নয়া দিল্লি: শ্রীলঙ্কার আর্থিক সঙ্কটের বিষয়টি এখন গোটার বিশ্বের কাছেই অজানা নয়। চরম আর্থিক সঙ্কটের মুখে শ্রীলঙ্কায় লাগাম ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম, এমনকী নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসপত্রের অভাবও দেখা দিয়েছে। ভারতের প্রতিবেশি দেশে হাহাকারও দেখা দিয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কার মতো বেহাল আর্থিক দশা ভারতে বেশ কিছু রাজ্যে হয়ে পারে। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের সরকার জনগণের মন জয়ে দান খয়রাতির পথে হেঁটেছে, এই বিপুল খরচের বোঝা রাজ্যগুলির আর্থিক অবস্থাকে ক্রমশ খারাপ দিকে নিয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সতর্ক করেছেন আমলারা। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার নেওয়ার পর ৩ এপ্রিল এই নিয়ে নবমবার সব দফতের প্রধান সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী। সেই বৈঠকে আমলারা মোদীর কাছে বেশ কয়েকটি রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। আমলাদের মতে বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সেই রাজ্যের সরকারগুলি এমন কিছু প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে, যার ফলে সরকারে ওপর ব্যাপক আর্থিক বোঝা চেপে গিয়েছে। ফলে অর্থনীতি সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। তাদের আশঙ্কা পরিস্থিতি যদি এমনভাবে চলতে থাকে তবে সেই রাজ্যগুলির অবস্থা গ্রীস বা শ্রীলঙ্কার মতোই হতে পারে।
দান-খয়রাতিতেই দুর্দুশা, বেহাল অর্থনীতি
ভারতের অনেকগুলি রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি তথৈবচ। এমনকী সেই রাজ্যগুলির রাজস্ব আদায়ের অবস্থাও খুবই খারাপ। কিন্তু রাজস্বের কথা না ভেবেই রাজ্যগুলি ক্রমাগত দান-খয়ারাতির পথে হেঁটে চলেছে। ঠিক এইভাবে ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ধ্বংসের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। পঞ্জাবে ক্ষমতায় এসে আম আদমি পার্টি সরকার ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা অনেক রাজনৈতিক দল বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, বিনামূল্যে রেশন, নিখরচায় ওষুধ এবং আরও অনেক পরিষেবাতে ভুর্তুকি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। ফলে রাজ্যে বাজেটে সেই অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে ব্যয় বরাদ্দ কমছে। দক্ষিণের তামিলনাড়ুতে এই রাজনীতি শিল্পতে পরিণত হয়েছে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৩ সালে তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কে কামরাজের শাসনকালে থেকে এর সূচনা হয়। সেই সময় তিনি বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্কুলের ছাত্রদের বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
তালিকায় পঞ্জাব, কেরল, মধ্য প্রদেশ সহ অনেক রাজ্য, অর্থনীতির কথা না ভেবে দান-খয়রাতিতে বিতর্ক
যদি ধরে নেওয়া হয় পঞ্জাব একটি আলাদা দেশ, তবে তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অনেক মিল পাওয়া যাবে। ২০২১-২২ আর্থিক বছরে পঞ্জাবের জিডিপি ছিল প্রায় ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওই আর্থিক বছরে শ্রীলঙ্কার জিডিপিও ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। জিডিপির পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্জাবের ঋণের অনুপাত ছিল ৫৩.৩ শতাংশ। এই হার দেশের সব রাজ্যগুলির তুলনায় সর্বাধিক। এখন পঞ্জাব যদি একটি পৃথক দেশ হত তবে প্রতিরক্ষা, গণ টিকাকরণেও সরকারকে ব্যয় করতে হত, ফলে আরও অর্থ ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। আরও অর্থ ঋণ নিলে জিডিপি ঋণের অনুপাত অনেকটাই বৃদ্ধি পেত। ফলে ঋণের পরিমাণও পাল্লা দিয়ে বাড়ত। বর্তমানে জিডিপির অনুপাতে শ্রীলঙ্কার ঋণের পরিমাণ ১২০ শতাংশ। ফলে এই ঋণ পরিশোধ করা অনেকটাই কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে। পঞ্জাবের মতো দেশের আরও অনেকগুলি রাজ্যের অবস্থাও অনেকটা একই রকম। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আর্থিক সাহায্য পেয়ে রাজ্যগুলি কোনও রকমে কাজ চালাচ্ছে। যে রাজ্যগুলির জিডিপি ৫০ বিলিয়ন থেকে ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ঋণের অনুপাত ২৫ শতাংশে বেশি, তাদের আর্থিক পরিস্থিতি যে কোনও সময়ে শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে। এই তালিকায় অন্ধ্র প্রদেশ, কেরল, মধ্য প্রদেশ, হরিয়ানা, বিহার, পঞ্জাব, ওড়িশা ও অসম রয়েছে। তবে অন্যান্য রাজ্যগুলির অবস্থাও যে খুব ভাল এমনটা বলা যায় না। শুধু গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের জিডিপি আন্দাজে ঋণের পরিমাণ খানিক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
এ তো গেল রাজ্যের কথা। তবে কেন্দ্রীয় সরকারও খুব বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তাদের জিডিপি আন্দাজে ঋণের পরিমাণও খানিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে সেই হার প্রায় ৫৯ শতাংশ। ভারতের রাজ্যগুলির সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মিল থাকলেও শ্রীলঙ্কার আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে কারণ সেদেশের সরকার জনগণকে খুশি রাখতে করের হারে ছাড় দিয়েছে। পরবর্তীকালে করোনা পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার আয় অনেকটাই কমে গিয়েছে। ফলে আর্থিক অবস্থা আরও বেশি অবনতি হয়েছে।