একগুঁয়ে সরকার, অনড় অন্নদাতারাও! ক্ষেতের লড়াই কীভাবে রাজধানীতে আছড়ে পড়ল?

কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হলেও চাষিরা সটান 'না' বলে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে একবার দেখে নেওয়া যাক কৃষি আইন নিয়ে বিতর্কের উৎপত্তি কীভাবে। কেনই বা কৃষকদের চাষের জমি ছেড়ে আন্দোলনের (Farmer Protest) পথে হাঁটতে হল

একগুঁয়ে সরকার, অনড় অন্নদাতারাও! ক্ষেতের লড়াই কীভাবে রাজধানীতে আছড়ে পড়ল?
ছবি-ফাইল চিত্র
Follow Us:
| Updated on: Dec 02, 2020 | 8:20 PM

TV9 বাংলা ডিজিটাল: চাষের জমি ছেড়ে দেশের কৃষকদের (Farmer) একটা বড় অংশ এখন রাজধানীর সীমান্তে। দিল্লি ঢোকার প্রধান যে পাঁচটি পথ, সেগুলি আটকে পথে বসে রয়েছেন তাঁরা। বিরাট এই গণ-আন্দোলনের ইস্যু কেবল একটাই। কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি আইনে তিনটি সংশোধনী। সহজ করে বললে, নতুন তিনটি কৃষি আইন (Farm Law)।

প্রতিবাদে সামিল হওয়া কৃষকদের দাবি, তিনটি আইন-ই প্রত্যাহার করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে (Central Government)। যদিও নমো সরকার বিষয়টি নিয়ে বিন্দুমাত্র নমনীয় মনোভাব দেখাতে আগ্রহী নয়। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হলেও চাষিরা সটান ‘না’ বলে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে একবার দেখে নেওয়া যাক কৃষি আইন নিয়ে বিতর্কের উৎপত্তি কীভাবে। কেনই বা কৃষকদের চাষের জমি ছেড়ে আন্দোলনের (Farmer Protest) পথে হাঁটতে হল।

কৃষি বিল আইনের রূপ পেল যেভাবে

করোনা-কালে সংসদে বাদল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বহু নিয়ম কাটছাঁট করে। তার মধ্যেই চলতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর লোকসভায়, এবং ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় এই বিল পাশ হয়ে যায়। এরপর একই মাসের ২৭ তারিখ রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বিতর্কিত এই কৃষি বিলে স্বাক্ষর করে দেন। আইনের পূর্ণতা পায় কেন্দ্রীয় সরকারের এই বিল। তবে এই গোটা প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের কাছে কম নাজেহাল হতে হয়নি সরকারকে।

সংসদে ‘গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ’ করার অভিযোগ

বাদল অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্ব হবে না সেটা সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিল কেন্দ্র। তা সত্ত্বেও এই তিনটি বিলকে নিয়ে সংসদের (Parliament) উভয়কক্ষে জোর বাকবিতন্ডা চলে। ঘটে নজিরবিহীন কিছু ঘটনাও।

তবে রাজ্যসভায় এমন কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যা ছিল অপ্রত্যাশিত। তিনটি বিল নিয়ে বিতর্ক এক পর্যায়ে এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে কক্ষে উপস্থিত সাংসদদের মাইক ২০ মিনিটের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের বিরুদ্ধে রুল বুক ছিঁড়ে দেওয়ার ও ডেপুটি চেয়ারম্যান হরিবংশ নারায়ণের মাইক ছিনিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ ওঠে। শাস্তিস্বরূপ ডেরেক-সহ ৮ বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করেন চেয়ারম্যান ভেঙ্কাইয়া নাইডু।

সঙ্গী হারা হয় এনডিএ

রাষ্ট্রপতি তিনটি কৃষি বিলে সই আগের দিনই বড় ধাক্কা খায় এনডিএ জোট। এই আইন কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থী বলে দাবি করে এনডিএ জোট ভেঙে বেরিয়ে আসে পঞ্জাবের শিরোমণি অকালি দল। একই সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন এই অকালি দলের একমাত্র মন্ত্রী হরসিমরত কৌর বাদল। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, অকালি দল ছিল এনডিএ-র সবচেয়ে পুরনো জোটসঙ্গী।

কৃষকদের ক্ষোভের আগুনে ঘি, শুরু আন্দোলন

রাষ্ট্রপতি বিতর্কিত ওই তিনটি বিলে সই করার পরই কৃষকদের প্রতিবাদ মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে পঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষিরা দলে দলে রাজপথে নেমে এসে কেন্দ্রের এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। কোথাও রেললাইনে বসে, কোথাও বা নিজেদের ফলস আগুনে পুড়িয়ে তাঁরা বিক্ষোভ দেখান। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং কৃষকদের আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ান। শুরু হয় রাজনৈতিক তরজা।

ঘরে ও বাইরে চাপের মুখে পড়ে এনডিএ

বিরোধীদের তরফ থেকে তো বটেই। খোদ এনডি জোটের একাংশ এই আইনের বিরোধিতায় সুর চড়াতে শুরু করে। পঞ্জাব ও রাজস্থানের মতো একাধিক রাজ্য এই আইন বিরোধী নতুন আইন লাগু করে নিজেদের রাজ্যে। অন্যদিকে, রাজস্থান ও হরিয়ানায় বিজেপি শরিকরাও সুর চড়াতে শুরু করেছে। রাজস্থানের এনডিএ শরিক রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি জানিয়ে দিয়েছে, কেন্দ্র কৃষকদের সঙ্গে আলোচনায় না বসলে তারা জোটে থাকার বিষয়টি নিয়ে পুনর্বিবেচনা করবে। হরিয়ানার দুষ্মন্ত্য চৌটালার দলও ক্রমশ চাপ বাড়াচ্ছে কেন্দ্রের ওপর। হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতের সংগঠনও বেঁকে বসেছে কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।

