Swapnasandhani at 30: স্বপ্নসন্ধানী’র উত্তরসূরি কেবল ঋদ্ধি কেন হবে?: কৌশিক সেন

Kaushik Sen-Riddhi Sen: তিন দশকের স্মৃতির স্মরণী দিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে TV9 বাংলার সঙ্গে নানা কথা ভাগ করে নিলেন কৌশিক ও তাঁর পুত্র ঋদ্ধি। TV9 বাংলাও জানতে পারল কে হতে চলেছে 'স্বপ্নসন্ধানী'র উত্তরসূরি।

Swapnasandhani at 30: স্বপ্নসন্ধানী'র উত্তরসূরি কেবল ঋদ্ধি কেন হবে?: কৌশিক সেন
ফিরে দেখা ও এগিয়ে যাওয়া।
Follow Us:
| Updated on: May 21, 2022 | 12:39 PM

স্নেহা সেনগুপ্ত

‘৩০ বছরে পা দিতে চলেছে নাট্যদল ‘স্বপ্নসন্ধানী’। দলের বর্তমান সদস্য়দের মধ্যে রয়েছেন কৌশিক সেন, ঋদ্ধি সেন, রেশমি সেনরা। ১৯৯২ সালের ২৯ মে যাত্রাশুরু হয়েছিল এই দলের। সেই দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ৩০ বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আগামী ২৯ মে মঞ্চস্থ হতে চলেছে স্বপ্নসন্ধানীর নাটক ‘হ্যামলেট’। নাটকে হ্যামলেটের চরিত্রে অভিনয় করবেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা ঋদ্ধি সেন। পরিচালনা করেছেন কৌশিক সেন। তিন দশক ধরে একটি নাটকের দল চালিয়ে যাওয়া অনেক বড় ব্যাপার। গোড়ার দিন থেকে প্রায় সন্তানের মতো দলটিকে লালন করেছেন কৌশিক ও দলের অন্যান্য সদস্য়রা। দলের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন ঋদ্ধি। তিন দশকের স্মৃতির স্মরণী দিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে TV9 বাংলার সঙ্গে নানা কথা ভাগ করে নিলেন কৌশিক ও তাঁর পুত্র ঋদ্ধি। TV9 বাংলাও জানতে পারল কে হতে চলেছে ‘স্বপ্নসন্ধানী’র উত্তরসূরি।

দলের নাম ‘স্বপ্নসন্ধানী’ কে দিয়েছিলেন?

কৌশিক: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন থেকে নেওয়া হয়েছে শব্দটি। নামকরণটি করেছিলেন স্বপ্নসন্ধানীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাপস চক্রবর্তী। তিনি এখনও অভিনয় করেন। বয়সের কারণে নিয়মিত করতে পারেন না। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম সদস্যা রেশমী সেন ও দিতিপ্রিয়া সরকার।

আরও একটা বিষয় আপনাদের জানিয়ে রাখা অত্যন্ত আবশ্যক। এই নাটকের যতগুলি শো আমরা করব, তার যে উদ্বৃত্ত টাকা থাকবে, সেই টাকার একটা অংশ আমরা ব্যাকস্টেজের ওয়ার্কারদের দেব (বেকস্টেজের নেপথ্য কর্মী)। তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য তো পাবেনই, সেই সঙ্গে এই টাকাটাও পাবেন। এই বিষয়টিতে আমাদের সঙ্গে সহায়তা করছে ক্যালকাটা ব্রডওয়ে, বিক্রম দাশগুপ্তর ফাউন্ডেশন। 

৩০ বছরের তিনটি স্মরণীয় ঘটনা?

