কলকাতা: আর কতটা পথ পেরলে … বাঘিনি জিনাতকে নিয়ে এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তাবড় আধিকারিকদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে ‘রায়বাঘিনি’! গলায় রেডিয়ো কলারের ট্র্যাকার রয়েছে, তার গতিবিধিও জানা যাচ্ছে। কিন্তু কোনও ভাবেই ওড়িশা থেকে আসা বাঘিনি জিনাতকে বাগে আনতে পারছেন না বনকর্মীরা!
ইতিমধ্যেই বাঘিনির গতিবিধি জানতে নিয়ে আসা হয়েছে উচ্চ ক্ষমতার ড্রোন ক্যামেরা। রেডিয়ো কলারের সঙ্কেত জানতে অত্যাধুনিক সফ্টওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে। বাঘিনি ধরার খাঁচা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রাণী অ্যাম্বুল্যান্স, বাঘিনির টোপের জন্য গৃহপালিত গবাদি পশুও নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু সবই যেন হয়ে যাচ্ছে ফেল! বর্তমানে পুরুলিয়ায় চলছে ‘বাঘবন্দির খেলা’। মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়াচ্ছে জিনাত। আর তার পিছন পিছন বনকর্মীরা। কিন্তু কেন থিতু হতে পারছে না জিনাত? কী চলছে বছর আড়াইয়ের ‘সদ্য যুবতী’ হওয়া এক বাঘিনির মনে। কী বলছে জিনাতের মনন?
ইয়ং ট্রাইগ্রেস জিনাত। গত ১৫ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে বাঘিনিকে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে আনা হয়। তিন বছরের জিনাতকে কয়েক দিন ছিল ঘেরাটোপে। পর্যবেক্ষণের পরে রেডিয়ো কলার পরিয়ে ২৪ নভেম্বর তাকে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে ছাড়া হয়। তার পরেই ঝাড়খণ্ডে ঢোকে জিনাত। সেখান থেকে বাংলায় ডেরা। গত চারদিন ধরে নাকানি চোবানি খাওয়াচ্ছে।
জিনাতের যাত্রাপথ:
১৫ ডিসেম্বর সে সিমলিপাল থেকে বেরিয়ে পড়ে। পাঁচদিনে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দৌড়ে ২০ ডিসেম্বর ঢুকে পড়ে বেলপাহাড়ির কটাচুয়ার জঙ্গল। সেদিন আরও ১২ কিলোমিটার পথে পেরিয়ে পৌঁছে যায় বেলপাহাড়ির তেলিঘানার জঙ্গল। এরপরের দিন ১০ কিলোমিটার উজিয়ে পৌঁছে যায় বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়ে। একটা জায়গা থেকে তাকে নিয়ে এসে নতুন ল্যান্ডস্কেপে ছাড়া হয়েছে। বাঘ বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুণ্ডর মতে, আসলে জায়গাটা এক্সপ্লোর করছে জিনাত। ঝাড়খণ্ডের দিক থেকে ঝাড়গ্রামের শিমুলপাল এলাকার জঙ্গলে ঢোকে। তারপর সেখান থেকে শিমুলপাল, ঠাকুরবাড়ি, বেলপাহাড়ির কাটুচুয়া জঙ্গল। তবুও থামেনি গতি। হেঁটেই চলেছে। পুরুলিয়া জঙ্গল চষে বেড়াচ্ছে সে। শনিবার সকালে পাওয়া খবর, কটাচুয়ার জঙ্গল থেকে কাঁকড়াঝোড় ও ময়ূরঝর্ণার জঙ্গলে ঢোকে জিনাত। রবিবার সকালে রাইকা পাহাড়ের মধ্যে মাত্র ৫০ মিটার স্থান বদল করেছে।
বাঘ বিশেষজ্ঞের জয়দীপ কুণ্ডুর কথায়, “এটা ক্যাট ফ্যামিলির খুবই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকত্ব নেই।” জয়দীপ কুণ্ডু বলেন, “বাঘ তো জিওগ্রাফিক্যাল, পলিটিক্যাল বাউন্ডারি মানবে না। বাঘ তার বিচরণক্ষেত্র, তার যে প্রশস্ত পথ পাচ্ছে, তা ধরেই এগোচ্ছে।” আর সেক্ষেত্রে যে জিনাতকে একেবারেই কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না, সেটাও নিশ্চিত তিনি। বললেন, “রাস্তায় নিশ্চয়ই খাবার জল, সবই পাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত কোনও লোকালয়ে কারোর সঙ্গে তার কোনও কনফ্লিক্ট হয়নি।” তবে পুরুলিয়ার মুখ্য বনপাল বিদ্যুৎ সরকার অবশ্য মনে করছেন, ” খাবার দিয়েই তাকে খাঁচা বন্দি করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
কিন্তু কীসের খোঁজে এতটা হাঁটছে জিনাত?
