২৮ মার্চ ১৯৪২। লন্ডন থেকে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের রিপোর্ট, বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন নেতাজি। পরের দিন নিউ ইয়র্ক টাইমসে বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়, “ইন্ডিয়ান এইডিং অ্যাক্সিস রিপোর্টেড কিলড”। তার ঠিক তলায় লেখা, “জাপান যাওয়ার সময় বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ চন্দ্র বসু নিহত হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে”। এ খবর আরও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ে ভারতে।
নেতাজির মৃত্যুর খবর প্রচার করে ফ্রান্সের লিয়ন রেডিয়ো। টোকিয়োর একটি বার্তা ওই রেডিয়ো সম্প্রচার করে জানায়, জাপানে ‘ভারতের স্বাধীনতা’ নামক একটি কনফারেন্সে যাচ্ছিলেন নেতাজি। জাপানি সেনার বিমানে ছিলেন নেতাজি-সহ ১১ জন সদস্য। জাপানের সমুদ্র সৈকতে হঠাৎই দুর্ঘটনায় পড়ে সেই বিমান। ওই দুর্ঘটনায় নিহত হন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট স্বামী সত্যানন্দ পুর এবং ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্ট লিগের নেতা প্রিতম সিং। তবে, নেতাজির মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। কারণ, পরের দিন অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (AP) একটি রিপোর্টে নেতাজির মৃত্যুর খবর ভুয়ো বলে জানায়।
নেতাজির মৃত্যু নিয়ে সংশয় থাকলেও খোদ মহাত্মা গান্ধী যখন শোকবার্তা জ্ঞাপন করেন, দেশবাসীর কাছে আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না। দেশবাসীও ভাবতে শুরু করে, ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করতে যে ব্যক্তি ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন, স্বাধীনতার জন্য রাশিয়া-জার্মানি-ইতালির রাষ্ট্রনেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন, হিটলারের জার্মানিতে বসেই ‘আজাদ হিন্দ রেডিয়ো’ স্টেশন তৈরি করছেন, সেই নেতাজি এইভাবে শেষ হয়ে গেলেন! বিশ্বাস না করলেও গান্ধীজির শোকবার্তা বিশ্বাস করাতে বাধ্য করে। মৃত্যুর খবর শোনার পর শোকজ্ঞাপন করেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মৌলনা আব্দুল কালামও।
নেতাজির মা প্রভাবতী দেবীকে গান্ধীজি টেলিগ্রাফ করে জানান, আপনার সন্তানের মৃত্যুতে গোটা দেশ শোকস্তব্ধ। এমন অপ্রত্যাশিত ক্ষতি বহন করার ধৈর্য্য আপনাকে ঈশ্বর দিন, এই কামনাই করি। মৌলানা তাঁর শোকবার্তায় লেখেন, সুভাষ চন্দ্র বসুর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। স্বাধীনতার লড়াইয়ের পথ ভিন্ন হলেও তিনি তাঁর জীবন এবং মৃত্যুকে উৎসর্গ করেছেন শুধুমাত্র দেশকে। এই খবরে যারপরনাই খুশি ব্রিটিশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ ছিল ব্রিটিশদের। আর সেই অক্ষশক্তিকেই কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ শৃঙ্খল থেকে ভারতকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন নেতাজি। শোনা যায়, ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছেও নেতাজির মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছয়। তবে, ১৯৪২ সালের ২৭ মে ভারতের ব্রিটিশ সেনার কম্যান্ডার ইন চিফ ‘মোস্ট সিকরেট’ নামে একটি টেলিগ্রাফ করেন ব্রিটেনের সেনা দফতরে। সেই টেলিগ্রাফে তিনি লেখেন, বার্লিনেই আছেন বোস। আজাদ হিন্দ রেডিয়োর লোকেশন শনাক্ত করে জানা যাচ্ছে বার্লিনের কাছেই রয়েছেন তিনি।
নেতাজির মৃত্যুর খবর আদ্য়প্রান্ত যে গুজব, তা প্রমাণ করেন নেতাজিই। পয়লা এপ্রিল বার্লিন থেকে বেতার বার্তায় নেতাজি জানান, স্যর স্ট্যাফর্ড ক্রিপসের স্বশাসিত সরকারের ভাবনা গ্রহণ করা উচিত হবে না। পূর্ণ স্বাধীনতা আসবে জার্মানি-জাপান-ইটালি থেকেই। যুদ্ধের জন্য ব্রিটিশ শক্তি যে ভারতের সম্পদ ব্যবহার করছে, তা প্রতিরোধ করারও আহ্বান জানান নেতাজি। চলতি বছরে ১২ অগস্ট ফের বার্লিন থেকে এবার বেতার বার্তায় কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেন নেতাজি। তিনি বলেন, “এবার ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে। সমস্ত পুরুষ-নারী এবং শিশুর এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ অত্যাবশক। আত্মত্যাগই এখন একমাত্র লক্ষ্য। মনের ভিতর আর কোনও আপস রাখলে চলবে না। যতক্ষণ না শেষ ইংরেজকে এ দেশ থেকে উৎখাত করতে পারছি, আমাদের সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এই পবিত্র ভূমিতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানোই এবার একমাত্র লক্ষ্য আমাদের।”
১৯৪৫ সালে ১৮ অগস্ট যখন আরও একবার নেতাজির বিমান দুর্ঘটনার খবর আসে, সে দিন গান্ধীজি বিশ্বাস করেননি। সে দিন তিনি জনসভায় বলেছিলেন, ‘এই খবর আমরা বিশ্বাস করি না। নেতাজি ফিরে আসবেনই।’ তবে পরে তাঁর বয়ান পাল্টেছিলেন। যদিও সেদিন কোনও দেশবাসীই এই খবরে বিশেষ একটা পাত্তা দেয়নি। আজ তাঁর ১২৫তম জন্মদিনেও কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, নেতাজি একদিন ফিরে আসবেন…কারণ, তিনি ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’।
তথ্য: New York Times