২৮২, যোধপুর পার্ক রোড। আমার স্বপ্নের ঠিকানা। আমার, আপনার, আমাদের সকলের বৈঠকের জায়গা – আবার বৈঠক। সপ্তাহ দুয়েক আগে সেখানে এক জুলুমবাজির কাণ্ড ঘটে। যে এলাকায় আমার ক্যাফেটেরিয়া, সেখানে হবে যোধপুর পার্ক উৎসব। তাই যে এলাকায় ব্যবসা করি, সেই এলাকায় একটা ‘সোনু নিগম নাইটের’ জন্য চাঁদা দেব না? মামদোবাজি নাকি! তা বাবাজিরা এলেন! থ্রেট দিয়ে গেলেন রীতিমতো। ভিডিয়ো করায় আমার ফোনটা কেড়ে নিলেন। ভয় দেখানোর সে কত শত উপায়! চাঁদা দিতেই হবে।

ঘটনাটা অনেকেই জানেন। তা-ও ছোট করে বলি একটু। সূত্রপাত ১২ ফেব্রুয়ারি, শনিবার। ৫ থেকে ৭ জন লোক এসে আমার ম্যানেজারের হাতে একটা ব্রশিওর ধরিয়ে দিয়ে যায়। সে সময় আমি ক্যাফেতে ছিলাম না। তাই ম্যানেজারকেই বলে গিয়েছিল, “আমরা কাউন্সিলারের লোক। মালিককে বলিস, চেকটা রেডি রাখতে। না হলে দেখেছিস তো, আজকে আমরা কী করেছি। ওরকম ভাঙচুর করে চলে যাব।”

আমি পাত্তা দিইনি। পাত্তা দিইনি কারণ এই ধরনের ঘটনাকে আমি কখনও পাত্তা দিই না। তার থেকেও বড় কথা, এতদিন যোধপুর পার্কের মতো একটা জমজমাট জায়গায় ক্যাফে খুলেছি, ব্যবসা করছি, কোনও দিনের জন্য এমনতর জুলুমবাজির কাণ্ড ঘটেনি আমার সঙ্গে। কাট টু বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি। রাত তখন পৌনে ন’টা। আবার বৈঠকে একটা ম্যাজ়েনাইন ফ্লোর রয়েছে, সেখানে আমি বসেছিলাম। ওখানে তিন জন আসে। আমাকে টাকা দিতে বলা হয়। আমি তো টাকা দেব না, পরিষ্কার জানিয়ে দিই। গজগজ করতে করতে ফিরে যায় তারা।

তার পর ঠিক সাড়ে ন’টা নাগাদ ক্যাফের সামনে বাইক নিয়ে প্রায় ১২ থেকে ১৫টা লোক এসে দাঁড়ায়। আমি ভিডিয়ো করায় আমার হাতটা মচকে দিয়ে ফোনটা কেড়ে নেয়। কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। সেই সময় ক্যাফেতে কাস্টমাররা ছিলেন, আমার অনেক বন্ধুবান্ধবও ছিলেন। তাঁরাও সকলে বেরিয়ে এসে আমাকে ঘিরে ধরে। জনৈক ব্যক্তির কাছে সবাই জানতে চায়, “আপনি কী চান, একজন মহিলার সঙ্গে কেন এই ভাবে ব্যবহার করছেন?” “মহিলা তো কী হয়েছে? আমি বিজয় দত্ত। যোধপুর পার্ক আমার। আমি কাউন্সিলারের লোক। তোর স্বরলিপি আমিই লিখব। তোর স্ক্রিপ্ট লিখব এবার। কী ভাবে ব্যবসা করিস এই যোধপুর পার্কে আমি দেখে নেব”, ঠিক এই ভাবেই শাসানি দিয়ে চিৎকার করতে করতে তিনি বেরিয়ে যান। এরপরের ঘটনাগুলি হয়তো অনেকেই জানেন না।

