নয়া দিল্লি : ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের অষ্টমী। তবে নবমী পেরিয়ে দশমীতে বিসর্জনের কোনও ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি রাশিয়ার তরফে। উল্টে আরও জোড়াল হচ্ছে আক্রমণ। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে সরব হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এই সংঘাতের মীমাংসায় রাষ্ট্রসংঘে জরুরি বৈঠক থেকে শুরু করে সাধারণ বৈঠক সবই ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকগুলিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনা হয়েছে। কিন্তু কোনওবারই ভোটদানে এগোয়নি ভারত। রাষ্ট্রসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট না দিলেও পরোক্ষভাবে রাশিয়ার আগ্রাসনের সমালোচনা করেছে ভারত। রাষ্ট্রসংঘে বারবারই আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত মেটানোর কথা বলা হয়েছে ভারতের তরফে। এর মধ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি সাহায্য় চেয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে ভারত। এটাই ভারতের বিদেশ নীতি। তবে ভারতের এই অবস্থান নতুন নয়। জওহরলাল নেহরু থেকে নরেন্দ্রমোদীর জমানা। এই গোটা সময়েই ভারতের বিদেশ নীতির এই পরম্পরা বজায় রাখা হয়েছে।
রাষ্ট্রসংঘে গোড়া থেকেই কোরিয়া বিরোধী পদক্ষেপে সম্মতি দেয়নি ভারত। পাঁচের দশকে ভিয়েতনামের দিয়েন বিয়েন ফু-তে ফ্রান্স-ভিয়েতনাম যুদ্ধ হয়। সেইসময় ফ্রান্সের সেনা নিয়ে মার্কিন যুদ্ধ বিমান ভারতের উপর দিয়ে উড়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় বায়ুসীমা বা এয়ারস্পেস ব্যবহারের অনুমতি দেননি নেহেরু। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দশকগুলিতেও ভারতকে দলে টানতে পারেনি আমেরিকা। শত প্রলোভন, শত চাপ সত্ত্বেও ভারত নিজের বিদেশনীতি থেকে সরে আসনি। ভারত প্রথম থেকেই নিজের স্বাধীন বিদেশনীতিতে অটল থেকেছে। পাঁচের দশকে নির্জোট আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পণ্ডিত নেহরু। সোভিয়েত এবং মার্কিন এই দুই পক্ষ থেকেই সমদূরত্ব বজায় রাখাই লক্ষ্য
ছিল এই ১২০ নির্জোট সদস্য দেশের। তারা সমদূরত্ব বজায় রাখার শপথও নিয়েছিল। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দশকগুলিতে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে এই নির্জোট দেশগুলি। আটের দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর নির্জোট আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তবে ভারত নিজের স্বাধীন বিদেশনীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি।
আমেরিকার হুঁশিয়ারিকে অগ্রাহ্য করেই কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে ভারত। প্যালেস্তাইন ও ইজ়রায়েলের সঙ্গেও সমান বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে ভারত। ইরাক-ইরানের যুদ্ধেও দুই বন্ধুদেশের সঙ্গেই সম্পর্ক তিক্ততা আসতে দেয়নি ভারত। তবে নয়ের দশকের গোড়ায় ভারতের এই স্বাধীন বিদেশনীতির কিছুটা বিচ্যুতি ঘটেছিল। তবে পরক্ষণেই ভারত পুনরায় তার তথাকথিত নিরপেক্ষ বিদেশনীতিতে ফিরে এসেছে। নয়ের দশকের গোড়ায় ভারত প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের বিরোধিতা করে। মার্কিন বিমানবাহিনীকে গোড়ায় তেল ভরতে দেওয়া হলেও, যুদ্ধের দ্বিতীয় সপ্তাহে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর আসে সেই দুর্ঘটনা। বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ বদলে দিয়েছিল সেই ৯/১১ এর হামলা। তালিবানের সবচেয়ে বড় সমর্থক পাকিস্তানকে তালিবানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেই যুদ্ধেও ভারত জড়ায়নি। আমেরিকার চাপ সত্ত্বেও আফগানিস্তানে সেনা পাঠাননি অটলবিহারী বাজপেয়ী। তবে যুদ্ধ শেষে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে সবরকম সাহায্য করেছে ভারত। আফগানিস্তানের সংসদ ভবনটিও ভারতই নিজ খরচায় তৈরি করে দিয়েছে। যুদ্ধপরবর্তী বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত সাহায্য়ের হাত বাড়িয়ে দিলেও যুদ্ধে কোনওভাবে অংশ নেয়নি ভারত। কারণ ভারত সব সময়ই বিদেশনীতিতে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে চলে এবং কোনও ঝঞ্জাটে জড়াতে চায় না। আফগানিস্তানের পর আমরা ইরাকের ঘটনাও দেখেছি। ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র রয়েছে, এই কল্পিত আশঙ্কায় সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে ইরাকে অভিযান চালায় আমেরিকা। ভারতের পদক্ষেপ ছিল সেই অভিযানের বিরুদ্ধে। এবং যথারীতি যুদ্ধের পর ইরাকের পুনর্গঠনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নয়াদিল্লি।
ঠিক এরকমই ছবি দেখা যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও পদক্ষেপ না নিলেও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ইউক্রেনে মানবিক সাহায্য পাঠাচ্ছে মোদী সরকার। জরুরি ভিত্তিতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ওষুধ ও চিকিত্সা সরঞ্জাম। আন্তর্জাতিক ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকার পাশাপাশি, নিজের অভ্যন্তরীণ ও দ্বিপাক্ষিক সমস্যাতেও বাইরের হস্তক্ষেপ হতে দেয়নি ভারত। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে মধ্যস্থতার প্রস্তাব কখনও মানেনি ভারত। লাদাখ-অরুণাচল নিয়ে চিনের সঙ্গে সমস্যাতেও তৃতীয় পক্ষ নাক গলাতে পারেনি। ১৯৬২ সালে চিন যুদ্ধের সময়েও মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় ভারত। তবে ইদানিং আন্তর্জাতিক ভারসাম্যের চাপে কঠোর নিরপেক্ষতার অবস্থান একটু শিথিল করেছে নয়াদিল্লি। এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনকে ঠেকিয়ে রাখতে চতুর্দেশীয় কোয়াডের সদস্য হয়েছে ভারত। কিন্তু ভারত যে মার্কিন লবিতে নাম লেখায়নি তার প্রমাণ মিলেছে রাষ্ট্রসংঘেই। রাশিয়া বিরোধী আলোচনায় যোগই দেননি ভারতীয় প্রতিনিধি। এর থেকে বোঝা যায় ভারতের বিদেশনীতি এখনও আগের মতোই স্বাধীন।
আরও পড়ুন : Russia-Ukraine Conflict : রাশিয়ার ‘মন জয়’, মুছল আমেরিকা-ফ্রান্স-জাপানের পতাকা, অক্ষত ভারত