TV9 Explained on Bowbazar: কেন বার বার বউবাজার? খামতি কোথায়? ‘রুটবদল’ নিয়েই বা বিতর্ক কীসের?

TV9 Bangla Digital | Edited By: Soumya Saha

Oct 14, 2022 | 8:39 PM

KMRCL: নির্মাণ বিশেষজ্ঞ পার্থপ্রতিম বিশ্বাসের কথায়, "ওখানকার বাড়িগুলি শতাব্দী প্রাচীন। দেওয়ালগুলিও চুন, সুড়কির। দেওয়ালগুলিই ভার বহনের কাজ করে। সেই দেওয়ালে যখন ফাটল আসে, তখন বুঝতে হবে ভিতের তলার মাটি সরে যাচ্ছে।"

TV9 Explained on Bowbazar: কেন বার বার বউবাজার? খামতি কোথায়? রুটবদল নিয়েই বা বিতর্ক কীসের?
কেন বার বার বউবাজারেই সমস্যা?

Follow Us

কলকাতা: ২০১৯ সালের ক্ষত এখনও ভোলেনি মানুষ। মাসখানেক আগে দুর্গাপিতুরি লেনের ঘটনার ক্ষতও এখনও দগদগে। আর এরই মধ্যে ফের ফাটল। ফের বউবাজার (Bowbazar)। এবার বউবাজারের মদন দত্ত লেনের অন্তত ১০টি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পুজো শেষে দিন কয়েক আগেই আবার মেট্রোর (Kolkata Metro) কাজ শুরু হয়েছে। আর তারই মধ্যে এই বিপত্তি। দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। ঘর-বাড়ি ছেড়ে হোটেলে গিয়ে উঠতে হচ্ছে তাঁদের।

বউবাজারে ফাটল কেন? কোথায় গলদ?

দুর্গাপিতুরি লেনের ঘটনার পর মাসখানেক কেটেছে মাত্র। আবার সেই সমস্যা। মেট্রোর কাজে যেখানে জয়েন্ট বক্স তৈরি হচ্ছে, তার তলায় জলের পকেট রয়েছে। ফলে জয়েন্ট বক্স তৈরির আগে কংক্রিটের স্ল্যাব তৈরি করা জরুরি। সেই মতো প্রায় দেড় মিটার গর্ত খোঁড়া হয়েছিল। খোঁড়াখুড়ির জেরে বিভিন্ন ছিদ্র দিয়ে জল বেরোতে শুরু করে। গত মে মাসে (দুর্গাপিতুরি লেনের ঘটনা) ১১টি ছিদ্র দিয়ে জল বেরোনোর ঘটনায় বিপর্যয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এখন জয়েন্ট বক্স বসানোর জন্য কংক্রিটের স্ল্যাব তৈরির কাজ ৬ মিটার বাকি আছে। ৬ মিটারের কাজের জন্য দেড় মিটার মাটি খোঁড়ার কাজ হচ্ছিল। সেই দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ছিদ্র হয়ে জল বেরোতে শুরু করে। গত দুই দিন ধরে ৮টি ছিদ্র দিয়ে জল বেরোচ্ছিল। বৃহস্পতিবার সেই জলের পরিমাণ বাড়ে। আর তাতেই আবার বিপত্তি।

বর্তমান মেট্রো রুট এগোচ্ছে জনবসতির তলা দিয়ে। তার উপর, গঙ্গার পলিবাহিত এলাকায় মাটি নরম। বর্ষার পরে তাতে জলস্তর বেশি। বিপত্তি আরও বাড়ছে, কারণ বউবাজার অঞ্চলে অধিকাংশ বাড়িই ১০০ বছরের পুরনো। দীর্ঘদিনের পুরনো এই বাড়িগুলির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ কতটা হয়, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকছে। সব মিলিয়ে মেট্রোর কাজে আবারও বিপত্তি। নির্মাণ বিশেষজ্ঞ পার্থপ্রতিম বিশ্বাসের কথায়, “ওখানকার বাড়িগুলি শতাব্দী প্রাচীন। দেওয়ালগুলিও চুন, সুড়কির। দেওয়ালগুলিই ভার বহনের কাজ করে। সেই দেওয়ালে যখন ফাটল আসে, তখন বুঝতে হবে ভিতের তলার মাটি সরে যাচ্ছে।” মাটির তলায় কী পদ্ধতিতে গ্রাউটিং করা হচ্ছে, তা পর্যালোচনা করে দেখার প্রয়োজন মনে করছেন তিনি।

কী বলছে KMRCL?

