আজ, সোমবার থেকে শুরু হল সংসদের বিশেষ অধিবেশন। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর অবধি এই অধিবেশন চলবে। এই অধিবেশনে মোট আটটি বিল পেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। অন্যদিকে বিরোধীদের অভিযোগ, সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার আসল কারণ স্পষ্ট করছে না কেন্দ্র।
বাবা সাহেব আম্বেদকরকে আমাদের গণতন্ত্রের জনক বলা হয়। উনি স্বাধীনতা, ঐক্য, সমানাধিকারের কথা বলেছিলেন। সমতা ও স্বাধীনতা কখনও আলাদা হতে পারে না। তাদের এই মন্ত্র অনুসরণ করে চলা আজ খুব জরুরি। ভগৎ সিং বোমা ফেলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা কাউকে আঘাত করার জন্য নয়। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর সময়ে দেশের সাক্ষরতা ছিল ১২ শতাংশ, পার ক্য়াপিটা ইনকাম ছিল ২৪৫ টাকা। ওই কঠিন আর্থিক সময়ে নেহেরুজীকে দেশ সামলাতে হয়েছিল। এখন দেখুন, দেশের আজ দেশের আয় কোথায় পৌঁছেছে। চন্দ্রযানের কথা হচ্ছে, ১৯৪৬ সালে স্বাধীনতার আগে নেহেরুজীর নেতৃত্বে অ্যাটমিক রিসার্চ শুরু হয়েছিল।
সংসদে বক্তব্য রাখছেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী। তিনি বলেন, “৭৫ বছরের কথা হচ্ছে। কিন্তু আমার জ্ঞান অনুযায়ী ১৯৪৬ সালে প্রথম অধিবেশন হয়েছিল। আমি জানি না কীভাবে আপনি আজাদির ৭৫ বছর খুঁজে আনলেন। বলা হচ্ছে, আজ এই সংসদ ভবনের শেষ দিন। এই সংসদে কত জ্ঞানী-গুণী মানুষ দেশের উন্নয়নের জন্য অংশগ্রহণ করেছিলেন। জীবনে কত বন্ধু এল, কত বন্ধু ছিটকে গেল। এই সংসদও আগে সচল ছিল, এখনও চলছে। আমরা সবাই আজ এই সংসদ ভবনকে বিদায় জানাতে এসেছি। কাল থেকে আমরা নতুন সংসদে বসবেন। নেহেরুজীকে নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাব আমরা। আমাদের দেশের ইতিহাস আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। নেহেরুজী সবসময় বিরোধীদের কথা শুনতেন, তাদের অপমান বা তাদের নিয়ে মশকরা করতেন না। উনি শুধুমাত্র দেশকে কঠিন সময়ে পরিচালনই করেননি, তিনি ঐক্য-সাম্যও গঠন করেছিলেন। ওনার বক্তব্যের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে, স্পিকার বেল বাজাতেন।”
‘নতুন সংসদে নতুন বিশ্বাস নিয়ে যাব আমরা, যাতে সাধারণ মানুষের কাছে গণতন্ত্রের বার্তা পৌঁছয়। এই সংসদ ভবনকে আমি প্রণাম জানাই।
এই সংসদ ভবনেই তিনটি রাজ্য় গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আবার তেলঙ্গানার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টাও করা হয়েছিল। সেই কারণে তেলঙ্গানা দিবস বা অন্ধ্র উৎসব পালন করা যায়নি। এই সংসদেই করোনাকালে সাংসদরা ভাতা ছেড়ে দিয়েছিলেন দেশবাসীকে সাহায্য করার জন্য। নিজেদের বেতন ৩০ শতাংশ ত্যাগ করেছিলেন। জনপ্রতিনিধি আইনে একাধিক পরিবর্তন করা হয়েছে। আমরা যারা বর্তমান সাংসদ তারা ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ-উভয়ের সাক্ষী থাকতে পারছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনে সমর্থনের সিদ্ধান্ত যেমন এই সংসদে নেওয়া হয়েছিল, তেমন জরুরি অবস্থায় গণতন্ত্রের উপরে হামলাও হয়েছিল। এই সংসদ ভবনেই ভোটদানের বয়স ১৮ বছর করা হয়েছিল। নরসিমহা রাওয়ের সরকার পুরনো অর্থনীতি ছেড়ে নতুন অর্থনীতি গ্রহণ করেছিলেন। অটল বিহারী বাজপেয়ীর সময়ে সর্বশিক্ষা অভিযান, নিউক্লিয়ার স্পেসের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। মনমোহনজীর সরকারে ক্যাশ ফর ভোটের মতো ঘটনারও সাক্ষী রয়েছে এই সংসদ। এই সদনেই আবার