ঈপ্সা চ্যাটার্জী:
আইনি যাবতীয় জটিলতা ও সুবিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে শেষ পথ হল সুপ্রিম কোর্ট। যদি নিম্ন আদালত বা হাইকোর্টে সুবিচার না মেলে বা রায়ে সন্তুষ্টি না পাওয়া যায়, তবে কড়া নাড়া হয় দেশের শীর্ষ আদালতে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মামলার রায়দানের ভার যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের উপরেই থাকে, তাই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরও সেই পদের জন্য যোগ্য হতে হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নির্বাচন করার আলাদা একটি পদ্ধতি রয়েছে। একে বলা হয় কলেজিয়াম। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন শীর্ষ বিচারপতি থাকেন এই ফোরামে। এই বিচারপতিরাই মিলিতভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ও তাঁদের বদলি সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেন। হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিতে উন্নীত করা বা বদলি সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্তও সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম নিয়ে থাকে। তবে সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের এই কলেজিয়াম নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই। আর এখান থেকেই বিরোধ শুরু।
সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের সদস্যদের মিলিতভাবে সুপারিশ করা বিচারপতিদের নামের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। তারপর সেটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। যদি কেন্দ্রীয় সরকার কলেজিয়ামের মনোনীত বিচারপতির নামে সহমত না হন, তাহলে তারা সেই সুপারিশ ফেরত পাঠাতে পারে। তবে কলেজিয়াম যদি আবার সেই বিচারপতির নামই পুনরায় পাঠায়, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার সেই সিদ্ধান্তকেই মেনে নিতে বাধ্য।
সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম নিয়ে প্রশ্ন-অভিযোগ রয়েছে বহু দিন আগে থেকেই। অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামে নিয়োগ ও বদলি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুরু করে প্রাক্তন বিচারপতিরা কলেজিয়াম ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের সকলেরই দাবি, দীর্ঘদিনের পুরনো এই কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিদায় নেওয়া উচিত এবার।
কলেজিয়াম ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতেই ২০১৫ সালে মোদী সরকার বড় পদক্ষেপ করে। সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টগুলির বিচারপতিদের নিয়োগে কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে জাতীয় বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন বা এনজেএসি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। সংসদে ও ১৬টি রাজ্যের বিধানসভাতেও এই বিল পাশ করানো হয়।
কিন্তু কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্ট। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে জানান, যতক্ষণ কমিশনের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, ততক্ষণ তাঁর পক্ষে নিয়োগ কমিশনের বৈঠকে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়। এরপরই ২০১৫ সালের অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এনজেএসি গড়ার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে কলেজিয়াম প্রথাই বহাল রাখার রায় দেয়।
কলেজিয়াম নিয়ে প্রথম থেকেই বিরোধিতা করে এসেছেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরণ রিজিজু। ধারাবাহিকভাবে তিনি কলেজিয়াম পদ্ধতির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আইনমন্ত্রীর কথায়, কলেজিয়ামের মাধ্যমে বিচারপতিদের যে নিয়োগ করা হচ্ছে, তাতে সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। জনগণের ভোটের দ্বারাই নির্বাচিত হন জনপ্রতিনিধিরা, সেই কারণে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা থাকা উচিত। শুধুমাত্র কলেজিয়ামের পাঠানো প্রস্তাবকে মেনে নেওয়াই সরকারের ভূমিকা হতে পারে না।
সম্প্রতিই প্রকাশ্যে আইনমন্ত্রী কিরণ রিজিজু বলেন, “বর্তমান কলেজিয়াম ব্যবস্থায় অস্বচ্ছতা রয়েছে। এটি ভারতীয় সংবিধান বর্হিভূত।” অন্যদিকে বিচার বিভাগের অভিযোগ, “প্রস্তাব পাঠানো হলেও নানা কারণ দেখিয়ে বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে আদালতে প্রচুর শূন্যপদ তৈরি হচ্ছে, বিচারপ্রক্রিয়াতেও দেরি হচ্ছে।”
বিচার বিভাগের এই অভিযোগের পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন আইনমন্ত্রীও। তিনি বলেন, “সরকার কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ আটকে রাখে না। বরং সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামকে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে মহিলা ও লঘু সম্প্রদায়কে প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সরকার।” তিনি আরও বলেছিলেন, “সরকার সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখে না।”
গত বছরের সংসদের শীতকালীন অধিবেশনেও তোলা হয় সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম ব্যবস্থার সংস্কার। এই বিষয়ে আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কলেজিয়াম ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা আনার জন্য় একটি খসড়াপত্র সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া আটকে আছে।
কলেজিয়াম ব্যবস্থা নিয়ে আইনমন্ত্রীর অস্বচ্ছতার মন্তব্যকে ‘হতাশাজনক’ বলেই উল্লেখ করেছিল শীর্ষ আদালত। গত ৩ ডিসেম্বর শীর্ষ আদালতের তরফে জানানো হয়, বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে কলেজিয়াম ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে না।
সম্প্রতি সংসদে উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়ও আইনমন্ত্রী রিজিজুর বক্তব্যের সুর ধরেই বলেন, “এখনও জাতীয় বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন নিয়ে সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনার সময় রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে এই আইন বাতিল করেছিল, তা সংবিধানের সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে বড়সড় আপোশ এবং সাধারণ মানুষের মতকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।”
পাল্টা জবাব দেয় সুপ্রিম কোর্টও। কোনও নাম উল্লেখ না করেই শীর্ষ আদালতের তরফে বলা হয়,”সংবিধানের ব্যবস্থায় আইন বিভাগের শীর্ষে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টই। যাঁরা কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিরোধিতা করছেন, তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করুন।”
বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কলেজিয়ামের বৈঠকের তথ্য চেয়ে একটি তথ্যের অধিকার আইনে মামলাও করা হয়েছিল। সেই মামলার শুনানিতে শীর্ষ আদালতের তরফে বলা হয়, “আমরাই সবচেয়ে স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান।’’ বর্তমানে ওই মামলার রায় সংরক্ষিত রয়েছে।
সম্প্রতিই সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ শীতকালীন ছুটিতে যাওয়া নিয়েও বিতর্ক হয়। দুই সপ্তাহের শীতকালীন ছুটিতে বসবে না কোনও অবসরকালীন বেঞ্চও। এই ঘোষণার পরই আবার নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়। আইনমন্ত্রী বিচার বিভাগের দীর্ঘ ছুটিকে কটাক্ষ করেই বলেন, “আদালতে লম্বা লম্বা ছুটি পড়ে যাওয়ার ফলে আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।”