এদিন বিকেলে কেএমআরসিএল-এর তরফে সাংবাদিক বৈঠক করে জানানো হয়, জলের স্তর একেবারে মাটির কাছাকাছি রয়েছে। যে কারণে সামান্য খোঁড়াখুঁড়িতেই জল অত্যন্ত ফোর্সের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে। প্রতি মিনিটে ২০০ লিটার করে জল বেরিয়ে এসেছে। এই জল এখনই রোখা অসম্ভব। গ্রাউটিং-এর কাজ করা হচ্ছে। চওড়া করে এই গ্রাউটিং করা হয়েছে। যে রাসায়নিক ব্যাবহার করা হচ্ছে গ্রাউটিং-এর ক্ষেত্রে তার নাম পলিইউথিরিন। এই রাসায়নিক গ্রাউটিং-এ ব্যবহার করা হচ্ছে, কারণ এটা সহজে জলকে শুষে নেয়।

রুটেই কি জট? KMRCL-রাজ্য বল ঠেলাঠেলি

মেট্রো প্রকল্পের কাজে বউবাজারে ফাটল ঘিরে ইতিমধ্য়েই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতর। নির্মাণ সংস্থা কেএমআরসিএল-এর জেনারেল ম্যানেজার এ কে নন্দী জানিয়েছেন, “রুট বদলের জন্য এই সমস্যার আশঙ্কা করা যায়নি। ভেবেছিলাম কাজ ভালভাবেই এগোবে। এখন পরীক্ষা করে দেখা হবে, কেন এমন ঘটনা ঘটল।” কলকাতা মেট্রো রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক একলব্য চক্রবর্তীও রাজ্যের দিকেই বল ঠেলেছেন। তাঁর বক্তব্য, প্রস্তাবিত রুট বদলেই বারবার বিপর্যয়।

বিরোধীরাও এই নিয়ে খোঁচা দিতে শুরু করেছে রাজ্যের শাসক শিবিরকে। বিরোধী শিবিরের একাংশ বলছে, রুট বদলের জন্যই বিপর্যয়। শাসকদলের আবার পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। শাসক দলের সাফ কথা, কেউ বললেই রুট বদলে গেল বিষয়টা তো এমন নয়। তাদের বক্তব্য, টেকনিক্যাল কারণেই রুটবদল, পলিটিক্যাল কারণে নয়। নতুন রুট নিয়ে সার্ভে করে রিপোর্ট দেয় বিশেষজ্ঞ সংস্থা। রাইটস-এর সেই রিপোর্ট মেনে নিয়েই নতুন রুটে সম্মতি মিলেছে। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, চৌরঙ্গীর বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়, স্থানীয় কাউন্সিলর বিশ্বরূপ দে সকলেই ফাটল নিয়ে দুষছেন প্রকল্পের নির্মাণ সংস্থা কেএমআরসিএল-কে। ফিরহাদের বক্তব্য, “যতক্ষণ পর্যন্ত না রেলবোর্ডের একেবারে শীর্ষস্থান থেকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই পরিস্থিতি চলতেই থাকবে। কারণ এখানে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা বিষয়টা সামলে উঠতে পারছেন না। আমি ইঞ্জিনিয়ার নই, কিন্তু দীর্ঘদিন পুরসভার কাউন্সিলর থাকার সুবাদে আমার মনে হচ্ছে যে, যে জায়গায় মেশিন আটকে গিয়েছিল, সেখানেই ওয়াটার পকেট তৈরি হয়েছে। ওয়াটার পকেট থেকে জল ঘুরে যাওয়ার জন্যই মাটি ধুয়ে কাদায় পরিণত হচ্ছে। আর তার জেরেই এই ঘটনা ঘটছে।” তবে বিজেপি নেতা সজল ঘোষের আবার আবেদন, ফাটল নিয়ে রাজনীতি না করে সকলের উচিত দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো। সবাইকে একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে।

রুট-বদল নিয়ে কেন এত বিতর্ক?

