TV9 বাংলা ডিজিটাল: ক্লাব ফুটবলে দল পরিবর্তন রোজকার ঘটনা। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে চট করে জার্সি বদলে ফেলা অতটাও সহজ ব্যাপার ছিল না। অন্তত একটা সময় পর্যন্ত। বিগত এক দশকে ধরে ভারতের রাজনীতির নতুন ট্রেন্ডই হচ্ছে, ‘অন্যের ঘর ভেঙে নিজের বাড়ির দেওয়াল শক্ত করো’। গড়পড়তা কোনও দলই এই সংস্কৃতির বাইরে নেই।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে বঙ্গ রাজনীতিতেও জার্সি বদলের ঘটনা ঘটেছে অহরহ। তবে ইদানীং সবুজ (পড়ুন তৃণমূল) ছেড়ে গেরুয়া (পড়ুন বিজেপি) পোশাক পরার আগ্রহই যেন সবথেকে বেশি (TMC To BJP)। গত লোকসভা ভোটের আগে থেকে নিয়ে এখনও পর্যন্ত একের পর এক শিবির বদল প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্যবাসী।
তবে একাধিক দলবদলের পর একটা বিষয় প্রত্যেকের নজর কেড়েছে। তা হল জার্সি বদলে দলে যোগদানকারী নেতা যত বড় নামই হোক না কেন, তাঁকে বিজেপি প্রথমেই ‘সাপের পাঁচ পা’ দেখতে দিচ্ছে না। নিজেকে প্রমাণ করতে হচ্ছে, তবেই মিলছে সম্মানজনক কোনও পদ। আবার কিছু নেতা তো বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলেছেন। তবে এখনও বসে রয়েছেন নিষ্ক্রিয় হয়ে। কেউ বা শূন্য মুখে ফের পুরনো ঘরেই ফিরেছেন।
প্রসঙ্গ উত্থানের কারণ একটাই। রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) গতকালই মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন, তিনি কয়েকদিনের মধ্যেই সবুজ জার্সি ছেড়ে গেরুয়া নামাবলি গায়ে চাপাতে পারেন। এই অবস্থায় একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক দল বদলে এখনও পর্যন্ত কতটা কী করে উঠতে পেরেছেন জার্সি পাল্টে ফেলা নেতা বা নেত্রীরা।
ক্রিকেটের ভাষায় ওপেনিং ব্যাটসম্যান বলতে যা বোঝায়, মুকুল রায় ছিলেন সেটাই। সিবিআই-ইডির ঘনঘন ডাকের মাঝেই ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরে গিয়ে গায়ে চাপিয়ে নিয়েছিলেন পদ্ম আঁকা উত্তরীয়। তারপর থেকে প্রথম দিকে অল্প অল্প করে শাসক দলকে ভাঙার কাজ করেছিলেন। বস্তুত, তৃণমূল কংগ্রেসের একদা সেকেন্ড ইন কমান্ড মুকুলের আহ্বান ও আশ্বাসেই ঘাসফুল ছেড়ে বহু হেভিওয়েট নেতা একে একে পদ্ম শিবিরে ভিরতে শুরু করেন।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই মুকুলের ফোকাস হয়ে ওঠে উনিশের লোকসভা নির্বাচন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতার উপর আস্থা দেখিয়ে প্রথমে পঞ্চায়েত ও পরে লোকসভা ভোটের দায়িত্ব তুলে দেন মোদী-শাহরা। হতাশ করেননি মুকুল। ২১টি লোকসভা আসন টার্গেট থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১৮টি আসন তুলে দেন বিজেপির হাতে।
তবে এত কিছুর পরও পদহীন অবস্থায় রাখা হয়েছিল তাঁকে। শুধুই বিজেপি নেতা! কখনও কখনও দলে কোণঠাসা হতে হয়েছে। মুকুল গেরুয়া শিবিরে যোগদানের পর থেকেই দলের মধ্যে গোষ্ঠীকন্দোল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মুকুল অনুগামীদের বাড়বাড়ন্ত ভাল চোখে নেয়নি দিলীপ ঘোষের গোষ্ঠী। সে ক্ষেত্রে মুকুল বরাবরই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়েছে। দলের মধ্যে মুকুলকে নিয়ে এমন কটাক্ষ শোনা যায়, “উনি তো কেন্দ্রের নেতা”। এই পরিস্থিতির তৃণমূল পুনরায় যোগাযোগ জল্পনাও শুরু হয়েছিল। তবে সে সব কিছুর জল্পনার অবসান ঘটিয়ে মুকুলকে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির আসন দেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এর ফলে মুকুলের মান ও কুল দুটোই বাঁচল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