আসলে এতটা পথ পেরিয়ে জিনাত খুঁজছে একটা নিরাপদ, নিরিবিলি স্থান, আইসোলেটেড হতে চাইছে সে। জিনাত ঠিক মনে করিয়ে দিয়েছে ২০১৮ সালে একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের কথা। লালগড়ের জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল। তাকেও ধরতেও কালঘাম ছুটেছিল বন দফতরের। ২০২৩ সালে প্রায় ঠিক এই সময়েই মহারাষ্ট্রের একটি বাঘ উপযুক্ত সঙ্গী আর নিরাপদ আস্তানার খোঁজে পাড়ি দিয়ে ফেলেছিল ২০০০ কিলোমিটার। জিনাত কি তার রেকর্ড ভাঙবে? প্রশ্ন স্বাভাবিক।
বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনও ক্যাট ফ্যামিলির মেম্বাররা আইসোলেশন খোঁজে। লোকালয়, জনবসতি সবই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তাই ধরেই নেওয়া যায়, জিনাত এখনও পর্যন্ত আইসোলেশন পাচ্ছে, সে তার মতো রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রেডিয়ো কলার পরানো থাকা সত্ত্বেও কেন জিনাতকে ট্র্যাক করা যাচ্ছে না?
বাঘ বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুণ্ড তার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, জিনাতের গলায় রেডিয়ো কলার রয়েছে যখন, নিশ্চিতভাবে তার গতিবিধি ট্র্যাক হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় ঢুকে গত দু’দিন ধরে যে সমস্ত জায়গায় যাচ্ছে, সেখানে ‘শ্যাডো জোন’ রয়েছে বলে রেডিয়ো কলারের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। নেটওয়ার্ক কেটে যাচ্ছে, সমস্যা হচ্ছে। পুরুলিয়ার ক্ষেত্রেও এই সমস্যা প্রবল। যতই জিনাত পাহাড়ি অঞ্চলে ঘোরাফেরা করবে, তাকে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়ার সমস্যা হবে। দেখা যাচ্ছে খাবারের লোভ দেখিয়েও তাকে খাঁচাবন্দি করা যাচ্ছে না। তাতে অনুমান করতে পারি, সে নিজের খাবার নিজেই জুটিয়ে নিচ্ছে। তাই তার খাবারের লোভ নেই। জনবসতির জায়গা দিয়ে যাচ্ছে না। সেখানে যাওয়ার পথে নিজের খাবার পেয়ে যাচ্ছে। বুনো শূয়োর কিংবা অন্যান্য খাবার পেতে পারে। সে অভুক্ত নয়। তাই আপন গতি বজায় রেখেছে।
বাড়ছে বাঘ, থাকবে কোথায়!
