Aparna Sen: বাম সরকারের পতন চাননি অপর্ণা, ‘পরিবর্তন’-এর সমীর-মীরাতুনরা কী চেয়েছিলেন?
Aparna Sen: সম্প্রতি TV9-কে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে অপর্ণা দাবি করেছেন, পুলিশের গুলিতে নন্দীগ্রামে ১৪ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদেই পথে নেমেছিলন তিনি। তাঁর দাবি, তিনি বাম সরকার পরিবর্তন চাননি, অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। কী বলছেন তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিবর্তন চাওয়া সমীর আইচ, মীরাতুন নাহাররা? তাঁরাও কি তাই চেয়েছিলেন?
সুমন মহাপাত্র ও ভাস্বতী ঘোষ, কলকাতা: ২০০৭-এর সালে কলকাতা ছেয়ে গিয়েছিল একটা হোর্ডিংয়ে, “আমরা পরিবর্তন চাই।” অপর্ণা সেন, সমীর আইচ, শঙ্খ ঘোষ – সেই হোর্ডিংয়ে মুখ ছিল বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর। বাম সরকারের পতন চেয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁরা। তবে, সম্প্রতি TV9-কে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে অপর্ণা দাবি করেছেন, পুলিশের গুলিতে নন্দীগ্রামে ১৪ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদেই পথে নেমেছিলন তিনি। তাঁর দাবি, তিনি সরকার পরিবর্তন চাননি, অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছেন বামফ্রন্টের আদর্শের সঙ্গে তিনি একমত। এমনকি, তাঁর অনুমতি ছাড়াই পরিবর্তন চাই হোর্ডিংয়ে তাঁর ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন অপর্ণা। তাঁর এই মন্তব্য হইচই ফেলে দিয়েছে বাংলার রাজনৈতিক জগতে। কী বলছেন তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিবর্তন চাওয়া সমীর আইচ, মীরাতুন নাহাররা?
সমীর আইচ বলেছেন, “বামফ্রন্টের শেষ দিকে রাজ্য যে অবস্থায় চলে গিয়েছিল, তাদের পাড়ায় পাড়ায় দাদাগিরি ছিল, তা মানুষ নিতে পারছিল না। আমিও নিতে পারছিলাম না। এরপর নন্দীগ্রামের দৃশ্য দেখার পর আমার মনে হয়েছিল, অবস্থার বদল নয় সরকারটারই বদল দরকার। কারণ ৩৪ বছর হয়ে গিয়েছিল। সেই হিসেবেই আমার ছবি পরিবর্তন চাই হোর্ডিংয়ে লাগানো হয়েছিল। আমার অনুমতি নিয়েই লাগানো হয়েছিল।” অপর্ণা সেন সম্পর্কে সমীর বলেছেন, “অপর্ণা সেন একজন বড় মাপের মানুষ। তাঁর কোনও অবস্থানই মিথ্যা ছিল না।” বর্তমান তৃণমূল সরকারকেও সরাতে চান অপর্ণা। এই বিষয়েও তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছেন চিত্রশিল্পী।
সমাজকর্মী মীরাতুন নাহার বলেছেন, “আমার মনে হয়েছিল বামফ্রন্ট শেষ দিকে আদর্শ থেকে চ্যুত হয়েছিল। আরেকটা কথা আমার মনে হয়েছিল, গণতান্ত্রিক দেশে কখনও একটি দল শাসক দল হিসেবে পাঁচ বছরের বেশি থাকা উচিত নয়। দীর্ঘদিন একটানা ক্ষমতায় থাকলে, ক্ষমতার অপব্যবহার হতে বাধ্য। সিপিএমের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, তাদের আর ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত চাওয়া ছিল। সরকার নির্বাচন করেন মানুষ। পরিবর্তনটা খুবই দরকার ছিল। একদল ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকলে, গণতান্ত্রিক চেতনা আর বজায় থাকে না।”
বিরুদ্ধে আরও অনেকের সঙ্গে পথে নেমেছিলাম। সেখানে অম্লান দত্তের মতো মানুষ ছিলেন। শঙ্খ ঘোষও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কারণ, একটা হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল।” এরপরই তিনি বলেন, “এই সরকারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছি। আমার কারও কাছে জবাবদিহি করার নেই। তারা কি জবাবদিহি চাইবার যোগ্য?” বর্তমান সরকার সম্পর্কে অপর্ণা সেনের মত সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি। তবে মীরাতুন নাহার বলেছেন, “বর্তমান যে শাসক দল ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের আমি কোনও সরকার বলে মনে করি না, তারা শাসক দল। শাসক দল হিসেবে তারা সবরকমের দমন পীড়ন নামিয়ে আনছে। ১০ বছরে আমি তাদের কোনও সদর্থক কাজ করতে দেখিনি। তাই গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী, তাদের অপসারন খুবই প্রয়োজন। পাঁচ বছর পরই হওয়া উচিত ছিল। তাহলে তারা এতটা বাড়তে পারত না।”
অপর্ণা সেনদের সঙ্গে অবশ্য পা মেলানি বাম ঘনিষ্ঠ দেবদূত ঘোষ, বাদশা মৈত্ররা। অপর্ণা সেনের সাম্প্রতিকতম মন্তব্য সম্পর্কে দেবদূত বলেছেন, “নন্দীগ্রামে যা ঘটেছিল, তাতে কোনও পশ্চিমবঙ্গবাসীই আনন্দ পাননি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চেয়ছিলেন। বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, কোনও চাষীর জমি নেওয়া হবে না। তারপরও মানুষ বদল চেয়েছন, ২০১১-য় তা হয়েছিল। মানুষ আসলে ভেবেছিল, পশ্চিমবঙ্গে নতুন কিছু হবেষ শিল্প হবে। মানুষ চাকরি পাবেন। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, স্বল্পশিক্ষিত থেকে শিক্ষিতরা সকলেই কাজের স্বার্থে ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিন্তু বড় শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করেছিলেন। তারপরও হয়নি। এখন সময়ের দাবি, নতুন করে শিল্প প্রতিষ্ঠা করা। আর এখন যে দুষ্কৃতী, দালাল রাজ, কাটমানিখোর প্রশাসন তৈরি হয়েছে, তার বদলে একটা স্বচ্ছ প্রশাসন দরকার। অপর্ণা সেন আমাদের অভিভাবক। শম্ভু মিত্রের চাঁদবণিকের খেলা নাটকে বলা হয়েছিল, আমাদের শরীরে উপরে যে মাথা রয়েছে, সেটা ফেলনা নয়। সেটা ভাবে, চিন্তা করে। মানুষ ভাববেন, কাদের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। অপর্ণাদির কথায় সেই ভাবনাগুলিই উঠে এসেছে।”
বাদশা জানিয়েছেন, পরিস্থিতির বদল নিয়ে অপর্ণা সেন যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে ভুল কিছু নেই। বাদশা মেনে নিয়েছেন, বাম আমলে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল না। বাদশা বলেছেন, “সরকারের বদল না চাইলেও, পরিস্থিতির বদল চাওয়া নিয়ে অপর্ণা সেনের যে দাবি তার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু, যে বিষয়ে একমত নই তা হল, পরিস্থিতির বদল চাইতে গিয়ে, তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থর সঙ্গে নিজেদের দাবি দাওয়াকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন, সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন, সেটা আমার কাছে সমর্থনযোগ্য মনে হয়নি।” বাদশা সিঙ্গুর থেকে টাটা গোষ্ঠীর বিদায়ের উদাহরণ দিয়েছেন। টাটাকে চলে যেতে বাধ্য করার পিছনে তৃণমূল কংগ্রেসের পাশাপাশি, প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদেরও বড় ভূমিকা ছিল বলে দাবি বাদশার। টাটা গোষ্ঠী সেখানে কারখানা গড়লে, আরও অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ী লাভবান হতেন। টাটারা কারখানা তৈরি করলে, আরও বড় বড় গোষ্ঠীও পশ্চিমবঙ্গে আসার উৎসাহ পেত। বাদশার দাবি, এতে তৃণমূলের রাজনৈতিক লাভ ছিল। কিন্তু, টাটা গোষ্ঠীকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়ালে, রাজ্যের কী অবস্থা হবে, তা বুদ্ধিজীবীদের ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু, তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের সুরে সুর মিলিয়েছিল।