সিনে দুনিয়ার এই অভিনেত্রী অবশ্য মুকুল রায়ের অনেক আগে থেকেই আস্থা রেখেছিলেন বিজেপির উপর। ২০১৫ সালেই তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। তারপর দীর্ঘ কয়েক বছর বিজেপির সাধারণ নেত্রী হিসেবেই থাকতে হয়েছিল। ২০১৯ লোকসভা ভোটের পর থেকেই বিজেপিতে লকেটের গ্রাফ চড়তে শুরু করে। প্রথমে হুগলি লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। এরপর চলতি বছরই তাঁকে বিজেপির সাধারণ সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়। সাধারণ বিজেপি নেত্রী থেকে এখন বঙ্গ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক পদে বেশ জাঁকিয়েই বসে গিয়েছেন লকেট চট্টোপাধ্যায়।
তৃণমূলের ঘর ভেঙে গত লোকসভা ভোটের আগে মার্চ মাসে বিজেপিতে সামিল হন ভাটপাড়ার চারবারের বিধায়ক অর্জুন সিং। প্রত্যাশিতভাবেই প্রথমদিকে কোনও পদ তিনি পাননি। তবে একার জোর রীতিমতো মাটি কামড়ে লড়াই করে তৃণমূলের তৎকালীন সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীকে হারিয়ে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন অর্জুন। এরপরেই ধীরে ধীরে রাজ্য বিজেপিতে গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে এই ‘বাহুবলীর’। মাসকয়েক আগে হওয়া সাংগঠনিক রদবদলের পর বিজেপির রাজ্য কমিটিতেও জায়গা দেওয়া হয় তাঁকে।
বছর দুয়েক আগের কথা। ২০১৮ সালের অগস্ট মাসে বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে দিল্লির বিজেপি দফতরে গিয়ে দলবদল সাঙ্গ করেন কলকাতার সদ্যপ্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। ফিরে এসে মুরলীধর সেন লেনে অর্ভ্যথনাও গ্রহণ করেন। কিন্তু, তাল কেটে যায় এরপরই। নামে বিজেপি নেতা হলেও আজ পর্যন্ত বিজেপির কোনও কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়নি তাঁকে।
আরও পড়ুন: ইতিহাসে প্রথমবার! ভাতের জন্য ভারতের ভরসায় চিন
গত বছর আবার এই সময় নাগাদ কানন চুপিসারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছিলেন ভাইফোঁটা নিতে। ফলে তাঁর তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনের জল্পনা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ভাইফোঁটা নিতে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বান্ধবী বৈশাখী ও স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে হওয়া কুটকাচালি জনসমক্ষে চলে আসায় তৃণমূলে ফেরার দরজাও বন্ধ হয়ে যায় শোভনের জন্য। তখন থেকে নিজের বেশিরভাগ সময় গোলপার্কের ফ্ল্যাটেই কাটাচ্ছেন এই যুগল। অনেকে কটাক্ষ সুরে বলেন বিজেপিতে শোভন-বৈশাখী ‘ডাল-ভাত’ হয়েই রয়ে গেলেন।
২০১৪ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন সৌমিত্র খাঁ। রাজনীতিতে আনকোরা এই নেতার বিরোধ লাগে যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দলের বিরুদ্ধে রীতিমতো তোপ দেগে গত বছর জানুয়ারি মাসে বিজেপিতে যোগ দেন তিনি।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে আশাতীত সাফল্য পান সৌমিত্র। একটি আর্থিক তছরুপের মামলায় জড়িয়ে পড়ায় বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে তাঁর প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে কলকাতা হাইকোর্ট। তবে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার পর নিজের কেন্দ্রে ঢুকে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সুযোগ পান। তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রচারের পুরো দায়িত্বই সামলান সৌমিত্রর স্ত্রী সুজাতা খাঁ। একটিও সভা না করেই তৃণমূল প্রার্থী শ্যামল সাঁতরাকে পরাজিত করেন সৌমিত্র। তারপর থেকেই রাজ্য বিজেপিতে ধীর গতিতে উন্নতি হয়েছে তাঁর। কয়েক মাস আগেই সাংগঠনিক রদবদলের পর যুব মোর্চার সভাপতি পদ তিনি পেয়েছেন।
