নারী স্বাস্থ্য, মেন্সট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে অনেক তো আলোচনা হয়। আদতে তা ঠিক কতখানি ফলপ্রসূ হয়েছে, এই উত্তর খুঁজতে বেরোলে কিন্তু মনে খানিকটা ধোঁয়াশা নিয়েই ফিরতে হয়। বিশেষ কোনও এক দিন নয়, রোজ কথা হোক মহিলা স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা বিষয়ে। কারণ মহিলাদের স্বাস্থ্য এখনও উপেক্ষিতই। তার দায় যদি কিছুটা মহিলাদের থাকে, বাকি দায়ভার কিন্তু রয়েছে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতেও। রয়েছে স্বাস্থ্য-সুরক্ষা বিষয়ে প্রচারের অভাবও। এখনও মহিলারা জনসমক্ষে নিজের শারীরিক সমস্যার কথা বলতে কুন্ঠাবোধ করেন। স্যানিটারি ন্যাপকিন সহজলভ্য হলেও সকলেই যে তা কিনছেন এবং সঠিক ব্যবহার জানছেন, এমন কিন্তু নয়। এ ব্যাপারে শুধু গ্রাম নয়, শহরের মেয়েদের মধ্যেও রয়েছে উদাসীনতা। ন্যাপকিনের যথাযথ ব্যবহার জরুরি। আর তা না হলে সেখান থেকে মেয়েদের শরীরে জাঁকিয়ে বসতে পারে একাধিক সংক্রমণ। যতই কাস্টমাইজ়ড স্যানিটারি ন্যাপকিন বাজারে আসুক না কেন, কোনও প্যাডই ৬ ঘন্টার বেশি সুরক্ষা দিতে পারে না।
প্রতি বছর ২৮ মে দিনটি World Menstrual Hygiene Day হিসেবে পালন করা হয়। সচেতনতা প্রসার একমাত্র উদ্দেশ্য হলেও কোথাও যেন ঘাটতি থেকে যায়। ইউনিসেফ (UNICEF)-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে প্রতি মাসে বিশ্বজুড়ে ১ কোটি ৮ লক্ষ মেয়ের মেন্সট্রুেশন শুরু হয়। তবে এই তালিকায় মেয়েরা ছাড়াও ট্রান্স পুরুষরাও কিন্তু রয়েছেন। ঋতুস্রাব শুরু হওয়া মানে কিশোরীমনে একটি নতুন পর্যায় এবং নতুন দুর্বলতা। কিছু জনের ক্ষেত্রে ভাল লাগাও বলা যেতে পারে। তবে মাসিকের পর মেয়েদের সামাজিক ভাবে এখনও অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। যে মেয়েটা আগে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকলের সঙ্গেই খেলে বেড়াত, হঠাৎ করেই তার খেলা বন্ধ হয়ে যায়। মা বাড়ি থেকে বেরোতে দেয় না। এরকম এখনও অনেক জায়গা আছে, যেখানে ওই দিনগুলোতে ঠাকুরঘর থেকে রান্নাঘর কোথাও মেয়েদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। কারণ হিসেবে বলা হয় একদিন মেয়েরা অশূচি থাকেন। একই সঙ্গে সমস্যায় পড়েন ট্রান্স-পুরুষরা। কারণ কেউই তাঁদের অসুবিধের দিকটি ভেবে দেখেন না। বরং বারবার তাঁদের পড়তে হয় নানা সমস্যায়। লিঙ্গ পরিচয়ের কারণেই বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাঁদের। এখনও মেয়েদের প্রয়োজনমত শৌচাগার নেই আমাদের দেশে। সব সময় যে তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, তা-ও কিন্তু নয়। এছাড়াও দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই তো রয়েইছে। বর্তমানে বিভিন্ন স্কুলে মেন্সট্রুয়েশন নিয়ে বিশেষ ক্লাসের উদ্যোগ নেওয়া হলেও যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কিন্তু তেমন কোনও আলোচনা হয় না।
বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় সব স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রস্তুতকারী সংস্থাই এগিয়ে থাকতে চায়। কেউ কাউকে এক ফোঁটা জায়গা দিতে নারাজ। কেউ কথা বলেন সারারাতের সুরক্ষা নিয়ে, আবার কেউ সফট্নেস নিয়ে। যতই রক্তপাত হোক, তবুও ভিজবে না প্যাড- এরকম আশ্বাসবাণীও দিয়ে রাখে বিভিন্ন সংস্থা। বর্তমানে কাস্টমাইজ়়ড ন্যাপকিনও এসেছে বাজারে। অর্থাৎ মেয়েরা তাঁদের পছন্দমতো প্যাড কাস্টমাইজ় করে নিতে পারবেন সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছ থেকে। নিজের সাইজ় এবং ফ্লো অনুযায়ী প্যাড বেছে নিতে পারবেন।
স্যানিটারি ন্যাপকিনকে কাস্টমাইজ় করার ভাবনা কতটা সদর্থক? এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল ‘কলকাতার প্যাডম্যান’ শোভন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শোভন বলেন, ”মেন্সট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে অধিকাংশ শহরের মেয়েরাই এখনও পর্যন্ত সচেতন নন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্যাড বদলান না। ন্যাপকিনের মূল উপকরণ হিসেবে থাকে Saapgel, যা একরকম রাসায়নিক। আর এই রাসায়নিক বেশিক্ষণ শরীরের মধ্যে থাকলে অ্যালার্জি, র্যাশের সমস্যা থেকে যায়। এই একই উপকরণ থাকে বাচ্চাদের ডায়াপারেও। তাই বাচ্চাদের ন্যাপি র্যাশের সমস্যা হয়। যে কারণে ডায়াপার ৬ ঘন্টার বেশি রাখতে বারণ করা হয়, যা ন্যাপকিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে বিজ্ঞাপনী প্রচারে বলা হয় না” শোভন আরও বলেন, ”ন্যাপকিনের থেকে ১৮ শতাংশ জিএসটি তুলে নেওয়া হলেও দাম বেড়েছে ন্যাপকিনের কাঁচামালের। ন্যাপকিন তৈরির প্রধান ৯ উপাদানের মধ্যে সবক’টিতেই কিন্তু জিএসটি দিতে হয়। ফলে মূল্যবৃদ্ধির বাজারে চাল-ডাল-আলু-তেলের সঙ্গে এবার ঢুকে যাবে স্যানিটারি ন্যাপকিনও। তবে মুশকিল হল এ বিষয়টি নিয়ে মেয়েরাই সচেতন নন। কারণ অধিকাংশ মেয়ে তা জানেন না। ফলে মেয়েদের তরফ থেকেও প্রতিবাদ আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।”
আমাদের দেশের মেয়েরা যে এখনও মেন্সট্রুয়াল হেলথ নিয়ে সচেতন নন, একথা স্বীকার করে নিয়েছেন শোভন। তাঁর মতে, ”এক্ষেত্রে কিছুটা দায়ী সরকারও। মেয়েদের জন্য পরিষ্কার শৌচাগারের অভাব রয়েছে। ন্যাপকিন হাতের সামনে পেলেও তার যথাযথ ব্যবহারবিধি অনেকেই জানেন না। আর গ্রামের দিকে মেয়েদের কোনও শারীরিক সমস্যা হলে স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞদের হাতের সামনে পান না। ফলে সমস্যাও চাপা পড়ে যায়, যা পরবর্তীতে জটিল আকার নেয়। আর যাই-ই হোক, বাড়িতে বসে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানানো যায় না। ন্যাপকিন বানানোর জন্য উন্নত প্রযুক্তি এবং মেশিন লাগে। বাড়িতে বানানো প্যাডকে মেটারনিটি প্যাড বলা যায়, স্যানিটারি ন্যাপকিন নয়।”
”ন্যাপকিন কাস্টমাইজ় করা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। কোনও ন্যাপকিনই ১২ ঘণ্টার সুরক্ষা দিতে পারে না। বাস্তবে তা হয় না। এটা জানতে হবে মেয়েদেরই”, বলেছেন শোভন। প্রতিটি ন্যাপকিনের প্যাকেটেই নির্দিষ্ট সাইজ় লেখা থাকে। তবে তা অধিকাংশ মেয়েরই নজর এড়িয়ে যায়। এখনও প্রকাশ্যে পিরিয়ড ও প্যাড নিয়ে কথা বলতে মেয়েরা সঙ্কোচ বোধ করে। সম্প্রতি ‘দুয়ারে স্যানিটারি প্যাড’-এর উদ্যোগ নিয়েছেন শোভন। উদ্দেশ্য, ৫ কোটি প্রান্তিক মহিলাকে সুলভে প্যাড পৌঁছে দেওয়া। শুধু তা-ই নয়, প্যাকেটে লেখা থাকছে নারী ও শিশুপাচার থেকে বাঁচার সাবধানবাণী এবং হেল্পলাইন নম্বর। বাল্য বিবাহ এবং শিশুশ্রম রুখতে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে, প্যাকেটে তা-ও লেখা রয়েছে।
গুজরাতের একটি প্যাড প্রস্তুতকারক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে শোভনের ‘মা ফাউন্ডেশন’। ওই সংস্থাই নিজ উৎপাদন ব্যয়ে শোভনের কাছে প্যাড পাঠিয়ে দেয়। রাজ্যের ১২০টি লোকাল ইউনিট তা প্যাক করে পৌঁছে দেবে ঘরে-ঘরে। কাদের কাছে ‘মা’ পৌঁছবে, সেই তালিকাও বেশ চমকপ্রদ।