দিনপিছু ২০০ টাকা থেকে আজ ৫ হাজার, কেমন আছেন টলিপাড়ার পোশাক ডিজাইনাররা

Costume Designer Untold Story: চিত্রনাট্যে চরিত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাঁরা সেলেবদের চেনা ছক ভেঙে নতুন রূপ দান করেন, সেই সকল শিল্পীরাই থেকে যান আড়ালেই। অথচ, তাঁদের তুলির টানে, কিংবা পোশাক ডিজাইনের মুন্সিয়ানায় অভিনেতারা অনায়াসে হয়ে ওঠেন, রূপকথার চরিত্র। শ্রমিক দিবসে তাই TV9 বাংলা এমনই শিল্পীদের হালহকিকত জানতে কান পাতল টলিপাড়ায়।

দিনপিছু ২০০ টাকা থেকে আজ ৫ হাজার, কেমন আছেন টলিপাড়ার পোশাক ডিজাইনাররা
Follow Us:
| Updated on: May 01, 2024 | 4:37 PM

জয়িতা চন্দ্র

সিনেমা হোক বা সিরিয়াল, দর্শকদের কাছে পর্দার বিনোদন মানেই নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা আর পরিচালকেই বিষয়টা সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। অথচ ক্যামেরার পিছনে যে বিশাল এক দক্ষযজ্ঞ প্রতিটা মুহূর্তে চলতে থাকে, তা এক কথায় বলতে গেলে অনেকেরই অজানা। সেলিব্রিটিদের দেখে অনেকেই দর্শক আসন থেকে প্রশংসা করে বসেন, ‘স্টাইলটা দারুণ’, ‘লুক অনবদ্য’ কিংবা অমুকের ‘ফ্যাশন সেন্স (জ্ঞান) অসাধারণ’। আদপে যা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিজস্ব নয়। চিত্রনাট্যে চরিত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাঁরা সেলেবদের চেনা ছক ভেঙে নতুন রূপ দান করেন, সেই সকল শিল্পীরাই থেকে যান আড়ালেই। অথচ, তাঁদের তুলির টানে, কিংবা পোশাক ডিজাইনের মুন্সিয়ানায় অভিনেতারা অনায়াসে হয়ে ওঠেন, রূপকথার চরিত্র। শ্রমিক দিবসে তাই TV9 বাংলা এমনই শিল্পীদের কুর্ণিশ জানাতে কান পাতল টলিপাড়ায়।

পোশাক শিল্পী, বা পোশাক ডিজাইনার, চরিত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাঁরা প্রতিটা মুহূর্তে বুঁনে চলেছেন নতুন নতুন গল্প। যে গল্প রয়েছে একাল-সেকালে মস্ত ফারাক। টলিপাড়ায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন কস্টিউম ডিজাইনার শিবপ্রসাদ মাইতি, ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি জনপ্রিয় শিবা নামেই। যবে থেকে তাঁর হাঁটা শেখা, তবে থেকে গ্রামের এক পরিচিতের (শঙ্কর জানা, ইন্ডাস্ট্রির বড় পোশাক সাপ্লাইয়ার) হাত ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখা। পোশাক ইস্ত্রি করে কখনও পৌঁছে দিয়েছেন অমিতাভ বচ্চনের ঘরে, কখনও আবার পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের নির্দেশনায় চরিত্রদের সাজিয়েছেন মনের মতো করে। সুরিন্দর ফিল্মস, এসভিএফ থেকে শুরু করে দক্ষিণভারত, তাঁর বিস্তার বিস্তর। আর সেই অভিজ্ঞতাই তিনি এবার ভাগ করে নিলেন TV9 বাংলার সঙ্গে।

আগে সত্যি বিষয়গুলো এতটা সহজ ছিল না। কারণ কাজ, টাকা। এত কাজ আগে হতো না। টাকাও ছিল কম। বর্তমানে কাজ আছে, ভাল  টাকাও আছে। আমার মনে আছে আমি এই কাজ করে দিনপিছু ২০০ টাকাও পেয়েছি। আর এখন, কখনও ৫ হাজার, কখনও ১০ হাজার। শুধু কি তাই, তখন অনেক সমস্যারই সম্মুখীন হতেন আমাদের গুরুজনেরা, আমিও দেখেছি, তখন কোনও ডিজাইনার ছিলেন না। ফলে কস্টিউম সাপ্লায়ার নিজেই শুনতেন চিত্রনাট্য। সেই অনুযায়ী স্থির করতেন, কীভাবে সবটা সাজানো যায়। এখন যেমন আমাদের সঙ্গে অনেক ডিজাইনার যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা ভাল কাজও করছেন।

আপনাদের পেশায় মূল চ্যালেঞ্জ কী?