সৌমিত্র খাঁ-এর মতোই অধ্যাপক অনুপম হাজরাও ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ। তবে দলবিরোধী কাজের জন্য গত বছর জানুয়ারি মাসে তাঁকে বহিষ্কৃত করা হয়। এরপরই বিজেপিতে সামিল হন। ২০১৯ সালে দল তাঁকে যাদবপুর লোকসভা আসনে প্রার্থী করে। সিপিএমের বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যকে পিছনে ফেলে মিমি চক্রবর্তীর পর দ্বিতীয় দখল করেন তিনি।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর কয়েক মাস আগে অবশেষে পদ পান অনুপম। বিজেপির বহু লড়াইয়ের সাক্ষী তথা প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহাকে সরিয়ে অনুপমকে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করেন জেপি নাড্ডা।
পেশাদার জীবনের শুরুটা সাংবাদিক হিসেবে হলেও কিছুদিনের মধ্যেই ট্র্যাক বদলে রাজনীতিতে প্রবেশ শঙ্কুদেব পণ্ডার। শুরুটা করেছিলেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি হিসেবে। দীর্ঘদিন দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করার পর ছন্দপতন ঘটে কয়েক বছর আগে। সারদা-কাণ্ডে নাম জড়িয়ে যাওয়ার পর সিবিআই তদন্তের মুখে পড়ে শাসকদলের বহু ‘রাঘববোয়াল’দের নাম তিনি বলে দেন বলে জানা গিয়েছিল। তারপরই ২০১৫ সালে তৃণমূলের সমস্ত পদ থেকে অপসারিত হন শঙ্কু। মাঝে কয়েক বছর রাজনীতির বাইরেই ছিলেন। তবে ২০১৯-এ নাম লেখান বিজেপিতে।
প্রথমে কোনও পদ পাননি তিনিও। তবে দলে যোগ দেওয়ার বছরখানেক বাদে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁকে রাজ্য যুব মোর্চার সহ-সভাপতি পদ দেয়। সঙ্গে রাজ্য কমিটিতেও জায়গা দেওয়া হয় শঙ্কুদেব পণ্ডাকে।
বঙ্গ রাজনীতির এক সম্ভাবনাময় চরিত্র নিশীথ প্রামাণিক। তিনিও গত লোকসভা নির্বাচনের আগেই ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন এই তরুণ নেতা। তারপর থেকেই সবরকম দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন নিয়মিতভাবে। তাঁর হাত ধরেই তৃণমূলের আরেক বিধায়ক মিহির গোস্বামীও ২৭ নভেম্বর নাম লিখিয়েছেন বিজেপিতে।
তবে দলে এখনও পর্যন্ত বড় কোনও পদ পাননি নিশীথ। নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হলে কোনও মন্ত্রক তিনি পেতে পারেন, এমন জল্পনাও রয়েছে। এবার সবুরে নিশীথের মেওয়া ফলে কিনা সেটা সময়ই বলবে।
অমিত শাহের উপস্থিতিতে গত বছর অক্টোবর মাসে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়র সব্যসাচী দত্ত। তবে নতুন দলে নাম লেখানো ইস্তক গত মে মাস পর্যন্ত কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়নি রাজারহাট-নিউটউনের এই বিধায়কে। যা নিয়ে কিছুটা ক্ষুব্ধও ছিলেন তিনি। তবে গত জুন মাসে সাংগঠনিক রদবদলের পরই রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়েছেন সব্যসাচী।
বীরভূম লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর যে পরিমাণ জলঘোলা হয়েছিল, তা কোনও যোগদানকে কেন্দ্র করে হয়নি। এই সংখ্যালঘু বিধায়ককে দলে সামিল করানোয় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধেই বেঁকে বসেছিলেন খোদ বিজেপি নেতারা। অনেকে একে আত্মঘাতী পদক্ষেপ বলেও আখ্যা দেন। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় হাইকমান্ড থেকে। ফলে বর্তমানে সাধারণ নেতা হিসেবেই বিজেপিতে রয়েছেন মনিরুল। আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে তাঁকে সক্রিয় হতে দেখা গেলেও যেতে পারে।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে তৃণমূল ছেড়ে বিপ্লব মিত্র যোগ দিয়েছিলেন বিজেপিতে। শোনা যায়, তৃণমূলে নেত্রী অর্পিতা ঘোষের সঙ্গে মতবিরোধের জেরেই বিজেপিতে গিয়েছিলেন তিনি। তবে শুরু থেকে নতুন দলে তাঁর পথ কখনই মসৃণ ছিল না। কোনও পদও পাচ্ছিলেন না। মাসকয়েক আগে অর্পিতা ঘোষকে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সবরকমের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন মমতা। তারপর গত জুলাই মাসে ফের তৃণমূলে ফিরে আসেন বিপ্লব মিত্র।
আরও পড়ুন: একগুঁয়ে সরকার, অনড় অন্নদাতারাও! ক্ষেতের লড়াই কীভাবে রাজধানীতে আছড়ে পড়ল?