আঁধারে পুজো: এ ভাবেই ‘ঝুলায়’ দোল খেতে খেতেই সরস্বতীরা শিখে যায় জীবনের ব্যালেন্স
Jagadhatri Pujo 2021: বনবাসী লাল নট্ট, বিকাশ রাজ নট্ট আর সরস্বতী নট্ট। গোটা পরিবার সুদূর ছত্তীসগঢ় থেকে এসেছে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোয় ব্যালান্সের ভেলকি দেখিয়ে কিছু টাকা রোজগার করবে বলে
শু ভে ন্দু দে ব না থ:
‘লাগ ভেলকি লাগ ভেলকি আয়নবাজির ভেলকি লাগ জীবন নামের এই ছবিতে দুঃখ-সুখের নেই ফারাক।’
সরু দড়িটার উপর উঠলে পুরো পৃথিবীটাই বদলে যায় সরস্বতীর। আগে, পেছনে, ডাইনে বায়ে কোনওদিকেই তখন তাঁর নজর থাকে না। নজর থাকে না দড়ির ঠিক নীচেই রাখা এনামেলের থালাটায় কে কত টাকা দিল। সরু দড়িটাকেই সে তখন নিজের খেলার ময়দান মনে করে। তাঁর কথায় ওটা তাঁর ‘ঝুলা’। যেভাবে গ্রামের কিশোরী মেয়েরা আমবাগানে গাছে দড়ি বেঁধে দোল খায়, ঠিক সেভাবেই কখনও এক পায়ে, কখনও দু পায়ে, কখন দড়ির উপর একটা রিঙের সাহায্যে দু হাতে পাকা বাঁশের লাঠিতে ব্যালান্স করে দোলনায় দোল খায় সরস্বতী। জগদ্ধাত্রী পুজোর (Jagadhatri Puja) কাতারে কাতারে ভিড় যে তাঁকে দেখছে সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই তাঁর।
বনবাসী লাল নট্ট, বিকাশ রাজ নট্ট আর সরস্বতী নট্ট। গোটা পরিবার সুদূর ছত্তীসগঢ় থেকে এসেছে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোয় ব্যালান্সের ভেলকি দেখিয়ে কিছু টাকা রোজগার করবে বলে। ওদের কেউ বলে বানজারা বা বাংলায় যাযাবর, আবার কেই বলে সার্কাসওয়ালা। যে নামেই ওদের ডাকা হোক না কেনও ওদের কথায় ওরা বংশপরম্পরায় ‘কর্তব দিখানেওয়ালা’। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেলা উপলক্ষে কুড়ি-পঁচিশ জনের একটা দল চলে আসে। তারপর গোটা মেলায় চারজনের একটা দল করে ছড়িয়ে পড়ে। দুদিকে দুটো করে বাঁশের সাহায্যে একটা দড়ি টাঙানো, তার উপর লম্বা বাঁশের একটা লাঠি নিয়ে নানা রকম ভেল্কি দেখায় তারা।
বাড়ির বাচ্চাদের ট্রেনিং শুরু হয়ে যায় পাঁচ বছর বয়স থেকে। বছর পঁচিশের বনবাসীলালের কথায়, “এই ‘করতব’ দেখানো শুরু করেছিলাম পাঁচ বছর বয়স থেকে।” খুব একটা পড়াশোনার চল নেই তাদের মধ্যে। কেউ পড়তে চাইলে পড়ল, না হলে সোজা ঘাড় ধরে নামিয়ে দেওয়া হয় ট্রেনিংয়ে। পড়তে পড়তে হাত পায়ে চোট লাগতে লাগতে একদিন ঠিক শিখে যায় ব্যালান্স, ঠিক যেভাবে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তারা জীবনের ব্যালান্স শিখে যায়। সিরিয়ালে স্টান্ট দেখাতেও ভাড়া করা হয় তাদের, এমনকী বলিউডের সিনেমাতেও। কিন্তু কপালে খুব একটা কিছু জোটে না। খেলা তো সকলেই দাঁড়িয়ে উপভোগ করে এনামেলের থালাটায় জমা টাকার পরিমাণ জানান দেয় মানুষকে আনন্দ দেওয়ার দাম ওঠেনি।
টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা আগেই থাবা বসিয়েছিল তাঁদের রোজগার, আর এখন করোনার মার আরও কাঁটা ছড়িয়েছে তাঁদের পথে। খেলা দেখাতে কোনও মাঠে তাঁবু ফেললে উঠিয়ে দেওয়া হয়, অগত্যা রাস্তার যেখানে সেখানে বাঁশের ট্রপিজ ফেলে দেওয়া, রাস্তাতেই খেলা দেখানো। তাতেও নিস্তার কই! জগদ্ধাত্রী পুজো দর্শনার্থীদের কেউ সরস্বতীর খেলা চলার মাঝখানেই আস্ত বাইকটা নিয়ে পার্ক করিয়ে দেয় বাঁশের একদম গা ঘেঁষে। বাঁশে ধাক্কাও লাগে তার সামনের চাকাটা। সেই আগন্তুকের ভ্রুক্ষেপ নেই যে উপরে একটা মেয়ে ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে গিয়ে চোট পেতে পারে।উল্টে খিস্তি ধেয়ে আসে সেই আগন্তুকের দিক থেকে। তাঁর হুকুম, আরও সরে গিয়ে বাঁশের তাঁবু যেন লাগায়।। কিন্তু বেপরোয়া সরস্বতী তার প্রিয় ‘ঝুলায়’ দোল খেয়েই যাচ্ছে। যতক্ষণ না এনামেলের থালা পূর্ণ হচ্ছে, কারোর হুকুম তালিম না পসন্দ সরস্বতীর।
আরও পড়ুন: আঁধারে পুজো: ‘দেখলেই কেটলি কেড়ে নেব’,ম্যাডক্সে চা বিক্রি করতে গিয়ে তটস্থ নন্দীগ্রামের চাওয়ালা