মহিলা কমিশনে যোগাযোগ করি। চেয়ার পার্সনের নির্দেশ মতো থানায় যাই। অভিযোগটা নেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনও জিডি বা এফআইআর করা হয় না। জিজ্ঞেস করি, “জিডি বা এফআইআর কেন করলেন না?” তার উত্তরে বলা হয়, “কাল বড়বাবু সকালে এসে যা করার করবেন।” এদিকে আমরা যখন ঢুকছি, ঠিক তখনই বড়বাবু বেরিয়ে গেলেন। ঠিক আমাদের সামনে দিয়েই চলে গেলেন তিনি। তারপর যে কাণ্ডটা ঘটল থানা থেকে বেরোনোর সময়, তার জন্য সত্যিই অবাক হলাম। আমার শহরটাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য সত্যিই উত্তরপ্রদেশ মনে হয়েছিল।

থানা থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বাইকবাহিনী আমাদের ধাওয়া করতে থাকে রীতিমতো। লেক থানা থেকে বেরিয়ে যোধপুর পার্কের সামনে এসে আমাদের আটকানো হয়। আমার এক পুরুষ বন্ধুর গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম। সেই বন্ধুই বুদ্ধি করে গাড়িটা যাদবপুর থানার সামনে দাঁড় করায়। তারপরে লেক থানায় ফোন করে ঘটনাটা বলি। আধ ঘণ্টা পর পুলিশ আমাদের উদ্ধার করে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। পরের দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। কোনও ফোন আসেনি পুলিশের কাছ থেকে। তারপর কিছুটা বাধ্য হয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হই। কারণ, আমরা আশঙ্কা করছিলাম যে ওই দিন বাইকবাহিনী যে ভাবে আমাদের ধাওয়া করেছিল, তাতে যা কিছু হতে পারত তার পরে। আসলে পুলিশ যে কিছু করবে না, সেই উদাসীনতা সে দিন ওদের চোখেমুখেই ফুটে উঠেছিল।

দুঃখের বিষয় হল, ঘটনাটা তখনই জানাজানি হয় যখন মিডিয়া কভার করে। পুলিশ তো আজও ফোন করেনি। হয়নি এফআইআরও। ঘটনার সত্যতা জানার জন্য পুলিশ আমার কাছে বা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে কিছুই যাচাই করেনি। মিডিয়ায় বিষয়টা আসার পরে পুলিশ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। আর তার থেকেও হাস্যকর বিষয়টা হল, গ্রেফতার করার ২৪ ঘণ্টাও হয়নি, ৫০০ টাকার বেল বন্ডে ওই পাঁচ জনকে ছেড়েও দেওয়া হয়। আর এখানেই আমার প্রশ্ন, অভিনেতা হওয়ার সুবাদে আমাকে অনেকে চেনেন বলে ঘটনাটা মিডিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছিল। আর পৌঁছেছিল বলেই পুলিশ ওদের অন্তত গ্রেফতারটুকু করেছিল।

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কতশত কথা আমরা বলে থাকি। কিন্তু এই কলকাতা শহর কি একটা নারীর ক্ষেত্রে ব্যবসা করার জন্য উপযুক্ত জায়গা নয়? এর আগে মুদিয়ালিতে বৈঠক নামে আমার আর একটা কফিশপ ছিল। সেখানেও এরকম চাঁদার জন্য জুলুমবাজি করা হত। সেটা বন্ধ করে পরে আবার বৈঠক খুলি। নরেন্দ্রপুরে আবার বৈঠকের শাখা ‘আবার বৈঠক আবোলতাবোল’ খুলি ২০২০ সালের অক্টোবরে। সেখানেও এমনই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কিন্তু যোধপুর পার্কে এমন কখনও হয়নি। তাই বারবার খটকা লাগে। মহিলা বলেই কি বারবার আক্রমণ? উদ্যোগপতি যদি পুরুষ হতেন, তাহলে ওই হুমকি কি দিতে পারত তারা? উদ্যোগপতি মহিলা হলেই যত সমস্যা, তাই না? এর শেষটাই বা কোথায়, জানতে ইচ্ছে হয় বড়। মনে হয়, এ শহরটা আদৌ আমার বটে তো? তার থেকেও বড় কথা হল, এত বড় একটা শহরে মহিলা পুলিশ নেই? লেক থানা থেকে বেরোনোর পরে যখন গুন্ডারা আমাদের চেজ় করে, তারপরে কয়েক জন পুরুষ পুলিশ আমাদের উদ্ধার করতে আসবে?

তবে আজকের মতো বিশেষ দিনে একটা বিষয় ভেবে ভাল লাগে যে, আমার এই ঘটনার সময়ে প্রচুর নারীই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বরং পুরুষরা আমাকে বলেছিলেন, “সাবধান! তোর কিন্তু একটা ছোট্ট মেয়ে আছে।” ঘটনার শুরু থেকে শেষ আমার সঙ্গে ছিলেন আমার এক দিদি। তাঁকেই ওই গুন্ডারা প্রথমে আবার বৈঠকের মালিক ভেবে বসেছিল। আমার হয়ে সব ধমক সামলেছিলেন তিনিই। থানাতেও দিদি আমার সঙ্গে ছিলেন। ফেসবুকে তিনিই ঘটনাটা প্রথম শেয়ার করেছিলেন। সেখান থেকেই জানাজানি হয়। আমার প্রচুর মহিলা বন্ধুরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সাহস যুগিয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সবথেকে বেশি শেয়ার করেছিলেন মহিলারাই। ওঁরা আমাকে কখনও একা অনুভব করতে দেননি। একটা সময় মনে হয়েছিল, এই লড়াইটা আবার বৈঠকে যত মহিলারা আসেন, তাঁদের সকলের। তাই এতক্ষণ ধরে আমি-আমি করে, লড়াইয়ের ক্রেডিটটা আমি নিতে চাই না। এই লড়াই শহরের প্রত্যেকটা নারীর, আবার বৈঠকের প্রত্যেকটা মহিলা কাস্টমারের, আমার দিদির, আমার বন্ধুদের।

একা মা স্বরলিপি।

আর এই ঘটনা একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিল যে, মানুষ পাশে থাকে, পুলিশ নয়। মানুষের নিরাপত্তায় অতন্দ্র প্রহরার দায়িত্বভার যাঁদের কাঁধে, তাঁরা অভিযোগকারিণীকে দেখলেই পাতলা গলি দিয়ে টুক টুক বেরিয়ে যাবে! আর তাই এখন আমার অভিযোগটা পুলিশের বিরুদ্ধেই। গুন্ডারা তো আছে গুন্ডামি করার জন্যই। তাদের তো পুলিশই রুখবে। কিন্তু সেই পুলিশই যে শেষমেশ নিষ্ক্রিয়। সাধারণ মানুষ বিচার পেতে তো প্রাথমিক ভাবে পুলিশের কাছেই যান। কিন্তু পুলিশই যদি এরকম করে, তাহলে কী সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হবে? দু’দিন ফেসবুকে এর-ওর ওয়াল থেকে দেদার শেয়ার করা হবে, তারপরে আবার যা কার তাই!

গ্রাফিক্স: অভিজিৎ বিশ্বাস

অনুলিখন: সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়

আরও পড়ুন: ‘পাত্র চাই’, ফেসবুক কমিউনিটিতে সিঙ্গল নারীদের বিবাহ অভিযান

আরও পড়ুন: শুভ্রকে প্রপোজ় করেছিলাম আমিই, শরীর পুড়লেও মন তো পোড়ে না: সঞ্চয়িতা যাদব 

আরও পড়ুন: রূপান্তরকামীর শংসাপত্র পাওয়ার অদম্য লড়াই নারীর

Next Article