শিবা– সময় মতো সঠিক কাজটা দেওয়া যে কোনও পেশার চ্যালেঞ্জ। আমাদের যেমন একটু হাতের কাজ জানতে হয়। স্পটে গিয়ে ব্লাউজটা ধরুন ফিট হচ্ছে না। সেটাকে তখনই করে দেওয়া। কোনও প্রপ লাগবে, উপযুক্ত কাপড় নেই, সেটাকে বুদ্ধি করে তৈরি করে দেওয়া। ক্যামেরায় যেন কোনও ফাঁক চোখে না পড়ে। তারপরও কত কী ঘটে, একজনের পোশাক অন্যের কাছে, পোশাকের সাইজে সমস্যা, এগুলো তো হবেই। সেলিব্রিটিদের কোনও ওয়ারড্রব ম্যালফাংশন যেন না হয়, সেটা লক্ষ্য রাখতে হয়। যেমন নায়িকাদের ক্ষেত্রে ব্লাউজ। ব্রা দেখা যায়, ফ্লোরে দাঁড়িয়ে সেটা ম্যানেজ করাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই কাজগুলো আমাদের শিখতে হয়, জানতে হয়। আবার ভুলও হয়। আমার মনে আছে আমি সৃজিতদার ছবি (পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়) গুমনামী-তে প্রথম শটেই একটা ভুল করে ফেলেছিলাম, প্রসেনজিতের অর্থাৎ নেতাজির ইউনিফর্মের বুকের লোগোই উল্টো বানিয়ে ফেলেছিলাম। এমন অনেক ভুল হয়। ভুল হলে অনেকেই ভালবেসে বোকে দেন, শাসন করেন, তবে আমার ক্ষেত্রে কখনও তা অপমান বলে মনে হয়নি।

সময় মতো টাকা পেয়ে যান?

শিবা– নির্ভর করছে কোন প্রযোজনা, তাঁদের কেমন পরিস্থিতি তার ওপর। কখনও সাতদিনে পাই, কখনও একমাসে। সেটা কিছুটা সম্পর্কের ওপরও নির্ভর করে। দুটো টাকার জন্য খারাপ ব্যবহার করে সম্পর্ক নষ্ট করা মানে কাজের ক্ষতি। এই বিশ্বাসটা আমি রাখি, সমস্যা মিটলে নিশ্চয়ই আমার টাকা আমি পেয়ে যাব। হয়ও তাই। তবে এর জন্য গিল্ড কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল, স্বরূপদা, (স্বরূপ বিশ্বাস) জানিয়েল দিয়েছিলেন, কাজের সাত দিনের মধ্যে হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। আগে দেখতাম, ইউনিটের খাবার আলাদা, আমাদের জন্য হয়তো রাস্তার সস্তা বিরিয়ানি বা মাছ-ভাত চলে এল। উনি (স্বরূপ বিশ্বাস) নিয়ম করেছিলেন, খাবারটা যেন একটু ভাল দেওয়া হয়। যে খাবারটা আসবে সেটা সকলের জন্যে। দীর্ঘক্ষণ শুটিং চলে, শরীরের দিকটাও তো দেখতে হয়। এই কাজটা উনি সত্যি ভাল করেছেন।

পোশাকের ক্ষতি হলে তার দায় কার? 

শিবা– দেখুন পোশাকের খুব ক্ষতি হলে তা প্রযোজনা সংস্থা থেকে বহন করে, আর ছোটখাটো সমস্যা হলে, ওটা আমরা দেখে নিই। ওই যে বললাম, যার সঙ্গে যেমন সম্পর্ক, তার ওপর নির্ভর করে সবটা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্ক ভাল রাখার জন্যে ছেড়ে দিতে হয়।

টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে এতবছর কাজ করছেন, কেমন অভিজ্ঞতা?

শিবা– সত্যি ভাল। আমি জয়া প্রদা, সমিরা রেড্ডি বহু বলিউড সেলেবের সঙ্গে যেমন কাজ করেছি, তেমনই আবার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গেও কাজ করেছি। আমার মনে পড়ে, সাত পাকে বাঁধা ছবির শুটের সময়, হঠাৎ ফ্লোরে রাণে দা, জিৎ দা আমায় কাছে ডেকে বলেন, এই তোমার এত ছোট বয়স, কাজ করছ? লেখাপড়া করছ না? লেখাপড়া কর। এগুলো আমার কাছে অনেক অনেক বড় পাওয়া।

তাহলে আপনারা এখন অনেকটা ভাল আছেন, তাই তো…

শিবা– আগের থেকে সত্যি এখন অনেক ভাল আছি। আমাদের গিল্ড সেক্রেটারি ভীষণ ভাল মানুষ। অন্যান্য বিভাগের থেকে আমাদের বিভাগে অনেক বেশি কাজ হচ্ছে। সত্য়ি বলতে উনি এমন অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন যা আজ অন্যদের ভাবতে বাধ্য করছে।  কেউ যদি কোনও বিপদে পড়ে, সেখানেও তিনি সাহায্য করে থাকেন।

আর কী সুবিধে পেলে আপনাদের উপকার হয়? 

শিবা– প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা করা গেল খুব সুবিধে হত। এটা আমরাদের জন্য একটা উপকার তো বটেই। যদিও অনেক কিছুই করা হচ্ছে, এটা হলে ভাল হয়।

বাঁ দিকে শিবা, ডানদিকে রবিবাবু

এরপর TV9 বাংলা সরাসরি যোগাযোগ করে সিনে এণ্ড ভিডিয়ো কস্টিউম অ্যাসোসিয়েশনের সেক্সেটারি রবিবাবুর (রবি ভঞ্জ) সঙ্গে। ফোন ধরেই বিনয়ের সুরে তিনি স্পষ্ট বলেন, ”কিছু ভাল করার চেষ্টা করছি মাত্র। কেবল আমি নই, আমরা সকলেই এই চেষ্টা করে চলেছি। যাতে ছোট ছোট সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়।” 

আপনাদের উদ্যোগের তালিকায় নতুন কী কী সংযোজন হয়েছে? 

রবি ভঞ্জ– সত্যি বলছি, আমি যখন শুরু করি, এতটা তো কাজ হতো না। দরও কম ছিল। টাকাও কম ছিল, সবটা গুছিয়ে করে ওঠা সম্ভবপর ছিল না। তারপর সদস্য বাড়ায় আমরা ইউনিয়নের কিছুটা ক্ষমতা হয়, কাজ বাড়ে, ফলে টাকাও বাড়ে। এরপর ধীরে  ধীরে আমরা যখন যুক্ত হই, কিছু বদল আনার চেষ্টা করি। নিজস্ব একটা অফিস করি। চেষ্টা করি বয়ষ্কদের জন্য একটা পেনশন চালু করার। করেছিও। কেউ যখন আর কাজ করতে পারছেন না, তাঁকে এককালিন কিছু টাকা দেওয়ার চেষ্টা করি। ওই চাঁদা থেকে যা পাই, তাই হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করি।

নতুন কেউ আপনাদের সঙ্গে যুক্ত হাতে চাইলে কী করতে হয়? 

রবি ভঞ্জ– কিছুই না, কাজ করতে চাইলেই করতে পারেন। তবে কটা জিনিসে এখন আমরা নজর রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের পেশায় কিছু কাজ শিখতে হয়। বিশেষ করে সেলাই করা, পোশাকের খুটিনাটিগুলো জানা। সেগুলো শেখানো হয়। এখন লেখাপড়ার দিকটায় একটু নজর দিচ্ছি। অন্তত মাধ্য়মিক পাশ, উচ্চমাধ্যমিক পাশ, হলে ভাল হয়। লেখাপড়াটা ভীষণ প্রয়োজন। ডিলারদের সঙ্গে কথা, চুক্তি করা, এগুলো করতে হয়। আমরা কিছু বাইরের ছেলেও নিয়েছি। তবে কলকাতার ছেলে মেয়েদের ভীষণ চেষ্টা রয়েছে। আমরাও সাহায্য করার চেষ্টা করি।

মুম্বইয়ের কাজ কলকাতায় হলে, কনট্র্যাক কি আপনারাই পান? 

রবি ভঞ্জ– পাই, নির্ভর করে ডিজাইনারের ওপর। অনেক সময় ওদের ডিজাইনার থাকেন, আবার কেউ কেউ কলকাতার ডিজাইনারের সঙ্গে চুক্তি করে আসেন। কলকাতায় এখন খুব ভাল কাজ হচ্ছে পোশাকের ওপর। তখন আমরাই পেয়ে থাকি। প্রতিটা ডিভিসন, প্রতিটা গিল্ডকে ভীষণ সাপোর্ট করে।