কমলেশ চৌধুরী: টিকা আছে, কিন্তু নেওয়ার লোক কি পাওয়া যাচ্ছে না? ভ্যাকসিন নিতে অনীহা? যদি তাই হয়, তাহলে কী করছে কেন্দ্র-রাজ্য?
এই প্রশ্নই তুলে দিল পরিসংখ্যান। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সর্বশেষ রিপোর্ট, রাজ্যগুলিতে ১৩.৪ কোটি ডোজ মজুত। অথচ, সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২৬.৩% কম করোনা টিকাকরণ হয়েছে অক্টোবরে। বৃদ্ধির বদলে গতি পড়তির দিকে। ১৭ সেপ্টেম্বর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে আড়াই কোটি ডোজ প্রয়োগ করে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল ভারত। কিন্তু তার পর মাত্র দু’বার একদিনে এক কোটির বেশি ডোজ প্রয়োগ হয়েছে দেশে। তা-ও সেপ্টেম্বরে, অক্টোবরে নয় একদিনও। দৈনিক পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, ক্রমেই শ্লথ হচ্ছে টিকাকরণের গতি।
এই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল মে মাসে। এপ্রিলের ৯ কোটি ডোজ প্রয়োগের পর মে মাসে তা কমে দাঁড়ায় ৬ কোটিতে। কারণ ছিল, টিকার জোগান কমে যাওয়া। এখন সেই সমস্যা নেই। টিকার উত্পাদন কয়েক গুণ বেড়েছে, বিশেষ করে কোভিশিল্ডের। জোগান বাড়লে, টিকাকরণের গতি বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উল্টো ঘটনার সাক্ষী দেশ।
কোউইনের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বরে দেশে ২৩.৬ কোটি ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছিল। অক্টোবরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭.৪ কোটিতে। ২১ অক্টোবর ১০০ কোটি ডোজের মাইলফলক ছুঁয়েছিল দেশ। ৩১ অক্টোবর তা পৌঁছেছে মাত্র ১০৬ কোটিতে। অর্থাত্, ১০ দিনে ৬ কোটির কাছাকাছি ডোজ দেওয়া হয়েছে। দৈনিক টিকাকরণের গড় মাত্র ৬০ লক্ষ! একসময় কেন্দ্র একুশের মধ্যেই সব প্রাপ্তবয়স্ককে জোড়া ডোজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। লক্ষ্যপূরণ করতে হলে সেপ্টেম্বর থেকে দৈনিক ১.২৫ কোটি ডোজ প্রয়োগ করা দরকার ছিল। তা হয়নি। এর সঙ্গে কোভিশিল্ডের দুই ডোজের মধ্যে ৮৪ দিনের ফারাক ধরলে, কোনও ভাবেই সব প্রাপ্তবয়স্কের টিকাকরণ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। জনসংখ্যার সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ৯৪-৯৫ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক, অর্থাত্, ১৯০ কোটি ডোজ প্রয়োগ করতে হবে। ফলে সামনে অনেকটা পথ।
সবচেয়ে বড় কথা, কোভিডে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেই বয়স্কদের একটা বড় অংশ এখনও টিকা পাননি। তথ্য বলছে, ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে ৩ কোটি এখনও একটি ডোজই পাননি। দ্বিতীয় ডোজ পাননি, অর্থাত্, টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়নি অন্তত ৭.৫ কোটির। ৪৫-ঊর্ধ্বদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা যথাক্রমে ৭ কোটি ও ১৯ কোটি।
একশো কোটির সাফল্য সামনে রেখে ঢালঢোল বাজতেই পারে। নিশ্চিত ভাবেই বড় মাইলফলক। কিন্তু এমন ফাঁকফোকর থাকলে তৃতীয় ঢেউ সামলানো যাবে তো? বিশেষ করে যখন বুস্টার ডোজ, নাবালকদের টিকাকরণ নিয়ে আলোচনা চলছে। দুই দরজা খোলা মানেই তো লক্ষ্যমাত্রা আরও বেড়ে যাওয়া!
গতি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ অনীহা। সরাসরিই বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ দলুই। তাঁর কথায়, “একটা সময় চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ফারাক ছিল। এখন হয়েছে উল্টো। অনেকেই টিকা নিতে চাইছেন না। এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে একটা শিথিলতাও দেখা যাচ্ছে। টিকাকরণের গতি বাড়াতে আরও সক্রিয় হতে হবে। অভিনব প্রচার করতে হবে। আরও বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে। বিশেষ করে গ্রামে। রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় গুরুদের সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যেমন হয়েছিল পোলিও ঠেকাতে।”
অনীহা যে তৈরি হয়েছে, বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। যে কারণে ‘হর ঘর দস্তক’ নামে মেগা ড্রাইভ শুরু করতে চলেছে মনসুখ মাণ্ডব্যর মন্ত্রক। যারা সময় হয়ে গেলেও, দ্বিতীয় ডোজ নেননি বা এখনও প্রথম ডোজ নেননি, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দেওয়া হবে, জানিয়েছেন মাণ্ডব্য। দেশের ১২ রাজ্যের ৪৮টি জেলায় এখনও ৫০% প্রাপ্তবয়স্ক প্রথম ডোজ নেননি। যা নিয়ে চিন্তিত কেন্দ্র। বুধবারই রাজ্যগুলির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
তবে আশার খবর, বাংলা এই তালিকায় নেই। উল্টো পথে হেঁটে অক্টোবরে টিকাকরণ বেশি হয়েছে বাংলায়। পুজোর মাস সত্ত্বেও, অন্য বড় রাজ্যগুলির তুলনায় বাংলার পারফরম্যান্স ভালো। যার ফলস্বরূপ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের পর তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলা। তবে দিল্লি বহু দূর! এখনও ১৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক একটিও ডোজ পাননি। জোড়া ডোজ পেয়েছেন মাত্র ৩১%।
লক্ষ্যপূরণ না-হলে করোনার রক্তচক্ষু এড়ানো সম্ভব কি?
আরও পড়ুন : রাতারাতি ট্রেনের ভাড়া দ্বিগুণ হল কেন? ক্ষোভে ফুঁসছেন যাত্রীরা, ব্যাখ্যা দিল রেল