করোনার গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? উদাসীন নেতা-মন্ত্রীরা, উদ্বেগে চিকিৎসকরা
"এটা দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়। কেন্দ্র, রাজ্য, রাজনৈতিক দলগুলি- সব পক্ষেরই দ্বিচারিতা। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরাই নিয়মবিধি ভেঙে প্রচার করছেন। নির্দেশ কার্যকরী করতে গেলে যে ধরনের প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা উচিত তা তো করা হচ্ছে না।"
সৌরভ দত্ত ও সৌরভ গুহ: রাজধানী সীমান্তে কৃষকদের জমায়েত করে আন্দোলন করা উচিত কিনা, এ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার সওয়াল ছিল, কৃষকরা যখন আন্দোলন শেষে ঘরে ফিরে যাবে, পঞ্জাব, হরিয়ানার মতো রাজ্যে করোনার (COVID) প্রকোপে মহামারীর আকার নেবে। সলিসিটর জেনারেলের এই উদ্বেগ নেহাতই ফেলে দেওয়ার নয়। কৃষকদের জমায়েতে করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে। এই বিষয় যেমন উদ্বেগের, তেমনই প্রতিদিন নিয়ম করে রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে কাতারে কাতারে মানুষের ভিড় আরও বিপজ্জনক। বিশেষ করে বাংলায়। একুশের নির্বাচনে এই বঙ্গে রাজনৈতিক পারদ যেভাবে চড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনার সংক্রমণের উদ্বেগও।
ইতিমধ্যেই, করোনা সংক্রমণ রোধে বর্ষশেষের উৎসবে রাশ টানার জন্য রাজ্যগুলিকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্র। পত্রপ্রাপ্তির চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একই দায়িত্বপালনের কথা স্মরণ করিয়ে নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টও। কিন্তু চিকিৎসক তথা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে!
একদিকে নিম্নমুখী পারদ, তার উপরে চাপ বাড়াচ্ছে ব্রিটেনের নতুন স্ট্রেন। চাপবৃদ্ধির আবহে রাজ্যগুলির কাছে চিঠি পাঠিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অজয় ভল্লা বর্ষবরণের সপ্তাহে মাস্কের ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। চিকিৎসকদের বক্তব্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সভা-পদযাত্রাতেই কোভিড সতর্কতা তো রক্ষ্মণহীন হয়ে পড়েছিল। উল্টোদিকে বর্ষবরণের সপ্তাহে সান্তা ক্লজের মাস্ক পরিহিত ছবি দিয়ে সতর্কবিধি মেনে চলার বার্তা দিয়ে টুইট করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু বোলপুরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদযাত্রাতেই তো শিকেয় উঠেছে সংক্রমণ আটকানোর আবশ্যিক শর্তগুলি।
অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, “এটা দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়। কেন্দ্র, রাজ্য, রাজনৈতিক দলগুলি- সব পক্ষেরই দ্বিচারিতা। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরাই নিয়মবিধি ভেঙে প্রচার করছেন। নির্দেশ কার্যকরী করতে গেলে যে ধরনের প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা উচিত তা তো করা হচ্ছে না। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, শুধু চিঠি বা আবেদনে সীমাবদ্ধ থাকলে সুফল মেলে না।”
এ সব প্রশ্নে বরাবরই সমালোচকের ভূমিকায় থাকা বামেরাও নিজেদের তৃণমূল-বিজেপি থেকে নিজেদের আলাদা করতে পারেনি। আগামী নির্বাচনে বামেদের জোটসঙ্গী কংগ্রেসও ব্যতিক্রম নয়। মঙ্গলবারই রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বাম-কংগ্রেসের যৌথ সভা ছিল। ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের তরফে পুণ্যব্রত গুণ বলছেন, “রাজনৈতিক সমাবেশের সঙ্গে কৃষক সমাবেশকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। কৃষকদের সমাবেশ তা নয়। লকডাউনের সুযোগে কেন্দ্রের সরকার কিছু কালা কানুন নামিয়ে এনেছে। সেই কালা কানুনের বিরোধিতা করছেন মানুষ। ওই আইন থাকলে করোনার চেয়েও বেশি ক্ষতি হবে।”
তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বন্ধ না হলে নির্দেশিকা জারির যে কোনও অর্থ নেই, সে কথাও জানাতে ভোলেননি চিকিৎসক সংগঠনের প্রতিনিধি। সরকারি চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, “করোনার দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা নিম্নমুখী হলেও তা ক্ষণস্থায়ী মধুচন্দ্রিমা ভাবাই ভাল। মাস্কবিহীন উন্মাদনায় সামিল হলে দু’দিন বাদে আবার যে নতজানু হয়ে জীবন ভিক্ষা করব না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই!” রাজ্যের করোনা টাস্ক ফোর্সের অন্যতম সদস্য-চিকিৎসক সৌমিত্র ঘোষ বলেন, “এখন আপাতদৃষ্টিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কম দেখালেও লোকের আনন্দ, পিকনিকের ঠেলায় তা বেড়ে যেতে পারে। করোনা নিয়ন্ত্রণে যাতে কোনও রকম শিথিলতা দেখানো না হয় তা নিশ্চিত করা জরুরি।” চিকিৎসকদের উদ্বেগ নিরসনে কী বলছেন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা?
আরও পড়ুন: গঙ্গাসাগর মেলার সঙ্গে যুক্ত সকল কর্মীদের কোভিড বিমার ব্যবস্থা করছে রাজ্য
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। মহারাষ্ট্র সরকার তো আগেই জানিয়েছে ওরা বর্ষবরণের উৎসব করতে দেবে না। তাছাড়া এটা তো আর পঁচিশে ডিসেম্বরের মতো কোনও ধর্মীয় ব্যাপার নয়।” বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর পর্যবেক্ষণ, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে মিটিং-মিছিল করলে বর্ষবরণের উৎসব কী দোষ করল! অন্য দল সভা করতে গেলে মুখ্যমন্ত্রী বলছে অনুমতি দেওয়া যাবে না। আর নিজে মিছিল করছেন। যেমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেমন মুখ্যমন্ত্রী। আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখাও বলার অধিকার কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার হারিয়ে ফেলেছে।” এ প্রশ্নে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী বলেন, “নিজেরা কী করছি সেটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আগে দেখি। সাধারণ মানুষ আমাদের চেয়ে যে অনেক বেশি সচেতন তা দুর্গোৎসবে প্রমাণিত।আমরা যেন সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দিতে না যাই। কারণ আমরা নিজেরা যা বলি তার উল্টো করি। এটা আমিও করি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও করেন, অমিত শাহও করেন।”