AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

Explained: বাদ পড়ল স্তবক, হওয়া হল না জাতীয় সঙ্গীত! সবটাই নেহরুর নির্দেশে?

150 Years of Vande Mataram: বর্তমানে বিজেপি নেতা-নেত্রীরা 'বন্দে মাতরম্' প্রসঙ্গে দু'টি ইস্যুকে বারংবার টেনে তুলে আনার চেষ্টা করছেন। একটা সরাসরি, অন্যটা ইঙ্গিতে। প্রথম ইস্যু 'বন্দে মাতরমে্র' স্তবক বাদ পড়া। দ্বিতীয় 'বন্দে মাতরম্'কে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে তুলে ধরা।

Explained: বাদ পড়ল স্তবক, হওয়া হল না জাতীয় সঙ্গীত! সবটাই নেহরুর নির্দেশে?
প্রতীকী ছবিImage Credit: Tv9 Graphics
| Updated on: Dec 11, 2025 | 11:55 PM
Share

মোদী বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। প্রিয়ঙ্কা তুলে ধরলেন, দু’টি কারণ। সোমবার টানা ১০ ঘণ্টা ধরে লোকসভায় চলল অধিবেশন। আলোচনার প্রসঙ্গ ‘বন্দে মাতরম্’, দেশের জাতীয় গান। সাম্প্রতিক অতীতে এই নিয়ে আলোচনার নজির সত্যিই নেই। কিন্তু তারপরেও আচমকাই এই আলোচনার প্রয়োজন পড়ল কেন?

বিতর্কের সূত্রপাত

দু’মাস আগের কথা। অক্টোবরের শেষ দিকে বরাবরের মতো মন কি বাতের পর্বে রেকর্ড করলেন প্রধানমন্ত্রী। তাতেই তিনি প্রথম তুলে ধরলেন ‘বন্দে মাতরম্’-এর প্রসঙ্গ। সেই সময় দেশবাসীর কাছে সামান্য একটা আর্জি রেখেছিলেন মোদী। তিনি বলেছিলেন, ‘সার্ধশতবর্ষ পূর্তি হতে চলেছে বন্দে মাতরম, তাই দেশজুড়ে উদযাপন করতে হবে।

৭ নভেম্বর, ২০২৫। এই এক মাস আগের কথা। বন্দে মাতরম গানের ১৫০ বছর পূর্তিতে নয়াদিল্লির বুকে ইন্দিরা গান্ধী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত হয়েছিল একটি অনুষ্ঠান। যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখান থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটালেন তিনি। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বন্দে মাতরম্কে ‘খণ্ডিত’ করার অভিযোগ তুললেন তিনি। বললেন, ‘১৯৩৭ সালে বন্দে মাতরম থেকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তবক বাদ দেওয়া হয়েছিল। বন্দে মাতরম গানকে খণ্ডে খণ্ডে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। দেশভাগের বীজটাও ঠিক সেই সময় বপন করা হয়েছিল।’

প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ কংগ্রেস মানেনি। নিজেদের মতো যুক্তি দিয়েছিল তাঁরা। তবে গোটা বিষয়টি আপাতত ভাবে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শীতকালীন অধিবেশনের হাত ধরেই নতুন মাথা চাড়া দেওয়ার জায়গা পেল এই বিষয়টি। সংসদের আলোচনায় ঠাঁই হল ‘বন্দে মাতরমে্র’। কেউ কেউ বলছেন, এই ঘটনা সম্ভবত ৭৫ বছরের স্বাধীন ভারতে প্রথমবারই হয়েছে।

সংসদে ‘বন্দে মাতরম্’

সোমবার সংসদের নিম্নকক্ষে মোদীর হাত ধরেই শুরু হল ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে আলোচনা। তিনি বললেন, তোপ দাগলেন, তথ্য দেখালেন। একটাই অভিযোগ, যে ‘বন্দে মাতরম্’ গানের মধ্য়ে জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পূর্ণ রসদ ছিল। সেই ‘বন্দে মাতরম্’ থেকে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্তবক ছাঁটাই করে দেওয়া হল? এই প্রসঙ্গে গান্ধীজির একটি লেখাও তুলে ধরেন মোদী।

এদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি প্রতিবেদনে গান্ধীজি লিখেছিলেন, এই গান এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে মনে হচ্ছে, এটা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। এই গান সত্যিই মহান। অন্য রাষ্ট্রগানের থেকে বেশি মধুর।’ তাঁর সংযোজন, ‘যে গানকে গান্ধীজি জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে দেখলেন, সেটির সঙ্গে কংগ্রেস কেন এমন অন্যায় করল কেন?’