শহরজুড়ে কলকাতা মেট্রোর সম্প্রসারণের কাজ চলছে। গঙ্গার তলা দিয়ে অনায়াসে চলে আসছে মেট্রোর টানেল। বেব্রোর্ন রোডে কোনও বিপর্যয় ঘটল না। কিন্তু, বউবাজারে বারবার ধস নামছে কেন? কী এই রুট বদলের জট? ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর রুট প্রথমে ঠিক ছিল বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট হয়ে বিবাদী বাগে যাবে। কিন্তু মেট্রোর এই রুটে বেশ কিছু দোকান সরানোর প্রয়োজন ছিল। আর তখন দোকান সরাতে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দরবার করেছিলেন। সেই সময় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রুট বদলের দাবি তুলেছিলেন মমতা। উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত ওই রুটে পড়েছিল ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজ্য দফতর। কিন্তু, বাম শরিক দলও সেই সময় মমতার রুট বদল প্রস্তাবের বিরোধিতা করেনি।

তত্‍কালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষমতায় এলে মেট্রোর রুট বদল করবেন। পরবর্তী সময়ে সেটা হয়েওছিল। হাওড়া থেকে হুগলি নদীর তলা দিয়ে এ পারে এসে লালবাজারে পৌঁছে সোজা বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরে শিয়ালদহে যাওয়ার কথা ছিল ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুড়ঙ্গের। কিন্তু রাজ্য সরকারের আপত্তিতে পথ পাল্টে তা চলে যায় এসপ্ল্যানেডে। সেখান থেকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার হয়ে তবে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে।

২০১৯ থেকে শুরু, কবে কী বিপর্যয়?

সূত্রপাত ২০১৯ সালে। পর পর তিনবার মেট্রোর কাজে বিপত্তি। তিনবারই বউবাজার এলাকায়। শুক্রবার ফের ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর টানেলের কাজে বিপত্তি ঘটল। অতীতে কখন কী হয়েছিল? দেখে নেওয়া যাক একনজরে। প্রথম বার, ২০১৯ সালের অগস্ট মাস। ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর কাজের সময় ৭০ টিরও বেশি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। দুর্গাপিতুরি লেন ও স্যাঁকরাপাড়া লেনে একের পর এক বাড়িতে ফাটল ধরেছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ। প্রায় ৬৭৫ জন বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই সময়।

তারপর ২০২২ সালের মে মাস। বউবাজারে আবারও ফিরে আসে ভয়ঙ্কর সেই স্মৃতি। নতুন করে ১০ টিরও বেশি বাড়িতে ফের ফাটল দেখা দিয়েছিল। তখনও তড়িঘড়ি ২৮ টি পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই ঘটনার পর মাস পাঁচেক কাটতে না কাটতেই আবার ফাটল বিপর্যয়। ফের অন্তত ১০ টি বাড়িতে ফাটল। বউবাজারের মদন দত্ত লেন ও বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ফাটল ধরা বাড়ির বাসিন্দাদের পাঁচটি হোটেলে রাখার ব্যবস্থা করেছে কেএমআরসিএল। এখনও পর্যন্ত প্রাথমিক ভাবে ১৩৬ জনকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বউবাজার এলাকায় বহু স্বর্ণ ব্যবসায়ী কাজ করেন। সামনেই ধনতেরস। তার আগে এমন ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে তাঁদের মনেও। বউবাজারের ফাটল বিপর্যয়ের জেরে, দুশ্চিন্তার কালো মেঘ নেমে এসেছে মদন দত্ত লেনের বাসিন্দা নবনীতা বড়ুয়ার জীবনে। সদ্য স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। নিজেও অসুস্থ। নাবালক ছেলেকে নিয়ে এখন তিনি রাস্তায় নেমে এসেছেন। এমন অবস্থায় কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না স্বামীহারা ওই মহিলা।

Next Article