বেঙ্গালুরু: ১৩ মে ফল বেরিয়েছিল কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচন ২০২৩-এর। দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছিল কংগ্রেস। তারপর পাঁচ দিনের টানাপোড়েন, কে পাবেন শীর্ষ পদ? কঠিন লড়াই চলেছে কর্নাটকের দুই শক্তিশালী কংগ্রেসী নেতা সিদ্দারামাইয়া এবং ডিকে শিবকুমারের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে, ৭৫ বছর বয়সী সিদ্দারামাইয়াকেই কর্নাটকের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে। হাইকমান্ডের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পর, সব মেঘ কেটে গিয়েছে। দ্বিতীয়বারের জন্য কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন সিদ্দারামাইয়া। ২০১৩ সালে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। এবার আবার পুরোনো চেয়ার ফিরে পাচ্ছেন তিনি। ইতিহাস বলছে ডি দেবরাজ উরস (১৯৭২ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মুখ্য়মন্ত্রী ছিলেন) -এর পর, তিনিই কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে একটি পূর্ণ মেয়াদ সম্পূর্ণ করার পর, ফের আরেক মেয়াদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। এই অবসরে ফিরে দেখা যাক দক্ষিণী রাজ্যের এই বর্ষীয়ান কংগ্রেসী নেতার রাজনৈতিক জীবন –
‘কৃষকদের উকিল’
মাইসুরু জেলার সিদ্দারামানাহুন্ডি গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সিদ্দারামাইয়া। মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক হন এবং সেখানে থেকেই আইনের ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন। অল্প সময়ের জন্য তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজও করেছিলেন। রাজনীতিতে পা রাখার আগেই তিনি মাইসুরু এলাকার কৃষকদের কন্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘কৃষকদের উকিল’ হিসেবে। সিদ্দারামাইয়া ও তাঁর স্ত্রী পার্বতীর দুই সন্তান ছিল – বড় ছেলে রাকেশ কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। ছোট ছেলে যথিন্দ্র, একজন ডাক্তার। ২০১৬ সালে, বেলজিয়ামে একাধিক অঙ্গ ব্যর্থতার কারণে মৃত্যু হয় রাকেশের।
‘ডানপন্থী’
দীর্ঘদিন পর্যন্ত সিদ্দারামাইয়ার নামের পাশে ‘ডানপন্থী’ রাজনৈতিক কর্মীর তকমা লেগেছিল। সিদ্দারামাইয়া রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন জনতা পার্টির হয়ে। ১৯৮৩ সালের কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনেই তাঁর প্রার্থী হওয়ার কথা উঠেছিল। কিন্তু, ‘ডানপন্থী’ তকমার কারণেই তাঁকে টিকিট দেননি জনতা পার্টির তৎকালীন সভাপতি এইচডি দেবেগৌড়া। তাঁর রাজনৈতিক গুরু আব্দুল নজির সাবের পরামর্শে ভারতীয় লোক দলের সমর্থনে চামুন্ডেশ্বরী কেন্দ্র থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন সিদ্দারামাইয়া। যে চামুন্ডেশ্বরী কেন্দ্র পরবর্তীকালে তাঁর ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এবারও সেই কেন্দ্র থেকেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন সিদ্দারামাইয়া।
উপমুখ্যমন্ত্রী
জনতা পার্টি তাঁকে টিকিট না দিলেও, নির্বাচনের পর তিনি রামকৃষ্ণ হেগরের নেতৃত্বাধীন জনতা পার্টি সরকারকেই সমর্থন করেছিলেন। রামকৃষ্ণ হেগরেও তাঁকে কানাড়াকে কর্নাটকের সরকারি ভাষা করার বিষয়ে গঠিত কমিটির প্রধান করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে জনত পার্টির টিকিটে চামুন্ডেশ্বরী কেন্দ্র থেকে ফের নির্বাচিত হন তিনি এবং মন্ত্রীও হন। ১৯৮৯ সালে অবশ্য চামুন্ডেশ্বরী কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে হারতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৯২ সালে জনতা দলের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৪ সালে চামুন্ডেশ্বরী থেকে জিতে ফের মন্ত্রিসভায় ফিরে আসেন সিদ্দারামাইয়া। এবার এইচডি দেবেগৌড়া মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে জেএইচ প্যাটেল মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, তিনি উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। ওই বছরই ভেঙে গিয়েছিল জনতা দল। দেবেগৌড়ার জনতা দল (সেকুলার)-এর প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন সিদ্দারামাইয়া। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে তিনি ফের চামুন্ডেশ্বরী কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন তিনি।
