ব্লগারদের ‘সিরিয়াল কিলার’ আনসারুল্লা বাংলা টিম কি ঘুমিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গে?

Ansarullah Bangla Team: বাংলাদেশে একের পর এক উদারপন্থী, নিরপেক্ষ মনস্ক ব্লগারদের খুন করার রেকর্ড রয়েছে এই সংগঠনের। রাজীব হায়দার, আসিফ মহিনুদ্দিন, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাস, শাফিউল ইসলাম, ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার পিছনে হাত ছিল এই এবিটি-র।

ব্লগারদের 'সিরিয়াল কিলার' আনসারুল্লা বাংলা টিম কি ঘুমিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গে?
Image Credit source: GFX- TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Dec 26, 2024 | 7:32 PM

সালটা ২০১৫। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় চলছে বইমেলা। সন্ধ্যায় বাড়ছে বইপ্রেমীদের ভিড়। হঠাৎ আর্তনাদ। জমে গেল ভিড়। বইমেলার গেটের ঠিক বাইরে পড়ে আছে এক পুরুষ ও এক মহিলা। রক্তে ভিজে যাচ্ছে গোটা শরীর। কোনও রকমে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সে দিন বাঁচেননি সেই অভিজিৎ রায়। যমে-মানুষে লড়াইয়ের পর বেঁচে ফেরেন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। বিজ্ঞান, যুক্তি, নাস্তিকতার কথা বলতেন মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়। সেটাই ছিল তাঁর অপরাধ। তাঁকে যারা সে দিন সরিয়ে দিয়েছিল, তারাই হল আনসারুল্লা বাংলা টিম।

গত কয়েকদিনে পশ্চিমবঙ্গ ও প্রতিবেশী রাজ্য অসম থেকে সেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর তাতেই ভারতে বাড়ছে উদ্বেগ।

কারা এই আনসারুল্লা বাংলা টিম?

বাংলাদেশে উত্থান হলেও এর পাকিস্তান-যোগ প্রবল। এই জঙ্গি সংগঠনকে সমর্থন জোগায় বিন লাদেনের সংগঠন আল-কায়েদা। বিগত প্রায় এক দশক ধরে চলছে তাদের কর্মকাণ্ড, বলা ভাল ‘হত্যালীলা’। টার্গেট স্থির করে, জনসমক্ষে মেরে ফেলতে হাত কাঁপে না, এমনই ট্রেনিং দেওয়া হয় টিমের সদস্যদের। অস্ত্র চালানো, বোমা বানানোয় তারা সিদ্ধহস্ত। ‘আনসারুল্লা বাংলা টিম’ নামে পরিচিতি বেশি হলেও এই সংগঠনের অপর নাম হল ‘আনসার-আল ইসলাম বাংলাদেশ’। ‘আনসার বাংলা’ নামেও পরিচিত এই সংগঠন।

এই সংগঠনের মাথার নাম মহম্মদ জসিমুদ্দিন রহমানি। ২০১৩ সালে তাঁর উত্থানের কথা জানা যায়। তলে তলে প্রায় ৫ বছর ধরে জঙ্গি সংগঠন তৈরি করছিলেন তিনি। তারপর একের পর এক খুন, ব্যাঙ্ক ডাকাতির মতো ঘটনা সামনে এসেছে, যাতে এবিটি-র হাত স্পষ্ট। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে ‘নিষিদ্ধ’ বলে ঘোষণা করা হয় এই জঙ্গি সংগঠনকে।

কেন নিশানায় ভারত?

গোয়েন্দা রিপোর্টে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে ভারতের একটা অংশ বরাবরই রয়েছে এই এবিটি-র নিশানায়। ২০২২ থেকে এই ‘আনসারুল্লা বাংলা টিম’-এর পাশে দাঁড়িয়েছে লস্কর-ই-তইবাও। উদ্দেশ্য, ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশকে তছনছ করে দেওয়া। ২০২২-এর একটি গোয়েন্দার রিপোর্টে এও জানা যায় যে, ত্রিপুরায় কর্মকাণ্ড চালাতে তৈরি অন্তত ৫০ থেকে ১০০ জঙ্গি।

সম্প্রতি যেভাবে পশ্চিমবঙ্গ ও অসম থেকে একের পর এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাতে বাড়ছে আতঙ্ক, সেই রিপোর্টগুলি কি সত্যি হতে চলেছে? কিছুদিন আগেই অসমের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছিলেন, ‘আনসারুল্লা বাংলা টিম’ কোনও সাধারণ সংগঠন নয়, এদের কাছে রয়েছে অনেক আধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইস রয়েছে। আর সেগুলি ধরাও বেশ কঠিন!

কতটা ক্ষমতা? কী কী ঘটাতে পারে ‘আনসারুল্লা বাংলা টিম’

বাংলা ও অসমে পরপর জঙ্গি ধরা পড়ছে। অসমের কোকরাঝাড়ে তাদের ডেরায় মিলেছে রাইফেল, টাইমার বোমা বানানোর সরঞ্জাম, বিদ্যুতের তার-সুইচ, কার্তুজ, স্প্লিন্টার। দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সবরকম ভাবে তৈরি হচ্ছে ‘টিম’। অনেকেই বলছেন, ভারতের নেতা-মন্ত্রীদের নিশানা করে মারতে পারে আনসাররা। কেউ আবার বলছে, আরও বড় কোনও ছক। সংগঠনের পুরনো রেকর্ডই বলে দেবে, ঠিক কী কী ঘটাতে পারে এই টিম।

বাংলাদেশে একের পর এক উদারপন্থী, নিরপেক্ষ মনস্ক ব্লগারদের খুন করার রেকর্ড রয়েছে এই সংগঠনের। রাজীব হায়দার, আসিফ মহিনুদ্দিন, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাস, শাফিউল ইসলাম, ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার পিছনে হাত ছিল এই এবিটি-র।

শুধু খুন নয়, দিনে-দুপুরে ব্যাঙ্কে ঢুকে ডাকাতির ঘটনাও ঘটিয়েছে এরা। ‘বাংলাদেশ কমার্স ব্যাঙ্ক লিমিটেড’-এর একটি শাখায় ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল। সেটা ছিল ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল। দুপুরে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়েছিল ৮-১০ জন। বাধা দিতে গেলে একে একে অস্ত্রের কোপ বসিয়ে দেওয়া হয়। মৃত্যু হয় ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, নিরাপত্তা আধিকারিক ও এক গ্রাহকের। পালানোর সময়ও এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে চালাতে চলে গিয়েছিল আনসাররা। ছোড়া হয়েছিল গ্রেনেড। আশপাশে আহত হয়েছিলেন বহু মানুষ। ব্যাঙ্কের বাইরেও কয়েকজনের মৃত্যু হয়। ৯ জনকে ওরা মেরে ফেলেছিল সেই অপারেশনে। সেই ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ সরকার।

উদারপন্থীদের মেরে সাফ করে দেওয়াই ওদের লক্ষ্য?

ব্লগার অভিজিৎ রায় উদারপন্থী হিসেবে বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। মুক্তমনা নামে এক গোষ্ঠী তিনিই তৈরি করেছিলেন উদারপন্থীদের জন্য। ধর্ম বিশ্বাস, নিরপেক্ষতা নিয়ে একাধিক বইও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। অভিজিতের নাম যখন দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনই শেষ করে দেওয়া হয় তাঁকে।

এই আনসারুল্লা বাংলা টিমের হত্যালীলার শিকার হয়েছিলেন জুলহাজ মান্নান। বাংলাদেশে প্রথম এলজিবিটি ম্যাগাজিন চালু হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। পত্রিকার নাম ছিল ‘রূপবাণ’। তাঁকেও টার্গেট করে নেয় এই আনসাররা। নিজের অ্যাপার্টমেন্টেই খুন হন ৩৯ বছর বয়সী জুলহাজ। মেরে ফেলা হয় তাঁর সঙ্গী, এলজিবিটি অ্যাকটিভিস্ট মেহবুব রবি তনয়কেও। তবে বাংলাদেশে আনসারদের প্রথম শিকার ছিলেন রাজীব হায়দার। গণ জাগরণ মঞ্চের কর্মী। নাস্তিক। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কলম ধরা ছেলেটিকে একেবারেই পছন্দ ছিল না আনসারদের। ধারাল অস্ত্রের কোপে শেষ করে দেওয়া হয় তাঁকেও। তালিকা আরও অনেক লম্বা। তবে প্রশ্ন হল, বাংলাদেশে নাস্তিকরা টার্গেট, ভারতে তাহলে কারা?

ছাড়া পেয়েই গর্জাচ্ছেন জসিমুদ্দিন রহমানি

বাংলাদেশের ধানমণ্ডির হাতেমবাগ মসজিদের ইমাম ছিলেন জসিমুদ্দিন রহমানি। তারপর ধর্মগুরু আস্তে আস্তে বদলে গেলেন ‘জঙ্গি-গুরু’ তে। তাঁর নির্দেশেই চলেছে অনেক হত্যাকাণ্ড। তবে রাজীব হায়দার খুনের ঘটনায় পার পাননি তিনি। জেলে যেতে হয় রহমানিকে। আর মহম্মদ ইউনূস চেয়ারে বসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সেই জঙ্গি নেতাকে। পাঁচ বছর জেলে থেকেছেন তিনি। তাঁর মুক্তি উদ্বেগ বাড়িয়েছে গোয়েন্দাদের।

ছাড়া পাওয়ার পর ভারতকে সরাসরি হুমকি দিতে শোনা যাচ্ছে তাঁকে। ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োতে তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমি ভারতকে সতর্ক করছি। বাংলাদেশ সিকিম বা ভুটানের মতো নয়। এই দেশ ১৮ কোটি মুসলমানের দেশ। বাংলাদেশের দিকে এক পাও অগ্রসর হন, আমরা চিনকে বলব, যাতে তারা চিকেন নেক রুদ্ধ করে দেয়।’

শুরু হয়েছে অপারেশন প্রঘাত

অসম পুলিশ সম্প্রতি শুরু করেছে বিশেষ অভিযান, ‘অপারেশন প্রঘাত’। এবিটি-র স্লিপার সেলগুলি জাগিয়ে তোলা হচ্ছে বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। তাই অসম পুলিশ শুরু করেছে এই অভিযান। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে দুজনকে, কেরল থেকে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যিনি আবার মুর্শিদাবাদের ভোটার। আর বুধবার অসম থেকে দুজনকে গ্রেফতার করার পর তাদের ডেরা থেকে যে পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, তা দেখে চোখ কপালে পুলিশের। তদন্তকারীদের অনুমান, দীর্ঘদিন ধরে ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বকে নিশানা করে ছক তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অশান্তির আবহে ভারতকে নিশানা করে কি সত্যিই কোনও পরিকল্পনা করা হচ্ছে? এ ব্যাপারে সব রাজ্যের পুলিশ তথা গোয়েন্দাদের সতর্ক করা হয়েছে।