কমলেশ চৌধুরী: রাজ্যে একদিনেই ২৭ জনের প্রাণ কেড়েছে বজ্রপাত (Lighting Strike)। কেন এমন বিপর্যয়?
মৌসম ভবনের ‘ময়নাতদন্ত’ বলছে, সোমবার বাংলার আকাশে তৈরি হয়েছিল ১৬ কিলোমিটার উঁচু বজ্রগর্ভ মেঘপুঞ্জ। মুহুর্মুহু বাজ পড়ে সেই কারণেই।
কত বাজ পড়েছে? ৩৮ হাজার ৫৬৮টি! ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট অবজার্ভিং সিস্টেমস প্রোমোশন কাউন্সিলের পর্যবেক্ষণ থেকে উঠে এসেছে ভয়াবহ এই তথ্য। মেঘ থেকে মাটিতে নেমে আসা বজ্রপাতটুকুই রয়েছে এই পরিসংখ্যানে। এ ছাড়াও রয়েছে মেঘের মধ্যে বজ্রপাত। অর্থাত্, আরও ২২ হাজার ৭৯৬টি। সবমিলিয়ে, ৬১ হাজার ৩৬৪টি। সবচেয়ে বেশি বিদ্যুত্ উত্পন্ন হয়েছে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার ৪৯৪ অ্যাম্পিয়ারের। সাধারণ বাড়িতে ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ আভেনের জন্য ১৬ অ্যাম্পিয়ারের সুইচ থাকে। এতেই স্পষ্ট, বজ্রপাতে সৃষ্ট বিদ্যুতের পরিমাণ কতটা বিপুল।
সোমবারের বিপর্যয়ের পর ঘুরে-ফিরে এসেছে একটিই প্রশ্ন, বজ্রপাত কি বাড়ছে? এরও উত্তর দিয়েছে ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট অবজার্ভিং সিস্টেমস প্রোমোশন কাউন্সিল। ২০১৯ সালে বাংলায় বাজ পড়েছিল ৭ লক্ষ ৬১ হাজার ৭২৮টি। ২০২০ সালে ৯৯.৭৬% বৃদ্ধি। এক বছরে বাজ পড়ে ১৫ লক্ষ ২১ হাজার ৭৮৬টি। এর মধ্যে রয়েছে মেঘ থেকে মাটিতে পড়া বাজ, রয়েছে মেঘের অন্দরে চালাচালি হওয়া বজ্রপাতও।
অঙ্কে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। একইসঙ্গে মনে প্রশ্ন, বাজের সংখ্যা মাপা হচ্ছে কী ভাবে? কাউন্সিলের আহ্বায়ক কর্নেল সঞ্জয় শ্রীবাস্তব বলেন, ‘মৌসম ভবন, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজি এবং ইসরো নেটওয়ার্ককে কাজে লাগানো হয়। ডপলার রেডার, ইনস্যাট থ্রি-ডি উপগ্রহের পাশাপাশি জাপানে হিমাবাড়ি উপগ্রহ থেকেও তথ্য পাই আমরা।’ মঙ্গলবার দিনভর তথ্য বিশ্লেষণে ব্যস্ত ছিলেন কর্নেল শ্রীবাস্তব ও তাঁর দল। তাঁর কথায়, ‘সাধারণত, ক্লাউড টু গ্রাউন্ডের চেয়ে ইন্টার ক্লাউড বজ্রপাত বা লাইটনিং বেশি হয়। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উল্টো। ৬৩% বজ্রপাতই হয়েছে মেঘ থেকে মাটিতে। এরকম তথ্য পেয়ে বেশ কয়েকবার বিশ্লেষণও করি আমরা। দেখা যায়, কোনও ভুলচুক নেই।’
মৌসম ভবনের পর্যবেক্ষণ, সোমবার পশ্চিমাঞ্চল থেকে উপকূলের দিকে এগোনোর সময় মেঘপুঞ্জ ‘ধনুক’-এর আকার নেয়। ‘ধনুক’ মেঘের জন্যই মুর্শিদাবাদ থেকে উপকূল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ঝড়-বৃষ্টি হয়। মৃত্যুও হয়েছে ৬টি জেলা জুড়ে। এর সঙ্গে আরও বিপদ ডেকেছে উল্লম্ব বজ্রগর্ভ মেঘের উচ্চতা। মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, উপমহানির্দেশক সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলার আকাশে কোনও কোনও জায়গায় ১৬ কিলোমিটার পর্যন্তও মেঘের উচ্চতা ছিল। এই ধরনের মেঘে বজ্রপাত অনেক বেশি হয়।’ শুধু বজ্রবিদ্যুত্-সহ বৃষ্টি নয়, ৫৯ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিবেগে কালবৈশাখীও হয় আলিপুরে। ঝড় হয় রাজ্যের অনেক জায়গাতেই। বিশেষ করে বাংলাদেশ লাগোয়া জেলাগুলিতে।