কৃষকদের বৃহত্তর আন্দোলন সত্ত্বেও একগুঁয়ে অবস্থান সরকারের

গত সপ্তাহ থেকেই পঞ্জাব, হরিয়ানা-সহ দেশের একাধিক রাজ্যের কৃষকরা বৃহত্তর আন্দোলনের পথে নেমেছে। তাঁদের উদ্দেশ্য, দিল্লির রাজপথ জ্যাম করে সরকারের টনক নড়ানো। যাতে কেন্দ্র তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যেই আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সরকার কোনও ভাবেই এই আইন প্রত্যাহার করার কথা ভাবছে না। সরকার আলোচনার দরজা খুলতে চাইলেও তার জন্য শর্ত চাপানো হয়েছিল। এদিক-ওদিক আন্দোলনরত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কৃষকদের একজোট হয়ে দিল্লির বুরারি ময়দানে একত্র হওয়ার দাবি জানান স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তবে সেই প্রস্তাব খারিজ করে চাষিরা জানিয়েছেন, আগামী চার মাস টানা আন্দোলন করার মতো রসদ তাদের কাছে মজুত রয়েছে। আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত এই প্রতিবাদ চলবে।

কৃষকদের নিয়েও রাজনীতির দড়ি টানাটানি

কৃষকদের এই আন্দোলনকে কখনও খালিস্তানি জঙ্গিদের হাত রয়েছে, কখনও বা বিরোধীরা উস্কানি দিচ্ছে, এহেন বহু অভিযোগ তোলা হয়েছে বিজেপির তরফ থেকে। তবে কৃষকরা পরিষ্কারভাবেই জানিয়েছেন, তাঁদের এই আন্দোলন অধিকার আদায়ের। এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও ভূমিকা নেই। কোনও রাজনৈতিক নেতাদেরও এই মঞ্চে জায়গা দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে বিক্ষোভরত কৃষকদের সংগঠন। এর মধ্যে অবার হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর কৃষকদের এই আন্দোলনের জন্য পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংকে দুষেছেন। যা নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তরোত্তর।

আরও পড়ুন: ইতিহাসে প্রথমবার! ভাতের জন্য ভারতের ভরসায় চিন

প্রধানমন্ত্রী নিজে দাবি করেছেন, বিরোধীরা এই আইন সম্পর্কে চাষিদের ভুল বোঝাচ্ছে। কিন্তু, অমিত শাহের মুখে অন্য কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, এই কৃষক আন্দোলনের পিছনে কোনও রাজনৈতিক প্রভাব নেই। ফলে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্যও বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছে।

চাষিদের আপত্তি কোথায়?

আন্দোলনে সামিল হওয়া চাষিদের মূল বক্তব্য হল- কেন্দ্রের নতুন আইন চাষিদের ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করছে না। একই সঙ্গে নিজেদের ফসল তারা কিষাণ মণ্ডিতে ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারবে না। উল্টে কর্পোরেটদের কাছে ফসল বিক্রি করতে হবে তাঁদের বেঁধে দেওয়া দামে। সরকার ও কর্পোরেটদের এই দড়ি টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকেই চিঁড়েচ্যাপ্টা হতে হবে বলে দাবি কৃষকদের।

সরকার কী বলছে?

সরকারের দাবি, এই নতুন আইনে কোনওভাবেই চাষিদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বরং তাঁরা নিজেদের ফসল চাইলে এখন থেকে বাইরের রাজ্যে গিয়েও বিক্রি করতে পারবেন। চাষিরা ন্যূনতম সহায়ত মূল্যও পাবেন বলে দাবি করছে সরকার। যদিও এই সম্পর্কে বেশ কিছু ধোঁয়াশা থেকে যাওয়ায় চাষিদের কাছে সেটা যুক্তিগ্রাহ্য হচ্ছে না।

বলপ্রয়োগ কেন্দ্রের, কৃষকদের পক্ষে সমর্থনের জোয়ার

সরকার ও শাসকপন্থীদের একটি বড় অংশ চাষিদের এই বিদ্রোহকে বাঁকা চোখে দেখলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সমর্থন জানিয়েছেন কৃষকদের এই আন্দোলনকে। বিশেষ করে, দিল্লি ঢোকার মুখে চাষিদের আটকাতে যেভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ দিল্লি পুলিস টিয়ার গ্যাস ও জলকামানের ব্যবহার করছিল, তারপর কৃষকদের পক্ষে সমর্থনের ঢল নামে সর্বস্তরের মানুষের।

এবার দাবিদাওয়া পূরণ করতে চাষিদের কতদিন আন্দোলন চালাতে হয়, সরকারও মধ্যস্থতার কোনও রাস্তা বের করতে পারে কিনা, সেদিকেই নজর রয়েছে গোটা দেশবাসীর।

আরও পড়ুন: লাভ হল না ক্ষতি! তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে কোন নেতা আজ কোথায় দাঁড়িয়ে?