Subrata Mukherjee Death: যুগাবসান: সুব্রত ‘এভারগ্রিন’ মুখোপাধ্যায়

Subrata Mukherjee: একুশের ভোট ছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ভোটে লড়ার সুবর্ণজয়ন্তী। ১৯৭১ সালে যে বৃত্ত আঁকা শুরু হয়েছিল একুশে বালিগঞ্জে জিতে সে বৃত্তেই ইতি টানলেন সুব্রত।

Subrata Mukherjee Death: যুগাবসান: সুব্রত 'এভারগ্রিন' মুখোপাধ্যায়
যুগাবসান: সুব্রত এভারগ্রিন মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 05, 2021 | 1:07 AM

কলকাতা: চারদিক যখন আলোর রোশনাইয়ে মাতোয়ারা, এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে খবর এল, সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রয়াত। বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। সিভিয়ার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট!

বঙ্গ রাজনীতির এক বর্ণময় চরিত্র ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সেই ছয়ের দশকে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির হাতে হাত রেখে বজবজের সারেঙ্গাবাদ থেকে শহর কলকাতায় ছাত্র পরিষদ করতে এসেছিলেন সুব্রত। এরপর ‘প্রিয়’র ছায়াসঙ্গী হয়েই থেকে গিয়েছেন রাজনীতির পৃষ্ঠায়।

সুব্রত মুখোপাধ্যায় নিজে বহু বার একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি চিরকালই প্রিয়র সঙ্গে জুটি বেঁধে দু’য়ে। লোকে বলত প্রিয়-সুব্রত। তাঁর নামটা ‘সেকেন্ডে’। এমনকী তাঁকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলেও এই একই যুক্তি খাঁড়া করতেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী পিপল চয়েস। সেখানে আমি দ্বিতীয়তে।’

ছয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে তখন কংগ্রেস ক্ষমতাসীন। ছাত্র পরিষদে তখন তরুণ তুর্কিদের মুখের সারি। ওদিকে আবার নকশাল আমল। বঙ্গ রাজনীতির সেই পটেই উদয় হল দুই নেতার। একজন এলেন দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থেকে। নাম প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। অপর জন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আদি বাড়ি বর্ধমানে হলেও সুব্রতর বড় হওয়া কলকাতার উপকন্ঠে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজে।

প্রিয়রঞ্জন হলেন নেতা। সুব্রত হলেন প্রিয়কে একেবারে আষ্টেস্পৃষ্টে জড়িয়ে থাকা ভ্রাতৃপ্রতিম। সে সময় সুব্রত মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়েন। রাজ্য ছাত্র পরিষদের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। সুব্রত আলাদা ভাবে নজরে পড়ে তাঁর। বেশ সম্ভাবনাময়। জেলায় জেলায় সুব্রত গেলেন ছাত্র পরিষদকে আলাদা অক্সিজেন জোগাতে। জেলার ছেলেরা কলকাতায় এসে থেকে রাজনীতি করছে। বেশির ভাগ সময়ই থাকছেন মহাজাতি সদনে। প্রান্তিক জেলায় ঘুরে চলছে সংগঠনের হয়ে জোর প্রচার।

ধীরে ধীরে রাজনীতিতে দুঁদে হচ্ছেন প্রিয়-সুব্রত। একটা সময় দিল্লির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মতানৈক্য তৈরি হতে শুরু করল প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির। সুব্রত মুখোপাধ্যায় তখন মন দিয়ে রাজ্য রাজনীতিটাই করে চলেছেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে বালিগঞ্জ থেকে প্রথমবার ভোটে লড়লেন। প্রথমবারই জয়। সে জয় যেন তাঁকে দ্বিগুন আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল।

১৯৭২ সালেই মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় ডাক পেলেন। তাও স্বরাষ্ট্র দফতর ও তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের জন্য। সব থেকে কম বয়সে মন্ত্রী হওয়ার রেকর্ডের অধিকারী হলেন সুব্রত। জ্যোতি বসু ব্যক্তিগত ভাবে সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ভীষণ পছন্দ করতেন। কারণ ক্ষুরধার বু্দ্ধিদীপ্ত রাজনীতিকের কদর চিরকালই করেছেন জ্যোতিবাবু।

এদিকে জ্যোতিবাবুর এই স্নেহ কংগ্রেস রাজনীতিতে বিড়ম্বনা বাড়িয়েছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। অনেকে ধরেই নিয়েছিল, কংগ্রেসের টিকিটে জেতা নেতা হলেও আসলে সিপিএম ঘেঁষা! যদিও সুব্রত মুখোপাধ্যায় বার বারই বলতেন, একজন স্নেহ করেন, পছন্দ করেন সেটা আবার কেউ প্রত্যাখ্যান করে নাকি!