জিএসটির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। গরিবদের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সিদ্ধান্তও এই সদনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গৃহীত হয়েছিল। এই সংসদে ৪ সদস্যের দল শাসকের গদিতে বসত আর ১০০ সদস্যের দল বিরোধী আসনে বসত। এই সংসদেই অটলজীর সরকার ১ ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। আমাদের নরসিমহাজী তো অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু জনগণের ভালবাসাতেই তিনি আরও ৫ বছর থেকে গিয়েছিলেন।
আমাদের শাস্ত্রে বিশ্বাস করা হয় যে এক জায়গায় যখন একই মন্ত্র বারংবার উচ্চারিত হয়, তখন তা তপোস্থলে পরিণত হয়। এই সংসদ ভবন তীর্থক্ষেত্রের থেকে কম নয়। এই সেই সদন, যেখানে পণ্ডিতজী ‘স্ট্রোক অব মিডনাইটে’ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। পণ্ডিত নেহেরুর মন্ত্রিসভায় বাবা সাহেব আম্বেদকর ছিলেন।
এই সংসদ ভবনে সন্ত্রাসবাদী হামলাও হয়েছে। যারা জনপ্রতিনিধিদের রক্ষা করতে নিজেদের বুকে গুলি খেয়েছিলেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। সংবাদমাধ্য়মের প্রতিনিধি, যারা আজীবন সংসদ ঘিরেই খবর তৈরি করেছেন। অন্দরের খবর বাইরে এনেছেন, তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই। তারা এমন তথ্য জানেন, যা হয়তো আমরাও জানি না। ওনাদের কলমের মাধ্যমেই সংসদের উপরে সাধারণ মানুষদের আস্থা তৈরি হয়েছে। আমাদের এই সংসদ ছাড়তে যেমন কষ্ট হচ্ছে, অনেক সাংবাদিকের হয়তো আমাদের থেকেও বেশি কষ্ট হবে।
সকল স্পিকাররা নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মোট ১৭ জন স্পিকার রয়েছেন এখনও অবধি, তার মধ্যে দুইজন মহিলা স্পিকার। আমি সকলকে অভিনন্দন জানাই। আমরা যারা জনপ্রতিনিধি, তাদেরও দায়িত্ব বেড়েছে, কাজ পরিবর্তন হয়েছে। সকলেই নিজ দায়িত্ব পূরণ করেছেন। সকলকে অভিনন্দন জানাই। সদনের ছোট কর্মীরা যারা আমাদের জল দিয়েছেন, সংসদ ভবন সাফাই করেছেন, রাত জেগে গুরুত্বপূর্ণ নথি তৈরিতে এবং তা আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তাদেরও অনেক ধন্য়বাদ জানাই।
এই ভবনেই ২ বছর ১১ মাস ধরে সংবিধান সভার বৈঠক হয়েছিল। এই ৭৫ বছরে সবথেকে বড় সাফল্য হল গণতন্ত্র, সংসদের প্রতি জনগণের বিশ্বাস বেড়েছে। আমাদের এই বিশ্বাস ধরে রাখতে হবে। রাজেন্দ্রবাবু থেকে ডঃ কালাম, রামনাথ কোবিন্দ, এখন দ্রৌপদী মুর্মু-সকল রাষ্ট্রপতি, জওহরলাল নেহেরু, অটল বিহারী বাজপেয়ী থেকে মনমোহন সিং, সকল প্রধানমন্ত্রীরা এই সংসদ ভবনের কার্যপ্রক্রিয়া সুষ্ঠভাবে পরিচালন করেছেন। তা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
করোনাকালেও আমরা কাজ থামিয়ে রাখিনি। সাংসদরা ওই কঠিন সময়েও সংসদকে সচল রেখেছিলেন। এমন অনেক পুরনো সদস্য রয়েছেন, যারা জনপ্রতিনিধিত্ব থেকে সরে যাওয়ার পরও সংসদ ভবন দেখতে আসেন অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে।
দলিত হোক, পীড়িত হোক, গরিব হোক, মহিলা-ধীরে ধীরে সকলের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। মহিলা সাংসদরা এসে এই সদনের গরিমা বৃদ্ধি করেছেন। অতীতে সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি প্রতিনিধি সংসদে যোগ দিয়েছেন। তার মধ্যে প্রায় ৬০০ জন মহিলা সাংসদ ছিলেন। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ৪৩ বছর ধরে এই সংসদ ভবনে বসতে পেরেছেন, ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে পেরেছেন। সফিকুল ইসলাম ৯৩ বছরেও সংসদে এসেছেন। ২৫ বছর বয়সে চিন্তামণি মুর্মু এই সংসদের সদস্য় হয়েছিলেন। যারা প্রচারমাধ্য়মে আমাদের দেখেন এবং ভালবাসা দেন, আমরা তাদের ওই ভালবাসা-আত্মিক টানেই সংসদ ছাড়ার পরও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়ে গিয়েছে।
