গত মাসের শুরুতেই ম্যাসাচুসেটসে একটি মাঠে মায়েরা একত্র হয়েছিলেন। মাত্র ২০ মিনিটের জন্যই তাঁরা দেখা করেন। আর সেখানে এই সময়টুকু তাঁরা সবাই মিলে জোরসে চিৎকার করে নিজেদের হতাশা প্রকাশ করেন। অবাক লাগছে শুনে? এমনটাই কিন্তু ঘটেছে। আর মায়েদের জন্য এই বিশেষ প্রয়াস নিয়েছেন আরও দুই মা। যাঁদের মধ্যে একজন হলেন থেরাপিস্ট সারাহ হারমন, অন্যজন তাঁর পরামর্শ নিতে আসা আরও দুই সন্তানের মা। প্রতিদিন অসংখ্য মা তাঁর কাছে আসেন পরামর্শ নিতে। সকলেরই অভিযোগ কিন্তু একই রকম। তাঁরা প্রত্যেকেই অত্যধিক রাগ, হতাশায় ভুগছেন। সংসার নামক এই মায়াজালের বাঁধন থেকে মুক্তি চাইছেন। কিন্তু কোনও কথাই মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আর তাই এই মায়েরা যাতে নিজের সব ক্ষোভ, রাগ উগরে দিতে পারেন- তার জন্যই কিন্তু বিশেষ এই সেশনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সারাহ। তবে এমন মুক্ত পরিবেশ পেয়ে উপকৃত হয়েছিলেন মায়েরা, তা তাঁরাই নিজমুখে জানিয়েছেন।
গত দুবছরে অতিমারী আমাদের সবাইকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। জীবনযাত্রায় এসেছে অনেকখানি বদল। সবাই কিছু না কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। এছাড়াও কোভিড কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে একরকম ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। যেখান থেকে সকলেই চাইছেন সুস্থ এবং সুরক্ষিত থাকতে। বাড়িতে একটানা থাকতে থাকতে অজানা সেই ভয় আতঙ্ক যেন আরও অনেকটা বেশি চেপে ধরেছে। আর তাই বাড়ির দুই ছোট সন্তানকে সামলেও সেদিনের ওই ২০ মিনিট শুধু নিজের জন্য রেখেছিলেন টেস ও’ব্রায়েন।
সেদিনের ওই ছোট্ট জমায়েতে এসে টেস আরও বলেন, ‘আমার সবাই ভিতর থেকে শেষ হয়ে গিয়েছি। ক্রমাগত ভয়, সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা, পরিবারকে সুরক্ষিত রাখা, সময়মতো নিজের সব কাজ সামলে ওঠা এবং সন্তানের যাবতীয় দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি। মানসিক ভাবে আমরা সকলেই ক্লান্ত। কোথাও গিয়ে নিজের কাজগুলো সম্পূর্ণ হচ্ছে না। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর কাছে মাস্কময় এই পৃথিবী- ভাবলেও খারাপ লাগে’।
হারমনের বাড়িতেও তিন আর পাঁচ বছরের দুই সন্তান রয়েছে। এদিকে তাঁর কাছে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসছেন এই অভিযোগ নিয়ে। প্রথমে এসে একটানা সকলেই নিজের কথা বলেন। আর এরপরই তিনি ভাবলেন, যদি সব মায়েরা একসঙ্গে জড়ো হয়ে একটানা চিৎকার করে নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিতে পারেন। কারণ তিনি দেখছিলেন, তাঁর ক্লায়েন্টদের মনের মধ্যে প্রচুর ক্ষোভ। কিন্তু মন খুলে কথা বলার মত কোনও রকম সুযোগ নেই। এছাড়াও একেবারে বাচ্চাদের জন্য এখনও কোভিডের কোনও টিকাকরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর তাই তাঁরাও কিন্তু সন্তানদের স্বাস্থ্য নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগে।
হারমানের এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে অনেক মানুষ সাড়া দেন। এরপর তাঁরা ১৩ জানুয়ারী একত্রিত হন একটি মাঠে। সেখানেই তাঁরা নিজেদের রাগ, দুঃখ, হতাশা, বিরক্তি, একাকিত্ব, তিক্ততা, অপরাধবোধ, উদ্বেগ এসব নিয়ে মন খুলে কথা বলেন একে অপরের সঙ্গে। এই ২০ মিনিটের চিৎকারকে তাঁরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নেন। প্রথম পাঁচমিনিট ছিল স্বাভাবিক চিৎকার, তারপরটি শপথের জন্য চিৎকার, পরেরটি সব মানুষের জন্য আর শেষটি যে সব মায়েরা লকডাউনে আটকে পড়েছেন এবং সন্তানদের ছেড়ে আসতে পারেননি তাঁদের জন্য।