শুধু মন্ত্রী নন শ্রমিক সংগঠনের নেতা হিসাবেও নিজের পরিচিতি তৈরি করেছিলেন সুব্রত। আইএনটিইউসি নেতা তো অনেকেই হন, তবে সুব্রত মুখোপাধ্যায় সেই শ্রমিক নেতা ছিলেন, যিনি ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশনের (WTO) সদস্য হন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তরফে। ডব্লুটিও সেই সংগঠন, যেখানে শ্রমিক ও ব্যবসা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা হয়।

এক সময়ে যোগমায়া দেবী কলেজের ছাত্রনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল গড়লেন তার পরের বছরই সে দলে যোগ দিলেন মমতার সুব্রতদা। পরের বছরই কলকাতার পুরভোটে ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জোড়া ফুল প্রতীকে লড়লেন সুব্রত। জয়ী হয়ে কলকাতার মেয়র হলেন।

কলকাতা মেয়র হওয়ার পরই এক নতুন সুব্রতকে দেখল কলকাতা। প্রশাসক সুব্রত। শোনা যায়, এই সুব্রতই রাত ১১টা সাড়ে ১১টায় নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে ফেরার পথে রাইটার্স গোলদিঘি চত্বরে জনৈক একজনকে মানুষের যাতায়াতের জায়গায় মূত্রত্যাগ করতে দেখে তেড়ে গিয়েছিলেন। আসলে শহরটাকে সাজাতে চেয়েছিলেন। সেখানে বেয়ারামো মোটে পছন্দ ছিল না তাঁর।

আবার এই সুব্রত মুখোপাধ্যায়ই সেই মেয়র যাঁর হাতে কলকাতা কর্পোরেশনের সমস্ত সাধারণ কর্মীর জীবনবিমাও সুনিশ্চিত হয়েছিল। এ ভাবেই প্রশাসনিক কর্তা হিসাবে অনায়াসে তাঁর কর্তৃত্ব এবং কৃতিত্ব বসে গিয়েছিল এক পংক্তিতে।

এরপর আবারও সুব্রতর রাজনৈতিক মতাদর্শ বদলেছে। সিপিএমের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য কলকাতার মেয়র হয়েছেন, সুব্রতও কংগ্রেসে ফিরেছেন। আবার ২০১০ সালের পুরভোটের অব্যবহিত আগে তৃণমূলে ফিরলেন। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার গড়ল। মমতার প্রথম মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হলেন। সেই পঞ্চায়েত দফতর। সেই দফতর যার জন্য বিগত দশ বছরে প্রায় আটবার কেন্দ্রের স্বীকৃতি পেয়েছে ভাল কাজ করার জন্য।

বর্ণময় রাজনীতিক হিসাবে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নাম উঠলে কারও দ্বিমত থাকবে না। তবে এই  বর্ণাঢ্যতাকে সম্প্রতি ছুঁয়ে গিয়েছিল বিতর্কও। নারদকাণ্ডে সিবিআইয়ে হাতে গ্রেফতারি, পরে জামিনে মুক্তি! এ বয়সে মনের ধকল হয়ে গিয়েছিল। যদিও সে সব দূরে ঠেলে প্রতি বছরের মতো এবারও ধুমধাম করে আয়োজন করেছিলেন তাঁর একডালিয়া এভারগ্রিনের দুর্গাপুজোর।

পরণে সাদা ধবধবে ধুতি, পাঞ্জাবি, বাঁ হাতে ঘড়ি আর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেই ‘হাজির জবাব’। এও এক অন্য সুব্রত। ‘ঝকঝকে’ সুব্রত। একুশের ভোট ছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ভোটে লড়ার সুবর্ণজয়ন্তী। ১৯৭১ সালে যে বৃত্ত আঁকা শুরু হয়েছিল একুশে বালিগঞ্জে জিতে সে বৃত্তেই ইতি টানলেন সুব্রত। ভোটযুদ্ধে পঞ্চাশ পার করে ময়দান ছাড়লেন।

আরও পড়ুন: প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়! দীপাবলিতেই নিভল জীবন প্রদীপ