কংগ্রেসম্যান
২০০৪-এ ফের জিতে উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এই সময় কংগ্রেস এবং জেডি(এস) জোট সরকার গঠন করেছিল। তারা ঠিক করেছিল, আড়াই বছর করে দুই দল থেকেই মুখ্যমন্ত্রী হবে। দুই বছর পর কংগ্রেস যখন জেডি (এস)-কে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার ছেড়ে দেবে, তখন তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করা হবে না বলে আশঙ্কা করেছিলেন সিদ্দারামাইয়া। এরপরই তিনি ‘অহিন্দা’ নামে সংখ্যালঘু, অনগ্রসর শ্রেণী এবং দলিতদের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে রাজ্য সফর করা শুরু করেছিলেন। এরপরই তাঁকে উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। ২০০৬ সালে অনগ্রসর শ্রেণীর বিপুল সমর্থন নিয়ে তিনি জেডি (এস) ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ওই বছরই চামুন্ডেশ্বরী কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে উপনির্বাচনে জয়ী হন তিনি। কংগ্রেসে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা হয়। ২০০৮ সালে বিজেপি প্রথমবার রাজ্যে সরকার গঠন করেছিল। সিদ্দারামাইয়াকেই বিরোধী দলনেতা মনোনীত করেছিল কংগ্রেস।
মুখ্যমন্ত্রী
২০১৩ সালে ২২৪ বিধানসভা আসনের মধ্যে ১২২টি আসনে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। প্রথমবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন ‘সিদ্দু’। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম মেয়াদে যেমন বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছিল কংগ্রেস সরকার, তেমনই জড়িয়েছিল বেশ কিছু বিতর্কে। গরীবদের খাদ্য সুরক্ষার জন্য ‘অন্ন ভাগ্য’ প্রকল্প-সহ বহু কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছিল তাঁর সরকার। তবে, তাঁর সরকার বিদ্ধ হয়েছিল দুর্নীতির অভিযোগে। তবে তা সত্ত্বেও ৫ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করেছিলেন তিনি।
বিরোধী দলনেতা
২০১৮ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস আটকে গিয়েছিল ৮০ আসনে। বিজেপি জিতেছিল ১০৪ আসনে। বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে ফের হাত মিলিয়েছিল কংগ্রেস ও জেডি (এস)। পুরোনো দলের সঙ্গে জোট গড়ার ক্ষেত্রে সিদ্দারামাইয়াই সবথেকে বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন বলে শোনা যায়। তবে, এই মিলিজুলি সরকার ১৪ মাসের বেশি টেকেনি। দুই দলেরই মোট ১৫ জন বিধায়ক ইস্তফা দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে সরকার গঠন করে বিজেপি। সিদ্দারামাইয়া বিরোধী দলনেতার আসনে বসেছিলেন।
ইতিহাস গড়বেন?
৪ বছর পর, ফের একবার মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন তিনি। কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী সাফল্যে ডিকে শিবকুমারের মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন সিদ্দারামাইয়াও। এবারও যদি ৫ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেন তিনি, তাহলে ইতিহাস গড়বেন তিনি। কারণ কর্নাটকে এখনও পর্যন্ত কোনও নেতাই শীর্ষ পদে দুই পূর্ণ মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। বিএস ইয়েদুরাপ্পা চারবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু, একবারও পূর্ণ মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি।