ডাকাত কালীর গল্প: খোদ কলকাতার বুকেই রয়েছে ডাকাতের তৈরি এশিয়ার সবচেয়ে ছোট কালী
মনোহরের মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন সেই মূর্তিটি পাতকুয়োতেই অরক্ষিত অবস্থায় পড়েছিল। এরপর স্থানীয় এক বাসিন্দা কামাক্ষা চরণ মুখোপাধ্যায় একদিন দেবীর স্বপ্নাদেশ পান, যে দেবী দীর্ঘদিন পাতকুয়োয় পড়ে আছেন, নিত্যপুজো পান না। কামাক্ষা যেন দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে তাঁর নিত্য পুজোর ব্যবস্থা করেন।
কলকাতার রাস্তায় চলাচলের মাঝেই চোখে পড়ে নানান কালী মন্দির। তার মধ্যে যেমন বেশকিছু বিখ্যাত মন্দির রয়েছে, তেমনি রয়েছে অবিখ্যাত এবং আজানা ছোট কিছু মন্দিরও। রাস্তার এক কোনে পড়ে থাকা এসব মন্দিরের ইতিহাস বেশিরভাগেরই অজানা। তেমনই একটি মন্দির দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটের ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের পাশেই। চারদিকে সুদৃশ্য ঝাঁ চকচকে বাড়িঘরের আড়ালে এক প্রকার ঢাকাই পড়ে থাকে এই মন্দির। কিন্তু এই ছোট মন্দিরটির আড়ালেই রয়েছে এক ভয়ঙ্কর গা ছমছমে ইতিহাস। আর হবে নাই বা কেনও, এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা যে এক দুর্দান্ত ডাকাত।
মনোহর বাগদি। যার নামে কলকাতার এই অঞ্চলটিরও নাম মনোহরপুকুর রোড বর্তমানে নাম বদল হয়ে হয়েছে পূর্ণদাস রোড। পলাশীর যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। তখনও কোম্পানি শাসন শুরু হয়নি বাংলায়। সেই সময় কলকাতার দক্ষিণের অংশটি ছিল সম্পূর্ণ গভীর জঙ্গলে ভরা। মাঝ দিয়ে বয়ে যায় আদিগঙ্গা। সেই জঙ্গলের গভীরে ছিল সেই সময়ের দুর্ধর্ষ ডাকাত মনোহর বাগদীর ডেরা। এমন তার দৌরাত্ম যে স্থানীয় জমিদারদের পাশাপাশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেও নাজেহাল করে ছেড়েছিল।
জনশ্রুতি অনুযায়ী একদিন মাঝরাতে মনোহর আর তার দলবল ডাকাতি করে ফেরার সময় দেখতে পায় জঙ্গলের মধ্যে বাঘের আক্রমণে আহত এক মহিলা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। পাশেই রয়েছে ক্রন্দনরত তার ছোট্ট শিশু। শিশুটির কান্নাই হয়ত মন গলিয়েছিল মনোহরের। দুজনকেই সে আস্তানায় তুলে এনে সেবা শুশ্রুষা করা শুরু করে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি মহিলাটিকে। এদিকে ডাকাত সর্দার মা হারা সেই শিশুটিকে নিয়ে পড়ল মহা ফাঁপরে। শেষে সন্তানহীন মনোহর তাকে নিজের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বাচ্চাটির নামকরণ করে হারাধন। এখান থেকেই দস্যু মনোহরের বাল্মীকি হয়ে ওঠার সূত্রপাত। যত স্নেহ বাড়তে থাকে ততই তার ডাকাতির ইচ্ছে চলে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা হারাধনকে সে ভর্তি করে ভবানীপুরের খ্রিস্টান পাঠশালায়। এবার সেখানে হারাধনের সম্পূর্ণ নাম হল হারাধন বিশ্বাস।
পড়াশুনায় মনোযোগী হারাধন ছিল অত্যন্ত মেধাবী। ধীরে ধীরে জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে বৃদ্ধ হারাধনও। কোম্পানির শাসনে ডাকাতি করাও মুশকিল হয়ে ওঠে। চোখের মণি হারাধনের কাছে নিজের পেশাও গোপন রেখেছিল সে। ধীরে ধীরে নিজেক পেশার কারণে অনুতাপ জন্মানো মনোহর শেষ জীবনে চাষবাস করে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। ডাকাতি করে রোজগার করা তিন ঘড়া মোহর আর আরও সোনা-রুপো ছেলেকে দিয়ে যায় মনোহর। তবে হারাধনকে জানায় এসব সে গুপ্তধন হিসেবে পেয়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার ওই অঞ্চলে সেসময় গ্রীষ্মকালে দারুণ জলকষ্ট থাকত। মৃত্যুর আগে ছেলেকে ধনসম্পত্তি দিয়ে মনোহর ইচ্ছা প্রকাশ করে হারাধন যেন ওই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি জলাশয় তৈরি করে। সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল হারাধন।
সাধারণত জঙ্গলের পথে কালীঘাটের মন্দির দর্শন করতে যাওয়া পুণ্যার্থীদের লুঠ করত মনোহর। ডাকাতির আগে একটি কষ্টিপাথরের মূর্তিকে কালীজ্ঞানে পুজো করত মনোহর। বর্তমান কালীমন্দিরটির বাইরে একটি ছোট্ট লাল মন্দির রয়েছে সেখানেই ওই কষ্টি পাথরটি রেখে পুজো করত সে। মনোহরের সেই মূর্তিটিই আজও এই কালী মন্দিরের প্রধান বিগ্রহ হিসেবে পুজিত হয়। তবে কথিত আছে যে প্রতিদিন ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে মনোহর এই পুজো করার পর মূর্তিটি দড়ি বেঁধে ডেরার পাশের একটি পাতকুয়োতে ফেলে দিত। যাতে কেউ তা হস্তগত করতে না পারে।
মনোহরের মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন সেই মূর্তিটি পাতকুয়োতেই অরক্ষিত অবস্থায় পড়েছিল। এরপর স্থানীয় এক বাসিন্দা কামাক্ষা চরণ মুখোপাধ্যায় একদিন দেবীর স্বপ্নাদেশ পান, যে দেবী দীর্ঘদিন পাতকুয়োয় পড়ে আছেন, নিত্যপুজো পান না। কামাক্ষা যেন দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে তাঁর নিত্য পুজোর ব্যবস্থা করেন। এরপরই কামাক্ষাবাবু বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু যেহেতু এই দেবীর প্রকৃত পুজারি ছিল মনোহর ডাকাত, তাই তার নাম অনুসারেই এই মন্দিরের নাম হয় মনোহর ডাকাতের ছানা কালী। ছানা কালী কারণ মূর্তিটির আকৃতি খুবই ছোট। আর তা থেকেই মনোহরের ছানা কালী নামের উৎপত্তি।
পাতকুয়ো থেকে উদ্ধারের সময় এই কালীর গায়ে ছিল না কোনও অলঙ্কার। দেবীর আয়ুধভূষিতা ছিলেন। গলায় ছিল কঙ্কালের মালা, আর হাতে আসল মানুষের মাথার খুলি। আকৃতিতে ছোট হলেও এই কালীর রূপ ভয়াল। দক্ষিণ কলকাতার বিশাল বিশাল কংক্রিটের জঙ্গলে ঘেরা এই মন্দিরের পরিবেশ এতই শান্ত যে আজও এই মন্দিরে পা দিলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে পারে। তবে অনেক মানুষের মতে এটি এশিয়ার সবচেয়ে ছোট কালীমূর্তিও বটে।
আরও পড়ুন: Kali Puja 2021: এখানে মশাল জ্বালিয়ে আসেন পুরোহিত, স্বহস্তে এই কালীর পুজো দিতেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র