কৌশিক: এক নম্বর স্মরণীয় ঘটনা: ‘টিকটিকি’ নাটকটার কথা আমি এখানে বলব। স্বপ্নসন্ধানীর ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৯৫-এ ‘টিকটিকি’ নাটকটা আমরা মঞ্চস্থ করেছিলাম। পরিচালনা করেছিলেন সৌমিত্রজেঠু। সেই একটি নাটকই আমাদের জন্য তিনি পরিচালনা করেছিলেন। মাইলস্টোল হয়ে থাকবে। স্বপ্নসন্ধানীর কাছেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল। দুই নম্বর ঘটনা: ১৯৯২ সালে জন্মের পর প্রতিবছরই দিল্লির এনএসডির আন্তর্জাতিক থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল ‘ভারতরঙ্গ মহোৎসব’ প্রতিযোগিতায় যেত আমাদের দলের নাটক। ২০০২ সালে মনোনীত হয় প্রথমবার। সারা ভারত থেকে ৮০০-৯০০টি নাটক জমা পড়ে। কিন্তু মনোনীত হয় মোটে ৭০-৮০টি। আমাদের সেই নাটকটির নাম ছিল ‘প্রাচ্য’। আমি পরিচালনা করেছিলাম। বাংলাদেশের নাট্যকার সেলিম আলদিনের নাটক। ২০০২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমরা এগারোবার মনোনীত হয়েছি। তিন নম্বর স্মরণীয় ঘটনা: ২০০৪-২০০৫ সাল থেকে প্রায় ২০১০-২০১২ পর্যন্ত আমরা দক্ষিণ কলকাতার একটি ছোট অডিটোরিয়াম টেকওভার করেছিলাম – সুজাতা সদন। মাত্র ২০০টি সিট থাকত। প্রতি শনিবার আমাদের শো থাকত সেখানে। কোনও বড় খবরের কাগজে আমরা বিজ্ঞাপন দিতাম না। তা সত্ত্বেও মানুষ নাটক দেখতে আসতেন। সেটা তাঁদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। লোকে লাইন দিয়ে নাটক দেখেছেন সেখানে। কেবল তা-ই নয়, বহু গুণী ব্যক্তিরা আসতেন। সৌমিত্রজেঠু, অপর্ণা সেন, মৃণাল সেন, শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেবসেন… প্রায় সকলেই। পিটার ব্রুকের সেট ডিজ়াইনার জাঁ লেকো এসেছিলেন।

এসে কী বলেছিলেন?

কৌশিক: ভীষণ ভাল লেগেছিল তাঁর। সুজাতা সদনের স্পেসটা ওঁর খুবই পছন্দ ছিল। আমরা একটি ইবসেনের নাটক করতাম। ‘মাস্টার বিল্ডার’ নাটকটার নাম ছিল। ২০০৭ সালে ইবসেন সোস্যাইটির চিফ ফ্রোডে হেলান্ড নাটকটি দেখে বড় একটি আলোচনা লিখেছিলেন। আমাকে বেছে নিতে বলা হলে, আমি এই তিনটি ঘটনার কথা বলব।

১৯৯২ সাল থেকে ২০২২ সালের এই সময়টায় দর্শকের মধ্যে কী পরিবর্তন দেখছেন?

কৌশিক: দর্শক আনুকূল্য যদি আমি বলি, তা হলে বলব আমরা খুবই সৌভাগ্যবান। স্বপ্নসন্ধানীর এখন একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শক আছেন। ধরুন, আমাদের ‘হ্যামলেট’ হবে ২৯ মে, অনলাইনে এখন থেকেই ৭৬,০০০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। এখনও কিন্তু কাউন্টার খোলেনি। এই সৌভাগ্য কিন্তু ‘স্বপ্নসন্ধানী’র আছে। পার্থক্য যেটা হয়েছে, মানুষের ধৈর্য্য অনেকটাই কমে গিয়েছে। মানুষ এখন কথা শুনতে চান না। মানুষের গভীরতার প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। সেইটা মাঝেমধ্যে আমাকে পীড়িত করে। কিন্তু উপায় নেই। যেমন ধরুন, আমরা শেক্সপিয়র করছি। সেখানে তো কথাই প্রধান। সেই কারণে আমাদেরও উপস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। গভীরতা আছে অথচ বোরিং নয়, সেরকম।

ঋদ্ধি: আমাদের দল মাইলস্টোল ছুঁয়েছে। সংখ্যাই যদি ধরি, অনেক দল আছে, যাদের ৪০-৫০-৬০ বছর পূর্ণ হয়েছে। ৩০ বছর পূর্ণ করা বড় বিষয় নয়, সেটা মিনিংফুলি ক্রস করা বড় বিষয়। ‘স্বপ্নসন্ধানী’ নিজেদেরকে বারবার ভেঙেছে। নিজেদের বারবার গড়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পড়েছে। যে-যে নাটক বাবা (কৌশিন সেন) পরপর বেছেছেন, সেই দর্শক জেনারেট করা খুবই কঠিন কাজ বলে আমি মনে করি। ‘স্বপ্নসন্ধানী’র নাটক দেখতে আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েরা অনেকেই আসেন। সেইটা আমার খুব ভাল লাগে।

‘স্বপ্নসন্ধানী’র উত্তরসূরি কে, ঋদ্ধি?

কৌশিক: উত্তরসূরি কেবল ঋদ্ধি কেন হবে? ঋদ্ধির কিন্তু থিয়েটার নিয়ে আলাদা করে কোনও স্বপ্ন নেই। ও অভিনয় করতে ভালবাসে। সেটা মঞ্চে হতে পারে, পর্দায় হতে পারে। কিন্তু এর পাশাপাশি ও ভবিষ্যতে খুবই সেন্সিটিভ ও সেন্সিবল পরিচালক হবে। কিন্তু থিয়েটার ডিরেক্ট করবে না। সেটাতে ওর কোনও ইচ্ছে নেই। একটা ছোট নাটক পরিচালনা করেছে ঠিকই। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর আমরা একটা ছোট নাটক করেছিলাম ‘ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার’, রতনকুমার দাসের লেখা। সেখানে আমি একা অভিনয় করেছিলাম, ঋদ্ধি পরিচালনা করেছিল। পরবর্তীতে ও থিয়েটারে অভিনয় করলেও সিনেমা তৈরি করবে। ফলে ও-ই যে স্বপ্নসন্ধানীকে টেকওভার করবে, ও-ই উত্তরসূরি… এরকমটা কিন্তু নয়। স্বপ্নসন্ধানীর উত্তরসূরি স্বপ্নসন্ধানীর সকলে। ভবিষ্যতে কোনও তরুণ পরিচালক এসে যদি স্বপ্নসন্ধানী টেকওভার করতে চান, আমি দিয়ে দেব।

ঋদ্ধি: গত বছর আমি একটা ছোট নাটক পরিচালনা করেছিলাম। সেখানে ঋতব্রত লাইভ স্ক্রিনিং করেছিল আর সুরঙ্গনা মিউজ়িক করেছিল। আমি ওদের সঙ্গেই সিনেমায় কাজ করব যেহেতু, ওদের নিয়েই নাটকটা করেছিলাম। নাটকটা পরিচালনা করে আমার ভাল লাগে। কিন্তু আমার মনে হয় সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে আমি অনেকটা বেশি বুঝি। যে ধরনের গল্প আমার বলতে ইচ্ছে করে, সেটা সিনেমার ফর্মকে মাথায় রেখেই ইচ্ছে করে। হয়তো থিয়েটার পরিচালনা করব। কিন্তু সিনেমা পরিচালনায় বেশি ইচ্ছে আমার। আমি আর বাবা এটা নিয়ে বহুবার আলোচনাও করে ফেলেছি। আমরা দু’জনেই চাই নতুন পরিচালক উঠে আসুন। আমরা চাই আমাদের দলের ভিতরেই নতুন পরিচালক তৈরি হোক। সেটা আমাকেই করতে হবে সেরকম কোনও মানে নেই। আমি মনে করি, আমার থেকে ঢের বেশি প্রতিভাবান থিয়েটার পরিচালকরা আছেন, যাঁরা সত্যি-সত্যিই সঠিক প্ল্যাটফর্ম চাইছেন। অন্য পরিচালকদের যদি আমরা ইনভাইট করতে পারি অনেক ভাল হবে সেটা।

