কৌশিক সেন:
আসলে বিষয়টা বাজার দখলের। মানব সভ্যতার উপর এমনিতেই একটা যুদ্ধ চলছে গত দু’বছর ধরে। সেটা হল করোনার অতিমারি। এই প্যান্ডেমিককে আমি বহুস্তরের যুদ্ধ বলে মনে করি। রোগটা একটা সংক্রমণ। সেই রোগের সুযোগ নিয়ে চলছে আস্ত একটা যুদ্ধ। সেটার মধ্যে ভ্যাকসিন রয়েছে, ওষুধের কারবার রয়েছে, আরও অনেককিছু রয়েছে। গরিব দেশ, বড়লোক দেশের লোকেদের তফাৎও স্পষ্ট লক্ষ্য করা গিয়েছে এই দু’টো বছরে। বড়লোক দেশের লোকেরা আগে ভ্যাকসিন পেয়েছেন। গরিব দেশের মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েছেন অনেক পরে। সবটাই কিন্তু বাজারনীতি ছাড়া কিছুই মনে হয়নি আমার। তার মধ্যে আরও একটা যুদ্ধ শুরু হয়েছে ইউক্রেনে। এই যুদ্ধের পিছনেও রয়েছে সেই বাণিজ্যই। এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই, যে রাশিয়ার হঠাৎই জাতিগত ভাবাবেগ তৈরি হয়েছে, যে সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধ করতে হবে!
আমরা জানি ওখানে ব্ল্যাক সি আছে। ব্ল্য়াক সি ও ইউক্রেনের যে ভৌগলিক অবস্থান, তা নিজেদের দখলে রাখার জন্য রাশিয়া যুদ্ধ বাঁধাতে চাইছে। পুরনো ঘটনাকে উস্কে দিতে চাইছে। আমেরিকা ও রাশিয়া… এরা সকলেই এক মুদ্রার এ পিঠ-ও পিঠ। চিনও তাই। একটা সময় আমরা যখন অল্পবয়সি ছিলাম, তখন আমাদের কাছে সবটাই খুবই আদর্শগত মনে হত। আমরা তখন বিশ্বাস করতাম পৃথিবীটা দু’টো ভাগে বিভক্ত: রাইট উইং এবং লেফ্ট উইং!
যত বয়স বেড়েছে, দেখেছি ফ্যাসিজ়ম যতখানি ভয়ানক ছিল, কমিউনিস্টরাও ততটাই টোটালিটেরিয়ানিজ় তৈরি করেছে। আমরা প্রথমে সেটা বিশ্বাস করতাম না। মনে করতাম রাশিয়া-চিন প্রগতিশীল দেশ। কিন্তু ক্রমশই এদের নগ্ন চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। পূর্ব জার্মানির ব্যাপারটা ভাবতেই পারতাম না। আমরা পশ্চিম জার্মানিকে গালমন্দ করতাম। মনে করতাম রোমানিয়া স্বর্গরাজ্য। মনে করতাম, যতগুলো কমিউনিস্ট দেশ আছে, সবগুলোই স্বর্গরাজ্য। কিন্তু সে দেশের মানুষের যে দম আটকে গিয়েছিল, সেটা বিশ্বাস করিনি। যে মুহূর্তে কমিউনিস্ট শাসন ভেঙে পড়ল, পৃথিবীটা বাইপোলার থেকে ইউনিপোলার হয়ে গেল। নিও-লিবারালিজ়ম এসে গোটা মার্কেটটাকেই তছনছ করে দিয়েছে। ফলে এখন কারও কোনও আব্রু নেই। কারও কোনও আদর্শ নেই। কোনও ‘ইজ়ম’ আমাদের কাছে অবশিষ্ট নেই, যে ইজ়মটাকে আমি বলতে পারি এরা সাধারণ কিংবা গরিব মানুষের জন্য লড়াই করছে।
বলতে পারেন কীভাবে এই প্যান্ডেমিকের মধ্যে বড়লোকরা আরও বড়লোক হল? আর কীভাবেই বা গরিবরা আরও গরিব হল? আমাদের দেশেই তো সেটা হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। এতগুলো পরিবারের রোজগার বেড়ে গেল কীভাবে? এটা কিন্তু গোটা পৃথিবীতেই হয়েছে। মানুষের আয় কমেছে। চাকরি চলে গিয়েছে। শিক্ষা নেই। বসে গিয়েছে সবটা। এই যুদ্ধের ফলেও তাই-ই হবে। যুদ্ধতে বড়লোকদেরই লাভ হবে। যেমনটা প্রতিবার হয়। অস্ত্র বেচাকেনা যে একটা ব্যবসা, সেটা আমরা জেনে গিয়েছি। বেচাকেনা করতে গেলে তো যুদ্ধ বাঁধাতেই হবে!
এই বিষয়টি নিয়েই আমি একটি নাটক করেছিলাম আমারই দল ‘স্বপ্নসন্ধানী’তে। অসামান্য সেই নাটক। বের্টল্ট ব্রেখটের ‘মাদার করেজ’। ‘নির্ভয়া’ নাম দিয়ে নাটকটা আমরা করেছিলাম! বার বার সেই নাটকের কথাই মনে হচ্ছে…
(মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত)