পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরীই এল আমার ঘরে: পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Saraswati Puja: আর একটু বয়সে যখন বাড়ির পুজো হত, তখন দেখতাম, যে বিষয়ে কেউ দুর্বল, সেই বিষয়ের বই-ই সরস্বতীর পায়ের কাছে রেখে দিত। আমি ভাবতাম, আরিব্বাস! পায়ের কাছে বই রেখে দিলেই আর পড়তে হবে না। পড়াশোনায় আমি খুব বাজে ছিলাম।

পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরীই এল আমার ঘরে: পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
Follow Us:
| Updated on: Feb 15, 2024 | 4:27 PM

সরস্বতী পুজো এলে কিছুই করার ছিল না আমার… কারণ কৈশোরের বিরাট একটা অংশ রাস্তা দিয়ে খালি পায়েই হেঁটেছি আমি। পয়সা কড়ি নেই। বই কেনারই পয়সা নেই, তো… সরস্বতীর সঙ্গে আসলে আমার একটা ফ্রিকশন ছিল ছোট থেকেই। ভাল ছাত্র ছিলাম না তো, তাই আমায় ভাল চোখে দেখত না। তারপর যখন শৈশব-উত্তীর্ণ কৈশোর, তখন একটু বন্ধুত্ব হয়েছিল বটে। বাড়ির লোকেদের বকাবকিতে সেই ছেলে বসেও পড়েছিল অঞ্জলি দিতে। কিন্তু পুরুত যখন মন্ত্র পড়েন, তখন এ দিক-ও দিক তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসি। মিমিক্রি করে বলতে থাকি, মাঝেমধ্যে পুরোহিত মাথা ঘুরে তাকান আমার দিকে! সে এক কাণ্ড…

আর একটু বয়সে যখন বাড়ির পুজো হত, তখন দেখতাম, যে বিষয়ে কেউ দুর্বল, সেই বিষয়ের বই-ই সরস্বতীর পায়ের কাছে রেখে দিত। আমি ভাবতাম, আরিব্বাস! পায়ের কাছে বই রেখে দিলেই আর পড়তে হবে না। পড়াশোনায় আমি খুব বাজে ছিলাম। কারণ, আমার বইপত্র জোগাড় করে পড়ার মতো অবস্থাই ছিল না। এরপর কলেজে ভর্তি হলাম। সবাই ভর্তি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমি ভর্তি হলাম একমাস পর। কেন জানেন? ভর্তি হওয়ার টাকাই ছিল না, কী মজা!

এবার আসি প্রেমের কথায়। একজন যুবক আর একজন যুবতীর প্রতি আকর্ষিত হবে, সেটা জবরদস্ত কোনও খেলা নয়। একেবারে প্রাকৃতিক উপাদান। কিন্তু অভিজ্ঞ মানুষেরা কী বলেছেন, জানেন? নারীর যত তুমি কাছে যাবে, আবদার করবে, ‘আমি তোমার’, ‘আমি তোমার’ করবে, বুদ্ধিমতী নারী কিন্তু এটা একেবারেই ভাল চোখে দেখে না। আদেখলে বলে দাগিয়ে দেয়। কলেজে উঠে দেখা গেল ৬০টি ছেলের মধ্যে একটি ছেলে (আমি) বড়ো গম্ভীর, দেখতেও ভাল। কিন্তু কথা কম বলে। ব্যস, কেল্লাফতে! সবাইকে ফেলে দিয়ে কিছু আকর্ষণ তাঁর দিকেই আসতে লাগল ক্রমাগত। তারপরে হল কী! কথা তো বলতে পারছে না। এ দিকে কৌতূহলও বাড়ছে। কে রে ছেলেটা? দারুণ ছবি আঁকে, তবে যেন বড্ড বেশি দাম্ভিক। এ দিকে ওই ছেলেটাও যে জানে, নিজের গুনাগুণ দিয়ে যত বেশি মেয়েদের উপেক্ষিত করা যায়, ততই এই আকর্ষণ অমোঘ হয়—জালে কিন্তু পড়বেই। বুদ্ধিমান ছেলে তো, লেখালিখিও করে।

ছেলেটির অবসারভেশন (এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা) কিন্তু দারুণ ছিল। যা দেখত, তাই-ই নকল করত। এবার হল আর এক কাণ্ড! পাড়ার মধ্যে যে মেয়েটি সবচেয়ে সুন্দরী, এক্কেবারে সেই দুধে আলতা রঙ, মাথা-ভর্তি চুল, একটু ছোটখাটো… এই ছেলেটি যখন শৈশব-উত্তীর্ণ কৈশোরের সন্ধিক্ষণে, তখন সেই মেয়েটির সঙ্গে পাড়ায় একসঙ্গে খেলাধুলো করত। তখন তো দু’জনেই ছোট। তবে অনুভূতির মধ্যে যে হালকা শিহরণ, কম্পন, তা বুঝতে পারা গেল কলেজে ওঠার পর।

সেই ছেলেটি কলেজ পাশ করল। চাকরি পেল। ঘটনাচক্রে হল কী, সেই মেয়েটিই তার ঘরে এল! পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী, সেই মেয়েই এল আমার ঘরে। অনেকেই ইট পেতে ছিল-টিল। কিন্তু মাঝখান থেকে… হা হা হা! ছেলেটি আর্থিক ভাবে অস্বচ্ছন্দ ছিল বলে স্বপ্ন সেভাবে দেখেনি। কিন্তু কিছু স্বপ্ন আপনিই এসে সামনে দাঁড়াত। আবার সেই স্বপ্নই যখন বুদবুদের মতো উবে যেত, হঠাৎই কষ্ট হত খুবই। এসবের মধ্যে ছেলেটা থিয়েটারটা কিন্তু মোটে ছাড়েনি। আর থিয়েটারটা করত একটা আদর্শের উপর ভিত্তি করেই, সেই জন্যই তার ভাবনা-চিন্তাও খানিক ছিল স্বচ্ছ। যা পাব, তাই খাব—ক্ষুন্নিবৃত্তি এভাবে মেটাতে সে শেখেনি। আর ছোট থেকেই যে, সে লক্ষ্মীছাড়া। তাই লক্ষ্মীর প্রতি আকর্ষণই তার জন্মাল না। ও দিকে ছেলেটির সরস্বতীর প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকল। প্রবন্ধ থেকে গান লেখা—তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে ঘিরে গড়ে উঠতে লাগল ক্রমশ। ছেলেটি লক্ষ্মীকে উপেক্ষা করত খুউব। কিন্তু লক্ষ্মী তার আদরের বোন সরস্বতীকে খুব ভালবাসে। আমি সরস্বতীকে ভালবাসছি দেখে সে-ও আর আমায় বেশিদিন ছেড়ে থাকতেই পারল না। একদা খালি পায়ে ঘোরা ছেলেটার সব হল। কিন্তু কেউ যদি মনে করে, লক্ষ্মীকে পাওয়ার জন্য সরস্বতীর সঙ্গে ফ্লার্ট করবে, তাহলে কিন্তু লক্ষ্মী মুখ ফিরিয়ে নেবেই নেবে! কলেজে কাউকে পাত্তা না-দেওয়া সেই ছেলেটির জন্যও কি তাঁর ঘরের লক্ষ্মী ছাড়া অপেক্ষা করেছিল কেউ কোনওদিন? একজন প্রশ্ন করেছিল একবার। উত্তরে বলেছিলাম, “ওই ছেলেটি একবার এক চাঁদ দেখে ফেলেছে না, তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে হাজার চাঁদ খুঁজলেও সে পাবে না। নজরেই যে পড়েনি কোনওদিন… সারাটা জীবন—ওই একটাই চাঁদ কাফি হ্যায়।”

(অনুলিখনের ভিত্তিতে লিখিত) অনুলিখন: বিহঙ্গী বিশ্বাস