কিন্তু কেন চিৎকার করছেন এই মায়েরা? এই বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম শহরের তিন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। পেরেন্টিং কনসাল্টট্যান্ট (Parenting Consultant) পায়েল ঘোষ যেমন জানান, গত দু’বছরে অন্তত ৪০০ মা তাঁর দ্বারস্ত হয়েছেন। এবং তাঁরা প্রত্যেকেই এসে প্রথমে নিজের কথা বলেছেন। নিজেদের দুঃখের কথা যেমন মন খুলে কাউকে বলতে পারেননি তেমনই অকারণেই বেশি বিরক্ত হয়েছেন। বাচ্চার উপর অত্যধিক চোটপাট করেছেন। আর ২৪-৪৭ বছর বয়সীদের মধ্যে কিন্তু এই সমস্যাটা সবচাইতে বেশি। দু বছর ধরে গৃহবন্দি, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এসব তো আছেই। আর তাই পায়েল পাঁচটি পরামর্শ দিচ্ছেন মায়েদের।
১. দিনের শুরুর প্রথম ১৫ মিনিট কিন্তু শুধুমাত্র নিজের জন্যই রাখুন। মেডিটেশন করতেই হবে।
২.কোন সময় কোন কাজ করবেন তা আগে থেকে ঠিক করে নিন। যখন অফিসের কাজ করবেন তখন সেই সময়টা কিন্তু শুধুমাত্র কাজের জন্য। আর সেই সময়টাতে কারোর কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। ওয়ার্ক ফ্রম হোম ২ বছর হয়ে গিয়েছে। এবার আপনার জবাব দেওয়ার পালা।
৩.দিনের মধ্যে অন্তত ১ ঘন্টা নিজের মধ্যে রাখুন। ৩০ মিনিট সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটুন ৩০ মিনিট বই পড়া/টিভি/ওয়েব সিরিজের জন্য রাখুন। মোট কথা নিজের পছন্দমত কাজ করুন।
৪. বন্ধুদের সঙ্গে সপ্তাহে অন্তত ১ দিন দেখা করুন।
৫. দিনের মধ্যে ৭-৮ ঘন্টা ঘুম জরুরি।
অভিনেত্রী রূপাঞ্জনা মৈত্র যেমন বললেন, ‘এই দুবছরে গৃহবন্দি থেকে আমার কিন্তু কোনও সমস্যা হয়নি। কোনও অবসাদ আসেনি। নিজের কাজ আর ছেলের পড়াশোনা দুই সামলেছি। আমি ঠিক করেই রেখেছিলাম এই সময়টা পুরোপুরি অমি ছেলেকে দেব। ছেলের পড়াশোনা, ক্লাসের ধরণ এখন সবই আমার আয়ত্তে। তবে অনলাইন ক্লাসে বাচ্চার প্রোগ্রেস ঠিক করে বোঝা যায় না। আমার মতে, বাচ্চাদের সম্পূর্ণ ভ্যাকসিনেশন না হওয়া পর্যন্ত স্কুল না খোলাই ভাল। জীবন থেমে থাকে না। পরবর্তী প্রজন্মের কথা কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে। সামনের দিন ওদের কাছে অনেক বেশি ভয়ংকর’। সেই সঙ্গে রূপাঞ্জনা আরও বলেন, সন্তানকে জোর করে পড়াবেন না। অতিরিক্ত চাপ দেবেন না, বরং বুঝতে চেষ্টা করুন কোথায় তার অসুবিধে হচ্ছে। হোয়্যাটস অ্যাপে পেরেন্টসদের গ্রুপ রয়েছে। এখান থেকেও কিন্তু আমাদের অনেক উপকার হচ্ছে।
অধ্যাপিকা ও সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ এই প্রসঙ্গে বললেন, ‘বাচ্চা ছাড়াও কিন্তু মায়েদের জীবন থাকে। তবে তাঁরা যদি বলেন, আর পারছি না সেক্ষেত্রে প্রচুর রকম প্রশ্ন ওঠে। সমাজই প্রথম তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। সহজেই তখন সেই মা ‘খারাপ’ মায়ের তকমা পায়। কিন্তু মা- মানেই সব সময় বাচ্চার দেখভাল করবে এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। কোথাও গিয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজন এসেছে। ভাল মা, ভাল স্ত্রী, ভাল মেয়ে হওয়ার দৌড় একটা সময়ের পরে থামানো দরকার। ১০০-শতাংশ দিয়ে দিলেও সেই তকমাটা পাওয়া যায় না- এটা মেয়েদেরই কিন্তু বুঝতে হবে’।
আরও পড়ুন: Lata Mangeshkar: কাগজ-রঙে লতাদিদির ছবি দেওয়া হল না তাঁকেই! আফশোস যাচ্ছে না ব্যান্ডেলের শিল্পীর