দেশের ১০-১২টি বনে ধারণক্ষমতার বেশি বাঘের সংখ্যা। মোট বাঘের অন্তত ১৫ শতাংশ ঘুরছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে! ১০ বছরে ৫২টি ব্যাঘ্র প্রকল্পে বনাঞ্চল কমেছে ২২.৬২ কিলোমিটার। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পে কিছুটা কমেছে বনাঞ্চল।
প্রশ্ন বাঘের নিরাপত্তা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘ সাঙ্ঘাতিক ধরনের টেরিটোরিয়াল প্রাণী। এতটাই দাপট যে সেই এলাকায় নিজের পরিবারের বাঘকেও থাকতে দেয় না! শোনা যায় নতুন এলাকার সন্ধানে এক-দেড় বছরের ছোট বাঘেরা খুব উদ্বেগে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি পুরুষ বাঘ প্রায় ৬০ থেকে ১৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকে। সেখানের বাঘিনির প্রয়োজন ২০ থেকে ৬০ বর্গকিমি। আর সিমলিপালের বাঘিনি ইতিমধ্যে ২২০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ফেলেছে। আর সেখানেই এসে যাচ্ছে মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণের সংঘাতের অংশ। যেটা দেখা গিয়েছিল লালগড়ে।
বাঘের করিডরে ‘অনুপ্রবেশ’
একটা সময় ছিল, এক জঙ্গল থেকে বাঘ যাতে অন্য জঙ্গলে যেতে পারে তার জন্য ছিল বাঘ-করিডর। আগে দেশের বনগুলি অরণ্যের আচ্ছাদন দিয়ে একে অপরের সঙ্গে জোড়া ছিল। সেই আড়াল দিয়ে সুন্দরবনের বাঘ নাকি কাজিরাঙা পর্যন্ত চলে যেত। আর এখন নগরায়নের ধাক্কায় সেই পথ বিচ্ছিন্ন, মানুষের আনাগোনা সেখানে। আর এ সব পথে বাঘেরা বাধা পাচ্ছে পদে পদে। গাড়ির ধাক্কা খাচ্ছে, মারা পর্যন্ত যাচ্ছে। মানুষের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে ব্যাঘ্র প্রকল্প লাগোয়া থেকে মানুষজনকে সরানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেই নানা ফাঁকফোঁকর। কোর এরিয়ার গ্রামবাসীদের সরাতে গেলে অর্থ, বাসস্থানের পাশাপাশি বিকল্প পেশারও বন্দোবস্ত করতে হয়। সেটা আর হচ্ছে কোথায়!
মানুষে-বাঘে সংঘাত
লোকালয়ে ঢোকা আটকাতে ইলেকট্রিকের বেড়া দিয়ে, ফসলে বিষ মিশিয়ে, পিটিয়ে বাঘ মারার ঘটনাও তো কম নয়। আর বাঘের হামলার পরেই গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ এবং আতঙ্ক । এ তো নতুন নয় সুন্দরবনে। তাহলে কীভাবে সমদূরত্ব রাখা সম্ভব হবে!
ওড়িশাতেই কেন ট্র্যাক করা গেল না বাঘকে
বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, ওড়িশা ঝাড়খণ্ডে থাকার সময়ে তো এই পরিস্থিতি ছিল না। তখনই তাকে ট্র্যাক করা সহজ ছিল। কর্নার করে রেসকিউ করা উচিত ছিল। জয়দীপ কুণ্ডু বলেন, “হতাশার বিষয় এটাই, একটা রেডিয়ো কলার পরানো বাঘ। যাকে মহারাষ্ট্র থেকে নিয়ে এসে ওড়িশা বনদফতর তাকে সিমলিপালে ছাড়ল। তার গলায় রেডিয়ো কলার পরানো রয়েছে। তারপর সেই বাঘিনিকে ট্র্যাক কীভাবে রাখতে পারলেন না তাঁরা। ওড়িশার কাজের গাফিলতি। সে রাজ্যের বনকর্মীদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল।”
ফিরল ঝাড়গ্রামের স্মৃতি
বছর সাতেক আগেও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ঝাড়গ্রামে। ২০১৮ সালে একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার লালগড়ের জঙ্গলে ঢুকে পড়ায় গোটা জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। বাঘটিকে ধরতেও কালঘাম ছুটেছিল বন দফতরের। সেই বাঘও এসেছিল ওড়িশার সিমলিপালের জঙ্গল থেকে। শেষমেশ ভিন্রাজ্যে মৃত্যু হয়েছিল বাঘটির।
জিম করবেটের সেই উক্তি মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, Tiger is a gentleman even after saying and doing everything অর্থাত্ বাঘ এক বিরাট হৃদয়ের ভদ্রলোক। কিন্তু আক্ষেপের জায়গা হল, এখন তার সঙ্গে মানুষের যত বিবাদ। তাই যত ভয়। সমস্যা হচ্ছে, যে জায়গায় বাঘ ঘুরছে সেখানকার মানুষের মূল জীবিকা জঙ্গল-নির্ভর। জঙ্গলের ডালপাতা, বিভিন্ন গাছের কন্দ, ধুনো, হরিতকি, বহেড়া, বুনো আমলকি সংগ্রহের কাজ বন্ধ রেখেছেন। আতঙ্কের প্রহর গুনছেন তাঁরা। তবে আশাবাদী বাঘ বিশেষজ্ঞরা। বাংলার যে সমস্ত আধিকারিকরা বাঘকে ট্র্যাক করার চেষ্টা করছেন, তাঁরা অত্যন্ত দক্ষ। শীঘ্রই বাগে আসবে জিনাত।