ঋদ্ধি, আপনি তো জন্মের সময় থেকেই দলটি দেখছেন…

ঋদ্ধি: হ্যাঁ, দল তৈরি হয় ১৯৯২ সালে। আমার জন্ম হয় ১৯৯৮ সালে। দল আমার চেয়ে ৬ বছরের বড় (হাসি)। আমাদের একটা নাটক ছিল ‘তাঁরা তিন বোন’। সেখানে একটা সিকোয়েন্স ছিল, প্যারামবুলেটারে করে একটা বেবিকে নিয়ে আসা হচ্ছে। আমাকেই নিয়ে যাওয়া হত। আমার তখন ৬-৭ মাস বয়স। ৩ বছর বয়স থেকে আমি স্টেজে অভিনয় করা শুরু করলাম। দল ৩০ বছর কাটাল, এই গোটা বিষয়টাই আমার কাছে খুব আবেগপ্রবণ। ৩০ বছর পার করার দৈর্ঘ্য… নিজেকে যখন জিজ্ঞেস করি উত্তর খুঁজি, আমার সেই ধৈর্য্য থাকবে কি না। আজ মানুষ বিশ্বাস করতে পারেন না, যে থিয়েটার থেকে আমরা অর্থ উপার্জন করি না। উপরন্তু নিজেরা টাকায় দিয়ে দল চালাই। আমি নিজের বাড়িতেও দেখেছি, নাটক চালিয়ে নেওয়ার জন্য নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা নিয়ে নাটকের প্রোডাকশন করেছে। অনেক অভাব দেখেছি। আমাদেরও আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তার জন্য কিন্তু কোনওদিনও নাটক বন্ধ হয়নি। আরও একটা বিষয় – স্টুডেন্ট তৈরি করা, সেটা কিন্তু স্বপ্নসন্ধানী করেছে। অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত তারকা। রজতাভ দত্ত থেকে শুরু করে কাঞ্চন মল্লিক… স্বপ্নসন্ধানীর শুরুর দিকের সদস্য ওঁরা।

আরও ৩০ বছর পর স্বপ্নসন্ধানীকে কোন জায়গায় দেখতে চান?

কৌশিক: দেখুন থিয়েটার করে কোনও রোজগার হয় না। অন্য কাজ করে, সেখান থেকে উপার্জন করে থিয়েটার করতে হয়। অথচ, যদি বাংলা সিরিয়াল ও সিনেমা দেখেন, যত ভাল অভিনেতা আছেন তাঁরা প্রত্যেকেই থিয়েটার থেকে তৈরি হয়ে এসেছেন। অথচ থিয়েটার সবচেয়ে বেশি অবহেলিত মাধ্যম। আমি চাইব, যে থিয়েটার করে যদি উপার্জন করা যায়, তা হলে নতুন দিক খুলে যাবে। আমি যদি মাসে অন্তত ৫০,০০০-৬০,০০০ টাকা থিয়েটার থেকেই রোজগার করতে পারতাম, হয়তো কেবল থিয়েটারটাই করতাম; সিনেমা কিংবা সিরিয়ালে অভিনয় করতাম কি না সন্দেহ। আমি চাইব আগামী ৩০ বছরে থিয়েটার তার প্রাপ্য সম্মান পাক। রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার, যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, আরও একটু অর্থ ব্যয় করুক। প্রাইভেট স্পনসরশিপস এগিয়ে আসুক। কেবল মঞ্চ নয়, নানাভাবে থিয়েটার করা যেতে পারে। সেটা আমাদের এক্সপ্লোর করতে হবে।

ঋদ্ধি: ৩০ বছর পর পৃথিবীটাই থাকবে কিনা আমরা জানি না। কিন্তু যেহেতু থিয়েটার ভীষণই সমসাময়িক একটা শিল্প, ভিডিয়োতে দেখে এর কোনও মজা নেই। মানুষের স্মৃতিতেই থেকে যায়। যতদিন আমাদের কাজ করার সুস্থ সমাজ থাকবে, ততদিন স্বপ্নসন্ধানী থিয়েটার জারি রাখবে। বাবার খুব ইচ্ছে প্রসেনিয়ামের বাইরে গিয়ে থিয়েটার করবে। আমারও সেটাই ইচ্ছা।

গ্র্যাফিক্স : অভীক দেবনাথ