ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ (Heart Disease) এখন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ মানেই তা দৈনন্দিন কর্মক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। মার্কিন মুলুকের এন ওয়াই ইউ গ্রসম্যান স্কুল অব মেডিসিনের মেডিসিন বিভাগের ক্লিনিকাল ইনস্ট্রাকটর ডাঃ জেনিফার চাও তাঁর ‘ইট দিস নট দ্যাট’ বইয়ে তাঁর আশঙ্কা জাহির করেছেন। সমগ্র বিশ্বে, প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ হার্টের রোগের কারণে প্রাণ হারাচ্ছেন। অবহেলিত বা অনির্ণীত হার্টের রোগ একজন ব্যক্তিকে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের মতো সমস্যার দিকে ঠেলে দেয়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বেশিরভাগ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের প্রকোপ (বিশেষত করোনারি আর্টারি ডিজিজ এবং স্ট্রোক) সাধারণত মধ্যবয়সি এবং বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়।
অথচ এখন অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস শুরু হচ্ছে শিশুকাল থেকেই এবং ১২ থেকে ১৯ বছরের বয়ঃসন্ধিকালের বাচ্চাদের কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের হালও খুব খারাপ বলেই দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ কমবয়সিরা কী খাওয়া উচিত আর কী নয় সেই বিষয়ে জানে না। একইসঙ্গে তাদের মধ্যে শরীরচর্চায় অনীহা দেখা যাচ্ছে। তারা স্ট্রেসেও ভুগছে আগের চাইতে অনেক বেশি।
ডাঃ জেনিফার চাও জানিয়েছেন, আমেরিকায় প্রাথমিকভাবে হার্ট ডিজিজের ঘটনা কম ঘটতে দেখা যাচ্ছে কারণে ধূমপানের অভ্যেসে অনেকটাই লাগাম পরানো গিয়েছে। এছাড়া রক্তে উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরলেরও চিকিৎসা এখন আছে। অথচ কার্ডিওভাসকুলার ডেথ-এর সংখ্যা এখন অনেকটাই বেড়েছে। আর তার কারণ বৃদ্ধি ঘটেছে ডায়াবেটিস এবং স্থূলত্বে ভোগার মতো সমস্যার। ডাঃ চাও-এর মতে কমবয়সে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে হলে ৬টি বিষয়ে নজর দিতে হবে।
১) উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল: শরীরের নানাবিধ কাজকর্ম চালাতে স্বল্পমাত্রার কোলেস্টেরল দরকার পড়ে। তবে আমরা মাত্রা বুঝি না বলে শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়েই তুলি। এখন প্রশ্ন হল এই বাড়তি ফ্যাট যায় কোথায়? অবশ্যই এই ফ্যাট আমাদের রক্তে মেশে। এরপর রক্তবাহী নালীর গাত্রে জমা হতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রার বৃদ্ধি ঘটলে তা হার্টের রোগের কারণ হতে পারে। এছাড়া রক্তবাহী নালিতেও তা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ফ্যাটনির্ভর খাদ্য যেমন ভাজাভুজি, মাখন, চিজ বেশি মাত্রায় খেলে, ট্রান্স ফ্যাট দেওয়া খাদ্য যেমন চিপস, নাগেটস বেশি খেলে ও ধূমপান করলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে। এক্ষেত্রে ধূমপান ছাড়তে হবে। ভাজাভুজিও খাওয়া যাবে না। বাদ দিতে হবে চিজ, মাখন। একইসঙ্গে তেলের জন্য নির্ভর করতে হবে উদ্ভিজ্জ তেল যেমন অলিভ অয়েল, ক্যানুলা অয়েল ইত্যাদির উপর।
২) উচ্চ রক্তচাপ: নিঃশব্দ ঘাতক হল হাইপারটেনশন। আমাদের হার্ট যে পরিমাণ রক্ত পাম্প করে করে তার মাত্রার পরিবর্তন হতে পারে পরিস্থিতি অনুসারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একটি কুকুর তাড়া করলে আপনাকে ছুটে পালাতে হবে। ছুটতে হলে শরীরে অক্সিজেনের প্রয়োজনও বেড়ে যায়। তাই দৌড়ানোর সময় আমাদের হার্টকে তখন অনেক বেশি দ্রুতগতিতে পাম্প করতে হবে যাতে ফুসফুসে ও পেশিতে দ্রুত অক্সিজেন পৌঁছয়। এই সময় আমাদের রক্তবাহী নালীগুলি দ্রুত প্রসারিত হয়ে পড়ে। তবে কোনও ব্যক্তির উচ্চ রক্তচাপ থাকলে রক্তবাহী নালীগুলি প্রসারিত হতে পারে না। ফলে রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে ঘটতে পারে বিপদ। তাই রক্তচাপ বেড়ে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এছাড়া নজর দিন নুন খাওয়ার দিকে। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে একেবারেই বেশি নুন খাওয়া যাবে না। এছাড়া একটানা উৎকণ্ঠায় ভুগলেও ঘটতে পারে বিপদ। সেক্ষেত্রেও বেড়ে যেতে পারে রক্তচাপ। একটানা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে হার্টকে রক্ত পাম্প করার জন্য অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। ফলে হার্টের পেশির বৃদ্ধি ঘটে। অতএব উদ্বেগে ভুগলে ধ্যান, যোগাসন করুন। উৎকণ্ঠার সঙ্গে লড়তে সুবিধা হবে। এছাড়া কমাতে হবে খাদ্যে নুনের ব্যবহার।
৩) ডায়াবেটিস এবং স্থূলত্ব: টাইপ ১ ডায়াবেটিস জন্মগত সমস্যা। অন্যদিকে টাইপ ২ ডায়াবেটিস কিন্তু হয় অনিয়ন্ত্রিত জীবনশৈলীর কারণে। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের আশঙ্কা দ্বিগুণ করে দেয় ডায়াবেটিস। এছাড়া দেখা দিতে পারে কিডনি ফেলিওর, নার্ভের সমস্যা এবং অন্ধত্ব। ডায়াবেটিসের কারণে সময়ের সঙ্গে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়লে তা নার্ভ এবং রক্তবাহী নালীর ক্ষতি করে। এই কারণে আমাদের উচিত ডায়েটে সুগারের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া উচিত। সুগারকে সাদা বিষ বলা হয়। তাই আলাদা করে ডায়েটে বেশিমাত্রায় চিনি যোগ করলে তা শেষ পর্যন্ত ওজনবৃদ্ধি এবং স্থূলত্বের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। ওজন বাড়ার অর্থ হল শরীরের অন্দরের বিভিন্ন অঙ্গে ফ্যাট যোগ হতে থাকে যাকে ভিসেরাল ফ্যাট বলে।
উচ্চ মাত্রার সুগারযুক্ত খাদ্য বাড়িয়ে তোলে স্থূলত্ব, প্রদাহ, এবং রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডস-এর মাত্রা। ব্লাড সুগার এবং ব্লাড প্রেশারের মাত্রা বাড়লেই কিন্তু বাড়তে শুরু করে হার্ট ডিজিজের আশঙ্কা।
৪) অস্বাস্থ্যকর ডায়েট: রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে বা বাড়িতে খাবার আনিয়ে খাওয়ার সময় আমরা একবারের জন্যও খাদ্যটির গুণমান নিয়ে চিন্তা করি না। আমাদের কতজন আছেন যাঁরা বাড়তি চিজ, বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিংবা ফ্রায়েড চিকেন, বিরিয়ানি, পিজ্জা, পেস্ট্রি ভালোবাসেন না? অথচ জানলে অবাক হবেন, এই ধরনের খাদ্যই বাড়িয়ে তুলছে আপনার হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। অথচ ফল এবং ভেজিটেবল যা আমরা ছুঁয়ে দেখতেও অস্বীকার করি, সেই ধরনের খাদ্য আমাদের হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। এছাড়া মাছ, গম, বাদাম এবং সবজিসমৃদ্ধ ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য কিন্তু হার্টের স্বাস্থ্য উন্নত করতেই সাহায্য করে।
৫) কাজের উৎকণ্ঠা: পরীক্ষা, পরিবার, কর্মস্থল, খরচ, সঞ্চয় নিয়ে আমরা সকলেই সর্বদা দুশ্চিন্তায় ভুগি। লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলার জন্য সামান্য মাত্রার স্ট্রেসের প্রয়োজন হয় বইকি। তবে একটানা স্ট্রেসে ভোগা, তার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ, ধূমপান, শরীরচর্চায় অনীহা ডেকে আনতে পারে চরম বিপদ। সঠিকভাবে উদ্বেগ সামলাতে না পারলে তা কিন্তু ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই স্ট্রেস কাটাতে করুন এক্সারসাইজ। এমনকী থেরাপির সাহায্যও নিতে পারেন।
৬) অলস জীবনযাত্রা এবং শরীরচর্চায় অনীহা: কোভিড মহামারীর কারণে বহু দেশে ওয়ার্ক ফ্রম হোম প্রথা চালু হল। ঘরে বসে কাজ করতে গিয়ে বহু মানুষই হয়ে উঠলেন অলস। অথচ যখন বাড়ি থেকে বহু দূরে কর্মস্থলে যোগদান করতে হতো, তখন তাঁরা শারীরিকভাবে অনেক বেশি সক্রিয় ছিলেন। ওয়ার্ক ফ্রম হোম কালচারে ধীরে ধীরে অনেকেই স্থূল হয়ে পড়লেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিট থাকতে হলে আমাদের কিন্তু সপ্তাহে ১৫০ থেকে ১৮০ মিনিট মাঝারি থেকে ভারী মাত্রায় শরীরচর্চা করতেই হবে। দীর্ঘ সময় বসে থাকার সঙ্গে ধূমপানের কিন্তু কোনও তফাৎ নেই। তাই যাঁরা এখনও শরীরচর্চার ব্যাপারে দোনামনা করছেন তাঁরা আসলে হার্ট ডিজিজকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। সবচাইতে বড় কথা এক্সারসাইজ করতে না পারেন, অন্তত প্রতিদিন হন হন করে ঘাম ঝরিয়ে হাঁটুন ৪০ মিনিট। সপ্তাহে পাঁচদিন। ভালো থাকবেন।