এই ‘অন্যায়ের’ দায়টা সম্পূর্ণ ভাবেই জওহরলাল নেহরুর দিকে ঠেলে দেন মোদী। তাঁর কথায়, মুসলিম লিগের উস্কানি, প্ররোচনা এবং সর্বোপরি জাতীয় গানের বিরোধিতা মাথা পেতে মেনে নিয়েছিলেন নেহরু। স্বাভাবিক নিয়মেই এই অভিযোগ মানেনি কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রীর তুলে ধরা তথ্যগুলিকে ‘অর্ধ সত্য’ বলে দাগিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। তাঁর কথায়, ‘উনি নেতাজি এবং নেহরুর চিঠি পড়েছেন তবে পূর্ণ নয়।’  প্রিয়ঙ্কা আরেকটি চিঠির কথা উল্লেখ করেন। তাঁর দাবি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা সেই কবিতার কিছু স্তবক বাদ দেওয়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জওহরলাল নেহরুর মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। রবি ঠাকুর স্তবক বাদ দেওয়ার কথা বলেছিলেন।

অতীত নয়, ইতিহাস

১৯৩৭ সাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি লিখলেন কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুকে। তাতে তিনি লিখলেন, ‘বন্দে মাতরম্ ব্যাপারটা  নিয়ে বাঙালি হিন্দু সমাজে যে উন্মত্ত বিক্ষোভের আলোড়ন উঠেছে, আমার বুদ্ধিতে এ আমি কখনও কল্পনাও করিনি।’ এই চিঠির প্রসঙ্গ ছিল কংগ্রেস সভায় বঙ্কিমচন্দ্রের গান ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়া উচিত কি না। মুসলনমানদের পক্ষ থেকে এই গানকে নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। কারণ এই গানের প্রথম দুই স্তবকের পর নানা পৌত্তলিক শব্দে দেশমাতার আরাধনা হয়েছে, কিন্তু এই পৌত্তিলিকতা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধ। তাছাড়া, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে গানটির ব্য়বহার যে প্রসঙ্গে উঠে এসেছে, তা নিয়ে মুসলিমদের মধ্য়ে একটি বিরোধিতা রয়েছে।

এই প্রসঙ্গে জিন্নাহর দিকটাও তুলে ধরা প্রয়োজন। ১৯৩৮ সালে সিন্ধ প্রদেশে করাচিতে আয়োজিত মুসলিম লিগের কনফারেন্সে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস বন্দে মাতরম গান দিয়ে আইনসভা শুরু করেছিল। যা কেবল মূর্তিপুজো নয় বরং মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর একটি স্তোত্রও বটে।’ এই বিরোধিতা কারওর চোখে ন্যায, কারওর চোখে ভুল হতেই পারে। তবে ঐতিহাসিক দিক থেকে এই ঘটনা এবং মন্তব্য়ের গুরুত্ব কম নয়। বিশেষ করে ‘বন্দে মাতরম’ রচনার দেড়শো বছর পর যখন সেটিকে ঘিরে ফের বিতর্কের জন্ম নিয়েছে, তখন এই মন্তব্যও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেক মতে, বর্তমানে বিজেপি নেতা-নেত্রীরা ‘বন্দে মাতরম্’ প্রসঙ্গে দু’টি ইস্যুকে বারংবার টেনে তুলে আনার চেষ্টা করছেন। একটা সরাসরি, অন্যটা ইঙ্গিতে। প্রথম ইস্যু ‘বন্দে মাতরমে্র’ স্তবক বাদ পড়া। দ্বিতীয় ‘বন্দে মাতরম্’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে তুলে ধরা। দুই পক্ষের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বন্দে মাতরমে্র স্তবক বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ ভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

এই প্রসঙ্গে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, বন্দে মাতরম নিয়ে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস এবং রবি ঠাকুরের মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। আলোচনা হয়েছিল নেহরুর সঙ্গেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেহরুকে এই প্রসঙ্গে একটি চিঠি লিখেছিলেন। যাঁর সারমর্ম হল, ‘বন্দে মাতরমের প্রথম অংশে প্রকাশিত মাতৃভূমির যে ব্যাখ্যা রয়েছে, তা অবিনশ্বর। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার মতো নয় যে গোটা কবিতার ভাবনা, বার্তা মুসলিমদের মনে আঘাত তৈরি করতে পারে। যেহেতু এই কবিতার প্রথম অংশের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের যোগ রয়েছে, তাই গোটা কবিতাকে তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। ওই অংশের স্বতন্ত্র ভাবনা রয়েছে। যা অনেকটাই আনন্দমঠের কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত।’

