কিছু সাধারণ ও সাদামাঠা মুখ থাকে আমাদের জীবনে। কয়েক বছর তাঁরাই হয়ে ওঠেন আমাদের জীবনের রোজনামচার অংশ। তাঁরাই চুপচাপ আমাদের গড়ে তোলেন। আমরা বড় হয়ে যাই। তারপর তাঁদের ভুলেও যাই হয়তো… শিক্ষক দিবস আসতে আরও একমাস বাকি। সেদিন হয়তো মনে পড়বে… ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে ভেসে আসবে শুভেচ্ছাবার্তা… কেবল সেদিনই! তারপর আর মনে আসবে না… আবার একটা বছর পর তাঁরা আমাদের স্মৃতিতে ভিড় করবেন। কিন্তু যে মানুষটি এসবের ঊর্ধ্বে, তিনি অরিজিৎ সিং। সম্প্রতি জিয়াগঞ্জে নিজের স্কুলে গিয়েছিলেন অরিজিৎ। তাঁর ক্লাস ফাইভের ইংরেজি শিক্ষিকার পায়ের কাছে বসে কত্ত গল্প করেছেন। এর চেয়ে বেশি একজন শিক্ষিকা কীই বা চাইতে পারেন…
বিখ্য়াত হয়েও কীভাবে অমায়িক হয়ে থেকে যাওয়া যায়, ‘আমিত্ব’কে বড় না করে কীভাবে নিজের ভিতরের ‘আমি’টাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, এই যুগে দাঁড়িয়েও অনেকের চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে চলেছেন অরিজিৎ। সবজান্তা, অহংবোধে আচ্ছন্ন পরিমণ্ডলে গায়ক বড়ই বেমানান। আর বেমানান বলেই হয়তো তাঁর প্রতি মানুষের ভালবাসা অটুট। না, কেবল গানের জন্য নয়। মানুষটাই যে বড্ড বেশি মাটির। বড্ড বেশি মিশে থাকেন মাটির সঙ্গে। অরিজিৎ এমন একজন মানুষ, যাঁকে বিপুল সাফল্য ছুঁলেও, সাফল্যের বুদবুদে নেশা তাঁকে বশ করতে পারেনি। হয়তো কোনওদিন পারবেও না। বারবারই সেই প্রমাণ তিনি দিয়ে চলেছেন নিজের ব্যবহার ও কাজের মাধ্যমে।
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী এক ডাকে তাঁকে চেনেন সকলে। বড় কোনও সিনেমা তৈরি হয় না তাঁর গান ছাড়া। গোটা দেশে, এমনকী বিদেশেও তিনি বিখ্যাত। হিল্লিদিল্লি করে বেড়ান। কিন্তু মন তাঁর পড়ে থাকে জন্মস্থান জিয়াগঞ্জেই। মুর্শিদাবাদের এই ছোট্ট শহরেই বেড়ে উঠেছেন অরিজিৎ। মাটির টান! কত মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না।
বিদেশে ঘুরে ঘুরে গানের কনসার্ট করে বাড়ি ফিরতে চাইছিলেন অরিজিৎ। নিজের ছেলেবেলার স্কুল ও শিক্ষকদের কাছে গিয়েছিলেন গত বৃহস্পতিবার। এটাই প্রথমবার নয়। এর আগেও বহুবার তিনি দেখা করেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে। এবারও তাই করলেন গায়ক। আসলে স্কুলের জন্য তিনি কিছু করতে চাইছেন। সেই নিয়ে ছিল আলোচনাও।
আরবসাগরের তীরে দেশের ব্যস্ততম শহর মুম্বইয়ে বিলাশের শেষ নেই অরিজিতের। অট্টালিকার মতো বিরাট প্রাসাদে থাকেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, এত প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও তাঁর চোখের সামনে ভেসে আসে সেই মুখগুলো। মানুষগুলো তাঁর বড়ই আপন। ছোট থেকে অরিজিৎকে গড়েপিঠে তৈরি করেছেন তাঁরাই। অরিজিৎ ভুলতে পারেন না ভাগীরথীর পাড়, জিয়াগঞ্জের অলিগলি, মানুষজন ও তাঁর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের… যাঁদের কাছে কানমোলা থেকে বকুনি সবটাই খেয়েছেন অরিজিৎ।
সবাইকে ফের চমকে দিয়ে সাদামাঠা জামা পরে স্কুল প্রাঙ্গনে এসে হাজির অরিজিৎ। সেলিব্রিটি এসেছেন বলে কথা। কিন্তু তিনি তো আর সকলের কাছে সেলিব্রিটি নন। এখনও তিনি হাফপ্যান্ট পরা সেই ছোট্ট ছেলেটাই… যাঁকে অ-আ-ক-খ শিখিয়েছিলেন মাস্টারমশাইরা, দিদিমণিরা। অরিজিতের স্কুলের নাম রাজা বিজয় সিংহ বিদ্যামন্দির। স্কুলে প্রবেশ করে তিনি সোজা চলে যান ইংরেজি শিক্ষিকার কাছে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন। বসে গল্প করেন দীর্ঘক্ষণ।
দিদিমণির নাম সুনীতা লাহিড়ী। হাতে ধরে অরিজিৎকে ইংরেজি পড়েছিলেন তিনি। সে যেন এক অন্য ছবি। অন্য অরিজিৎ। দিদিমণির পায়ের কাছে বসে আছেন সঙ্গীতের রাজপুত্র। দিদিমণি আলতো করে হাত রাখেন রাজপুত্রের মাথায়। মুহূর্তের একটি ছবিও ফ্রেমবন্দি হয়েছে। একটি টি-শার্ট, পাজামা ও পায়ে হাওয়াই চটি পরে স্কুলে ঢোকেন বিশ্বমাতানো গায়ক।
বিখ্যাত ছাত্র তাঁর দিদিমণিকে ভোলেননি। আনন্দে চোখে জল চলে এসেছিল সুনীতাদেবীর। হাজার পারিশ্রমিকের চেয়ে বড় গুরুদক্ষিণা হয়তো এটাই। সুনীতাদেবী বলেন, “বৃহস্পতিবার অরিজিৎ আমাদের স্কুলে এসেছিল। পঞ্চম শ্রেণি থেকে আমাদের স্কুলেই পড়ত। ও আজকে বড় গায়ক হয়েছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভাল। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কত সহজে মিশে যায়, ওঁ ভীষণ ডাউন টু আর্থ। স্কুলে এল, সবার সঙ্গে কথা বলল। ওঁর সঙ্গে কথা বলে খুবই ভাল লাগল। ছাত্র যতই বড় হোক, সে তো আমাদের কাছে ছাত্রই। আজ যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতা এবং নিজের গুণে। আমাদের গর্ব হয় এই সাফল্যে।”
গত ১৩ এপ্রিল নিজের স্কুলেরই পরিচালনা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন অরিজিৎ সিং। সেই দায়িত্ব নিয়ে স্কুলের উন্নতির জন্য কী কী করা হবে, সেই নিয়ে ভাবনাচিন্তাও শুরু করে দিয়েছেন গায়ক। এদিন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি ও তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করেন অরিজিৎ।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “অরিজিৎ সভাপতি পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর এদিন স্কুলে আসেন। সকলে মিলে খুব ভালভাবে আলোচনা হয়েছে। স্কুলের কমিটি কীভাবে তৈরি হয় এবং কীভাবে কাজ করে, সেটা জেনে নিয়েছেন।”