আমি যখন প্রথমবার সাংসদ হয়েছিলাম, তখন সকলে আমায় আশীর্বাদ করেছিলেন। আজ সেই মুহূর্তগুলি মনে পড়ছে। রেলস্টেশনে রাত কাটানো একটি গরিব শিশু সংসদে আসতে পারবে, তা কখনও কল্পনা করতে পারিনি। এত ভালবাসা পাব, আমি কখনও ভাবিনি।
ভারত আজ বিশ্বমিত্রে পরিণত হয়েছে। পরিবারও যখন পুরনো বাড়ি ছেড়ে যায়, সকলেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। আমরাও নতুন সংসদ ভবনে যাওয়ার আগে পুরনো সংসদ নিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছি। এই সংসদ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। এই সংসদের সাফল্য আমাদের সকলের সাফল্য। এই ৭৫ বছরে আমরা অনেক ইতিহাস তৈরি করেছি। আমরা যখন এই সংসদ ভবন ছেড়ে যাচ্ছি, তখন অনেক কথা মনে পড়ছে।
জি-২০ সম্মেলনের মতো পি-২০ সামিট হবে, যা স্পিকারদের নিয়ে সংগঠিত হবে।
আজ জি-২০-র সাফল্যকে সকলে গ্রহণ করেছেন। জি-২০ সম্মেলনের এই সাফল্য় কোনও ব্য়ক্তি বা দলের সাফল্য নয়। এটা সকলের সর্বমিলিত প্রচেষ্টার ফল। ভারতের সভাপতিত্বে দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্থায়ী সদস্য পদ দেওয়া হল। এটা অত্যন্ত গর্বের।
৭৫ বছরের সংসদীয় ইতিহাসের পরিণাম হিসাবে আজ গোটা বিশ্বে আমাদের জয়জয়কার। চন্দ্রযান-৩ এর সাফল্যে শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্ব অভিভূত। নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে, আমাদের বৈজ্ঞানিকদের ক্ষমতা-দক্ষতায় গোটা বিশ্বে প্রভাব ফেলতে পেরেছি আমরা। সমস্ত বিজ্ঞানীদের কোটি কোটি অভিনন্দন জানাই।
নতুন সদনে আমরা যাব ঠিকই, কিন্তু এই ভবনও আগামী প্রজন্মকে প্রেরণা দেবে। এটা ভারতের গণতন্ত্রের একটি স্বর্ণময় অধ্যায়। গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের গণতন্ত্রের পরিচিতি গঠন করেছে এই সংসদ ভবন।
সংসদের বিশেষ অধিবেশনে লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “এই সংসদীয় যাত্রা ঐতিহাসিক হতে চলেছে। ইতিহাসকে স্মরণ করে আমরা এই ঐতিহাসিক ভবন থেকে বিদায় নিচ্ছি। এই সদন আগে ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ছিল। স্বাধীনতার পরে তা সংসদে পরিণত হয়। ব্রিটিশরা সংসদ তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেও, আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি এই সংসদ গঠনের শ্রম, অর্থ, বল আমাদের দেশবাসীর ছিল।”
সংসদের বিশেষ অধিবেশনে জি-২০ সম্মেলনের থিম বসুদেব কুটুম্বকম, এক বিশ্ব, এক দেশ নিয়ে কথা বললেন লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা।
জি-২০ সম্মেলনের শুরুতেই লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা সদ্য সমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনের সাফল্য নিয়ে কথা বলেন। জি-২০ তে দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্থায়ী সদস্য পদ দেওয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনেতাদের রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন লোকসভার অধ্যক্ষ।
সংসদ অধিবেশন শুরু হতেই বিরোধীদের হই-হট্টগোলে উত্তেজনার সৃষ্টি লোকসভায়। বিরোধী সাংসদদের চুপ করানোর চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ ওম বিড়লা।