অবশ্য বেশ কিছু ঐতিহাসিকের মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন না, বন্দে মাতরম্-এর ওই বিতর্কিত স্তবকগুলিতে খুব বেশিও পৌত্তলিকতা রয়েছে। ১৮৭৫ সালে এই কবিতা লেখা হয়, কয়েক বছর পর আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেখান থেকে তুলে নিয়ে ওই কবিতাকে গানের সুর দিয়েছিলেন  খোদ রবি ঠাকুরই। ১৮৯৬ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে এই গান সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই এই গানকে স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু তবুও কেন ১৯৩৭ সালে তিনি এই মত দিলেন? অনেকের মতে, রবি ঠাকুর দূরদর্শী ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের পর একদিকে হিন্দুবাদী রাজনীতি, অন্যদিকে মুসলিম লিগের বাড়বাড়ন্ত। এই দুই মেরুর মাঝে যে বন্দে মাতরমকে পড়তে হবে, তা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। এই ভাবনাই হয়তো কাজ করেছিল সেই সময়ও।

জাতীয় সঙ্গীতের দৌড়

বন্দে মাতরম্-কে জাতীয় সঙ্গীত করার পক্ষে সংসদে কথা না উঠলেও, তা উঠেছে বিজেপি নেতা-নেত্রীদের মুখে। এই গানের মধ্যে জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার ‘পূর্ণ রসদ’ ছিল বলেই মত গেরুয়া শিবিরের। তা হলে সেই দৌড়ে কেন পিছিয়ে পড়ল? ধর্মীয় মেরুকরণ কি কারণ? বলে রাখা প্রয়োজন, এই জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণের নেপথ্য়ে নেহরু ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের মধ্যে বেশ কিছু চিঠি চালাচালিও হয়েছিল। প্রাক্তন আমলা সরোজ চক্রবর্তীর লেখা ‘মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে সেটি উল্লেখ রয়েছে।

১৯৪৮ সালের ১৪ই জুন, বিধানচন্দ্র রায় চিঠিতে জওহরলাল নেহরুকে লিখছেন, ‘জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘জনগণমন’ ব্যবহার করা কি আপনার নির্দেশ নাকি এ বিষয়ে আপনি আমাদের মতামত জানতে চাইছেন? যদি এটা নির্দেশ হয় তবে আমাদের এই প্রসঙ্গে কিছু বলার নেই। কিন্তু যদি মতামত জানতে চাইলে আমরা বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভার মতে, জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার ব্যাপারে ‘বন্দে মাতরম্’ এর দাবি যে অনেক বেশি, সেটা বিবেচনা করে দেখা উচিত।’

তাঁর সংযোজন, ‘রবীন্দ্রনাথের উপর আমাদের বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভা একযোগে বলেছে, ‘বন্দে মাতরম্’-ই জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত। আমাদের এ-ও সন্দেহ নেই যে, আমরা এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মতামতই ব্যক্ত করছি।’

এই চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন নেহরু। তিনি লিখেছিলেন, ‘বন্দে মাতরম্’-এর ব্যাপারে কয়েকজন মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ যে আপত্তি করছেন, সেটাও কোনও কাজের কথা নয়। এই চিন্তাটা এখানকার অনেককেই প্রভাবিত করতে পারেনি। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই, এবং তার সঙ্গে আমিও বিশেষ করে অনুভব করি, এখনকার পরিস্থিতিতে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘বন্দে মাতরম্’ একেবারেই খাপ খাচ্ছে না। জাতীয় সঙ্গীত এমনই হবে, যাতে জয়ের কথা থাকবে, আশাপূরণের কথা থাকবে, অতীতে কী সংগ্রাম করা হয়েছে, তার কথা নয়।’

জাতীয় সঙ্গীতের দৌড়ে বন্দে মাতরম যে অন্যতম দাবিদার ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ভারতভাগ্যবিধাতা ছিল তার উপরে। এর আরও একটি অন্যতম কারণ ছিল রবি ঠাকুরের ‘জন-গণ-মন’তে বর্ণিত অবিভক্ত ভারতের কথা। যা সেই সময় দাঁড়িয়ে মানুষের মন যেন একটু  বেশিই ছুঁয়ে গিয়েছিল। এমনকি ছুঁয়ে যায় আজও।