২০১৯ সাল থেকে প্রথম বজ্রপাতের সংখ্যা গোনার কাজ শুরু হয় দেশে। মৌসম ভবনের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ শুরু করে কাউন্সিল। সে সময়ই দেখা যায়, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৬ লক্ষ ৭৩ হাজার বজ্রপাত হয়েছিল বাংলার আকাশে। এর মধ্যে ৩ লক্ষ ৪ হাজার মেঘ থেকে মাটিতে। যার জেরে মৃত্যু হয় ৭১ জনের। ওই ৬ মাসে দেশের ৬টি রাজ্যে মৃত্যু হয় ১,৭৭১ জনের। সাম্প্রতিক অতীতের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বজ্রপাত। যেমন, ২০১৯ সালে প্রাকৃতিক কারণে ৮,১৪৫ জনের মৃত্যু হয় দেশে। এর মধ্যে ২,৮৭৬ অর্থাত্ ৩৫ শতাংশের মৃত্যুই বজ্রপাতে।
এই কারণে সচেতনতার উপরই জোর দিতে চাইছে কাউন্সিল, মৌসম ভবন। অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ওড়িশা, বাংলা মিলিয়ে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেখানে একদিনেই ২৭ জনের প্রাণ কেড়েছে বজ্রপাত। ঘূর্ণিঝড়ের আগে পূর্বাভাস পাওয়া যায়। সতর্ক হওয়ার সময়ও মেলে বেশি। বজ্রপাতে সেই সুযোগ নেই। দিনকয়েক আগে বজ্রবিদ্যুত্-সহ বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেওয়া গেলেও, কোন জেলায়, কখন হবে, তা বলা যায় মাত্র ঘণ্টা দুয়েক আগেই। তাই পূর্বাভাস দ্রুত পৌঁছে দেওয়া এবং সচেতনতা– দু’টি বিষয়ের উপরই সমান গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কর্নেল শ্রীবাস্তবের বক্তব্য, ‘রাজ্য সরকারের উচিত নিয়মিত প্রচার চালানো। না-হলে কৃষক, মত্স্যজীবীর মতো মানুষজন বজ্রপাতের খবর পাবেন না।’ সঞ্জীববাবুর মুখেও এক সুর, ‘একটানা প্রচার চালালে মানুষ সতর্ক হবেন। ঝড়-বৃষ্টির পরিস্থিতি দেখলে কংক্রিটের আস্তানার নীচে পৌঁছতে হবে। ওটাই রক্ষাকবচ। এটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে।’
আরও পড়ুন: কেন বাড়ছে বজ্রপাত? ওই সময় কী করবেন আর কী করবেন না
বজ্রপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি নিয়ে কী বলছে মৌসম ভবন? সঞ্জীববাবুর মন্তব্য, ‘যে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাজ পড়ার সংখ্যা গোনা হয়, দু’বছরে তার সংখ্যায় কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না, সেটাও দেখা দরকার। তবেই বিষয়টি আরও নিখুঁত হবে। আর টানা কয়েক বছর এই তথ্য পেলে প্রবণতা আরও ভালো বোঝা যাবে। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে প্রতি বছরই।’
তাই, মেঘ ডাকলেই সাবধান।