Primary: কীভাবে হবে প্রাথমিকে সেমিস্টার? পাশ-ফেল থাকবে? রইল সব উত্তর
Primary: বাংলার প্রাথমিক স্কুলগুলোর তথৈবচ অবস্থা। পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই বলে অভিযোগ। হাতে কলমে এই পদ্ধতি আদৌ কি কাজ করবে? এমনই আরও অনেক প্রশ্ন উঠেছে।
কলকাতা: ‘ক্রেডিট বেসড সেমিস্টার সিস্টেম’। ক্ষুদে পড়ুয়াদের জন্য় একটা গালভরা নাম। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের জন্য সদ্য যে ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তার নামই এটা। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি গৌতম পাল সম্প্রতি সাংবাদিক বৈঠক করে নতুন ব্যবস্থার কথা জানিয়েছেন। এতদিন পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল, এটা তার থেকে অনেকটাই আলাদা। মূলত কেন্দ্রীয় শিক্ষা নীতি অনুসারে প্রাথমিকে এই বড় বদল আনা হয়েছে। ২০২৫ সালে যে শিক্ষাবর্ষ শুরু হচ্ছে, তাতেই এই পরিবর্তন কার্যকর হবে। তার আগে পুরো বিষয়টা জেনে নেওয়া জরুরি। ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, কী লাভ হবে এই বদল এনে? বর্তমান সাম্প্রতিক পরিকাঠামোতে এই নতুন ব্যবস্থা আদৌ সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন শিক্ষাবিদরা।
‘সেমিস্টার সিস্টেম’ আসলে কেমন হবে?
‘সেমিস্টার’ শব্দটির সঙ্গে বর্তমানে অনেকেই পরিচিত। প্রাথমিকভাবে রাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যবস্থা চালু ছিল। বর্তমানে রাজ্যের প্রায় সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতিতেই পরীক্ষা হয়। অতি সম্প্রতি একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতেও চালু করা হয়েছে এই প্রথা। এই ব্যবস্থায় পুরো সিলেবাসকে দু’ভাগ করে বছরে দুটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে বছর শেষে একজন পড়ুয়ার ওপর পুরো সিলেবাসের বোঝা থাকে না, পাশাপাশি সিলেবাসের প্রতিটি অংশ ভালভাবে পড়া হয় বলেই মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ ঘোষণা করেছে, এবার থেকে প্রাথমিকে অর্থাৎ প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্ষেত্রেও সেমিস্টার সিস্টেমেই পরীক্ষা হবে। জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত পড়াশোনার পর জুনে হবে প্রথম সেমিস্টার। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঠ শেষে হবে দ্বিতীয় সেমিস্টার।
সেমিস্টারের পাশাপাশি যে বিষয়টা চালু করা হচ্ছে, তা হল ক্রেডিট স্কোর। এই স্কোর পড়ুয়াদের সারাজীবনের জন্য কাজে লাগবে। প্রত্যেক ক্লাসের জন্য বরাদ্দ থাকবে ১০০ নম্বর। প্রথম ৪০ সেমিস্টার হবে ৪০ নম্বরের। সেখানে ক্লাসরুম ও ক্লাসরুমের বাইরের কর্মসূচিতে গুরুত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ দৈনন্দিন পড়াশোনায় মনোযোগের ভিত্তিতে ওই ৪০ নম্বর দেওয়া হবে। আর ৬০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হবে। এই ৬০ নম্বরের মধ্যে ১৫ নম্বর থাকবে এমসিকিউ (MCQ), ২০ নম্বর এসএকিউ (SAQ), ২৫ নম্বরের বড় প্রশ্ন থাকবে।
প্রাথমিকে মোট ৫টি বিষয় পড়ানো হয়। এর মধ্যে দুটি ভাষা রয়েছে (বাংলা ও ইংরেজি), রয়েছে অঙ্ক, পরিবেশ, স্বাস্থ্য় ও শারীর শিক্ষা।
ক্রেডিট স্কোর কী?
দেশের মধ্যে একমাত্র অন্ধ্র প্রদেশে এই ক্রেডিট স্কোর দেওয়ার প্রথা চালু আছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। একজন ছাত্র বা ছাত্রী ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে কি না, সেটার উপর নির্ভর করবে, তার ক্রেডিট স্কোর ঠিক কত হবে। সারা বছর কোন বিষয়ে, কত ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে কিছু ক্রেডিট স্কোর ধার্য করা হবে। আর সেই স্কোর পড়ুয়ার সঙ্গে থেকে যাবে সারাজীবন। প্রত্যেক পড়ুয়ার নামে একটি ইউনিক নম্বর ও আলাদা প্রোফাইল তৈরি করা হবে। ব্যাঙ্কের নিয়মের মতোই প্রত্যেকের নামে থাকবে আলাদা আলাদা ক্রেডিট স্কোর। সেটা ওই প্রোফাইলে জমা থাকবে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে ৮০০ ঘণ্টা ক্লাস করতে হবে। আর ওই ৮০০ ঘণ্টার জন্য ২৭ ক্রেডিট স্কোর ধার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ ৮০০ ঘণ্টা মন দিয়ে পড়লে, হোমওয়ার্ক করলে, শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিলে ২৭ নম্বর পর্যন্ত পাওয়া যাবে। একইভাবে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের ক্লাস করতে হবে ১০০০ ঘণ্টা, যার জন্য ধার্য করা হয়েছে ৩৩ ক্রেডিট স্কোর।
তবে এই পুরো ব্যবস্থায় আগের মতোই পাশ-ফেল প্রথা থাকছে না। অর্থাৎ প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সবাই উত্তীর্ণ হবে।
কেন এই ব্যবস্থা?
কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। তবে রাজ্য সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থা কার্যকর করেছে। আসলে কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতিতে বরাবর সিলেবাসের বাইরে পড়াশোনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও সেটাই মাথায় রাখা হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদদের একাংশ।
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে আগেও পাশ-ফেল পদ্ধতি ছিল না, এখনও নেই। তাহলে নতুন ব্যবস্থা করলে কি আলাদা করে কোনও তৎপরতা তৈরি হবে? পর্ষদের ব্যাখ্যা হল, এই নতুন পদ্ধতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি হবে। সিলেবাসের বাইরে পড়াশোনা করলে পড়ুয়াদের জ্ঞানও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। সেখানেও এই ব্যবস্থা জারি রয়েছে। উল্লেখ্য, ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্তও চালু করা হতে পারে সেমিস্টার পদ্ধতি। সেই পরিকল্পনাও রয়েছে রাজ্য সরকারের।
কী কী প্রশ্ন উঠছে?
১. বাংলার প্রাথমিক স্কুলগুলোর তথৈবচ অবস্থা। পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই বলে অভিযোগ। হাতে কলমে এই পদ্ধতি আদৌ কি কাজ করবে?
২. স্কুল বিল্ডিংয়ের হাল খারাপ। ন্যূনতম পরিকাঠামো না জোগান দিয়ে পাশ্চাত্যের অনুকরণ ফলপ্রসূ হবে?
৩. প্রত্যেক স্কুলে প্রয়োজনীয় কম্পিউটার নেই। নম্বর থেকে ক্রেডিটের হিসেব করে মূল্যায়ন কি আদৌ সম্ভব?
এই ব্যবস্থা আদতে কতটা কার্যকর হবে? কী লাভ হবে?
হুগলির প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি মানস রঞ্জন ভঞ্জ এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, স্কুলগুলির অবস্থা। তিনি বলছেন, “স্কুলগুলিতে না আসে কোনও অর্থ সাহায্য, না আছে পর্যাপ্ত শিক্ষক। তিনি জানিয়েছেন, স্কুলগুলির ইলেকট্রিক বিল মেটাতে হয় স্কুলের নিজের টাকা দিয়ে। আগে প্রধান শিক্ষকরা যে গ্র্যান্ড পেতেন, সেটাও বন্ধ। এমনকী চক-ডাস্টার কেনার টাকাটুকু আসে না।” সেখানে পাশ্চাত্যের অনুকরণে এমন ব্যবস্থা চালু করার কথা কীভাবে ভাবা হচ্ছে, তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি।
নতুন সিলেবাস কী হবে, সেই নিয়ম নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত শিক্ষক মহল। তার মধ্যেই ব্যবস্থা বদলে উঠছে প্রশ্ন। সেমিস্টার ঘোষণার পরও অভিভাবকরা মনে করছেন সরকারি বিদ্যালয়ে পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে, তুলনামূলকভাবে বেসরকারি শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিকাঠামো অনেক ভাল।
বড়দের ‘ওষুধে’র ডোজই প্রয়োগ ছোটদের উপর!
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই একই সিস্টেম চালু করা হয়েছে। তবে সেই পদ্ধতি সবেমাত্র শুরু করা হয়েছে। পদ্ধতির প্রভাব এখনও স্পষ্ট নয়। আর সেই একই পদ্ধতি চালু করে দেওয়া হচ্ছে ছোটদের ওপর। এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েই এই পদ্ধতির ফল পাওয়া গিয়েছে। তাহলে ছোটদের উপর যে সেমিস্টার বা ক্রেডিট স্কোর বোঝা হয়ে চাপবে না, তা কে বলতে পারে!
অধ্যাপক চন্দন মাইতি বলেন, “একাদশ-দ্বাদশে এই ব্যবস্থা চালু হলেও এখনও পর্যন্ত কোনও ফল পাওয়া যায়নি। ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক প্রভাব বোঝা যাচ্ছে না। কোনও অভিজ্ঞতা নেই। তার মধ্যে শিশুদের জন্য এমন একটি সিদ্ধান্ত প্রিম্যাচিওর।” পঠন-পাঠন নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এই ব্যবস্থায় পিছনের দিকে নিয়ে চলে যেতে পারে।