কলকাতা: প্রথম দফার ভোটের মুখে টিভি নাইন বাংলায় একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা ভোটের আগে রাজ্য রাজনীতি থেকে শুরু করে জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন আঙ্গিক উঠে এল মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত আলাপচারিতায়। বাংলায় একলা চলার নীতি, ইন্ডিয়া জোটের আগামীর রূপরেখা… সব নিয়েই খোলামেলা আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরএসএস প্রসঙ্গে মমতা: ‘আমি একসময় আরএসএস-কে ভাবতাম, এদের মধ্যে কিছুটা মাধুর্য্য থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু সেটা এখন ফুরিয়ে গিয়েছে।’
মমতা: ‘কেউ যদি আমাকে গালি দেয়, আমি তাকে শুভনন্দন বলব। কিছুদিন আগেই, চালসা দিয়ে যাচ্ছিলাম। বিজেপি একটা মিছিল করছিল। আমার গাড়িটা দেখে অশ্রাব্য ভাষায় কথাবার্তা বলছিল। অন্য কেউ হলে টেনে দুটো চড় মারত। আমি কিচ্ছু করিনি, হাসতে হাসতে বেরিয়ে গিয়েছি। রাজনীতি করতে গেলে ধৈর্য্য ধরতে হয়।’
সন্দেশখালি নিয়ে প্রশ্নে মমতা: ‘এত ঘটনা থাকতে, একটা ঘটনার কথা কেন বলছেন? সারা বাংলায় কত ব্লক আছে। কেন বাকিগুলির বিষয়ে কথা বলছেন না? ওখানে কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। যদি কিছু ঘটেও থাকে, জানার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ পদক্ষেপ করেছে। আমি সন্দেশখালির মা-বোনদের সম্মান করি। আমি অনেকের থেকে শুনেছি, যাঁরা তদন্ত করছিলেন, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও টাকার বান্ডিলও পৌঁছেছিল। হ্যাঁ, সন্দেশখালিতে কিছু কিছু হয়েছিল। সেটা হল জমি সংক্রান্ত বিষয়। সেটা তো দুয়ারে সরকারে বা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীতে অভিযোগ জানাতে পারত। আমার কাছে তো কোনও অভিযোগ জানায়নি। আমি যদি কোনও কাগজেও দেখতাম, তাহলেও অ্যাকশন নিতে পারতাম। আমি যখনই জেনেছি, সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নিয়েছি। এটা আর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম এক নয়।’
অভিষেক প্রসঙ্গে মমতা: ‘অভিষেক দলের একজন একনিষ্ঠ সৈনিক। ছোট্টবেলা থেকে আমি তৈরি করেছি। ওর যখন আড়াই বছর বয়স, তখন আমাকে হাজরায় মেরেছিল সিপিএম। ও তখন থেকে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বলত, দিদিকে মারলে কেন সিপিএম জবাব দাও। তখন থেকেও ওর রাজনৈতিক মনন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কলেজ পাশ করার পর থেকে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে আসে। আমি চাই ওরা ভালভাবে তৈরি হোক। নতুন প্রজন্মকেও দরকার। আজকের দিনে দেখুন, দেবাংশু টিকিট পেয়েছে। সায়নী টিকিট পেয়েছে। রচনা থেকে শুরু করে অনেকে টিকিট পেয়েছে। আমি তিনটে প্রজন্ম তৈরি করে দিয়েছি। এটা আমার গর্ব। কারণ, আমি যদি প্রজন্ম তৈরি না করি, তাহলে আমার স্বপ্নের তৃণমূল কংগ্রেসকে কে রক্ষা করবে!’
মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের প্রশ্নে মমতা: ‘আমরা সবাইকে নিয়ে চলি। এটা নিয়ে ভাগাভাগি করবেন না। সবাই আমাদের সঙ্গে আছে। এখানে হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই। আমরা সর্বধর্ম সমন্বয় মেনে চলি। আমরা মসজিদ, মন্দির, গুরুদ্বার, গির্জা সর্বত্রই যাই।’
বামেদের প্রসঙ্গে মমতা: ‘আমি ওদের বিশ্বাস করি না। ওরা পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে পুরসভা, বিধানসভায় চিরকাল বিজেপিকে সাহায্য করেছে। তার বিনিময়ে ওরা কেউ জেলে যায়নি। সবথেকে বেশি চিটফান্ড তো ওরাই এনেছিল বাংলায়। আমরা তো কাশ্মীর থেকে সারদাকাণ্ডে গ্রেফতার করে এনেছিলাম। বামদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উঠেছে? যত অভিযোগ চেপে দিয়েছে। কারও ওরা বিজেপির গোপন বন্ধু। ওদের ভোট দিয়ে একটাও লাভ নেই। ওদের ভোট দিলে হয় বিজেপিতে যাবে, নাহলে ভোটটা নষ্ট হবে। যদি স্লোগানও হয় নো ভোট টু বিজেপি, আমি বলব ভোটটা তৃণমূলকে দিন। প্রত্যেকটি ভোট মূল্যবান।’
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমার মতে, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও দারিদ্র। বাংলায় দারিদ্র আমরা ৪০ শতাংশ কমিয়েছি।’
মমতা: ‘সবটাই জনমুখী হবে। এখানে দেখেছেন আমরা কত প্রকল্প করেছি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। কেন্দ্রে যদি আমাদের ক্ষমতা আসে, তাহলে আমাদের হাত আরও শক্তিশালী হবে। রাজ্যে যেমন রাজ্যের পাওনা পাবে, আমরা মানুষের কাজ আরও ভালভাবে করতে পারবে। একইসঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথভাবে আরও মানুষের উপকার করতে পারবে। বেকারত্বের সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকদের সমস্যা, মহিলাদের সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
দু’জন মন্ত্রী জেলে গিয়েছেন, সেই প্রসঙ্গে প্রশ্নে মমতা: ‘এখনও বিচার শেষ হয়নি। বিচারের রায় কারা দিয়েছে, তাদের মধ্যে একজনকে দেখতেই পাচ্ছেন… বিজেপির হয়ে লড়ছেন। আমাকে এই প্রশ্ন করতে গেলে, আগে বিজেপির দুর্নীতির কথা বলতে হবে। পিএম কেয়ার ফান্ডের টাকা কেউ জানে কোথায় গেছে? ইজরায়েলে গিয়ে এত প্রতিরক্ষার ডিল হল, কেউ জানে কত কোটি কোটি টাকার ডিল হয়েছে? কালো টাকা দেশে নিয়ে আসবে বলেছিল… কী হল! আর গরু ব্যবসা? সে তো বিএসএফ-এর হাতে। আমাদের হাতে তো নয়। কেন রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ হয়ে গরু আসবে? কোল ইন্ডিয়া কার অধীনে? কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। যেগুলি বলা হচ্ছে, সেটা একটা ভাওতা। ৩৫০টা টিম পাঠিয়ে একটাও দুর্নীতি পায়নি। যা প্রশ্ন জানতে চেয়েছে, সব উত্তর আমরা দিয়েছি। আবাস থেকে একশো দিনের কাজ। বের করতে বলুন শ্বেতপত্র। বাংলার সঙ্গে উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও মহারাষ্ট্র – চারটি রাজ্য নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক।’
তৃণমূলের নেতাদের সম্প্রতি ভাষণ দিতে গেলে, উন্নয়নের কথা বলতে গেলে, দুর্নীতির প্রসঙ্গে উত্তর দিতে হচ্ছে। এটা কি অস্বস্তির? প্রশ্ন শুনে মমতা বললেন: ‘আমাকে তো কেউ জিজ্ঞেস করেনি আজ পর্যন্ত। আমি তো বরং বলছি, লোকে বলছে, অলি গলি মে শোর হ্যায়, বিজেপি চোর হ্য়ায়। সব গুন্ডা মাফিয়ারা ওদের দলে। কারণ, ওয়াশিং মেশিন। কালোগুলো ওখানে ফেললেই সাদা হয়ে যাচ্ছে।’
উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের ঝুলি শূন্য প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা – ‘ঝুলি শূন্য কি ভরা আমি জানি না। আমার একটা দায়বদ্ধতা ছিল উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন করা। আমি আমার কাজ করেছি। কোচবিহারে হেরিটেজ টাউন, মদনমোহন মন্দির, জল্পেশ মন্দির, কোচবিহার বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ভোরের আলো, বেঙ্গল সাফারি, ডুয়ার্স কন্যা, জলপাইগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ, আলিপুরদুয়ার মেডিক্যাল কলেজ, দার্জিলিং মেডিক্যাল কলেজ করেছি। সবটাই করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ-ভুটান-নেপালকে সংযোগকারী রাস্তা করা হয়েছে। কত ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে, হোম স্টে বেড়েছে।’
উত্তরবঙ্গ প্রসঙ্গে মমতা: ‘আমি উত্তরবঙ্গকে ভালবাসি। যখন রেলমন্ত্রী ছিলাম, উত্তরবঙ্গ রেললাইন করে দিয়েছিলাম। শতাব্দী প্রথম আমি করে দিয়েছিলাম। কাঞ্চনকন্যা, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, পদাতিক এক্সপ্রেস করে দিয়েছিলাম। পুরো উত্তরবঙ্গকে কানেক্ট করেছিলাম পঞ্জাবের সঙ্গে, দিল্লির সঙ্গে, দিঘার সঙ্গে, কামাক্ষার সঙ্গে। উত্তরবঙ্গের প্রতি ভালবাসা আমার সবসময়ই আছে। দার্জিলিং টয় ট্রেন যে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ, এটাও তো আমি এসেই করেছিলাম। কেউ কেউ ওদের বিপরীত দিকে বিচরণ করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু এখন ওরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে। আমাদের সরকার ওদের ৫৯টি চা বাগান খুলে দিয়েছে। ‘
প্রশান্ত কিশোর সংক্রান্ত প্রশ্নে মমতা: ‘এরা কোনও ভোটকুশলী নয়। এরা হল পেশাদার। যাদের আমরা টাকা দিয়ে ভাড়া করি। এরকম অনেক সংস্থা আছে। তারা যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে কাজ করতে পারে। সেটা তাদের স্বাধীনতা। এখন এরকম অনেক আইটি সংস্থা দেশে আছে। ওরা তো আগে চন্দ্রবাবু নাইডু, জগনের হয়েও কাজ করেছে। এবার তো বিজেপি-চন্দ্রবাবু নাইডুর জোটের হয়েও কাজ করছে। ওরা কী বলবে না বলবে, সেটার উপর কিছু নির্ভর করে না। ওরা কোনওদিন আমার ভোটকুশলী নয়। আইটি সংস্থা যা করতে পারে, সেটা ডেটা দেওয়া। কিন্তু এরা নীতি নির্ধারক নয় এবং মানুষের সঙ্গে এদের সরাসরি কোনও যোগ নেই।’
বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট প্রসঙ্গে মমতা: ‘ইন্ডিয়া জোটই থাকবে। নেতৃত্বে কে থাকবে, সেটা আমরা নিজেরা ঠিক করে নেব। দরকার হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ছোট্ট ভূমিকা পালন করবে- যাতে সরকার শক্তিশালী হয়, মানুষের কাজ হয়, স্থায়ী সরকার হয়, যুবক-কৃষক-মহিলাদের কাজগুলি হয়। এটা আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমার একটা ভূমিকা থাকবে।’
বিজেপি কি এবারের ভোটে পরাস্ত হবে? সেই প্রশ্নে মমতা বললেন, ‘কেন হারবে না?… যদি তারা এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে এত এজেন্সি কাজে লাগাবে কেন? এত গ্রেফতার করবে কেন? এত ভয় পাচ্ছে কেন? আমাদের তো কিছু না থেকেও, আমরা ভয় পাচ্ছি না। দেশটাকেই তো বিক্রি করে দিয়েছে। ওয়ান নেশন, ওয়ান ইলেকশন মানে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো বলে আর কিছু থাকবে না। গোটা দেশটায় হয়ে যাবে প্রেসিডেনশিয়াল ফর্ম অব ইলেকশন।’
এজেন্সির অতিসক্রিয়তার অভিযোগ সব বিরোধী দলগুলিই করছে, বিবৃতিও দিচ্ছে। কিন্তু, বিরোধীদের সংগঠিত আন্দোলন কি দেখা যাচ্ছে? সেই প্রসঙ্গে প্রশ্নে মমতা বললেন, ‘কেজরীর ব্যাপারে প্রতিবাদ হয়েছে, আমরাও আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠিয়েছি। আমাদের প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে, এই মুহূর্তে আমি যেতে পারছি না। হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী ফোন করেছিলেন, ২১ তারিখ ঝাড়খণ্ডে প্রোগ্রাম আছে। আমি সেখানে দু’জনকে পাঠাচ্ছি। আমি যেহেতু প্রচারে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি, যেহেতু আমাকে লড়তে হচ্ছে কংগ্রেস-সিপিএমের বিরুদ্ধে… তাই একমঞ্চে আমি কীভাবে থাকব? আমি এখানে লড়ব আর ওখানে একসঙ্গে প্রোগ্রাম করব… এটা দ্বিচারিতা হবে না? ইন্ডিয়া নামটা আমার দেওয়া। সে জন্য আমার একটা দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা আছে। সেটা আমি পালন করি। কিন্তু এখানে কোনও জোট হয়নি। এর জন্য দায়ি কংগ্রেস ও সিপিএম। সিপিএমের নিজস্ব ইন্টারেস্ট আছে। তারা চায় না, আমি কোনও ভাল কাজ দায়িত্ব নিয়ে করি।’
কপ্টার তল্লাশি প্রসঙ্গে মমতা: ‘বেছে বেছে পার্টিগুলিকে কেন (টার্গেট করা হচ্ছে)? প্রথমে কপ্টার কম্পানিগুলিকে বলেছে, বিরোধী দলগুলির কাউকে দেওয়া যাবে না। দেওয়ার পর নানান রকম চাপ দেওয়া হচ্ছে। যাতে আমরা প্রোগ্রাম ঠিকমতো করতে না পারি। আমারও তো দুদিন মেশিন খারাপ হয়ে গিয়েছে। সাত ঘণ্টা গাড়িতে জার্নি করে পুরুলিয়ায় গিয়ে সভা করলাম। অভিষেক হলদিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল। আয়কর দফতরকে পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে, সোনা-টাকা নিয়ে যাচ্ছে। গিয়ে তো একটাও সোনার পয়সাও পায়নি। আমি তো অভিষেককে বলব, মানহানির মামলা কর, ১০ হাজার কোটি টাকার। চরিত্রহনন করা হয়েছে। কিছু পেলে নিশ্চয়ই অ্য়াকশন নিত। কিন্তু যা ইচ্ছে তাই করবে, এটা ভারতবর্ষ নয়। আমি এই দেশকে চিনি না। আমি এই বাংলাকে চিনি না। আমি এই আয়কর দফতর, ইডি, সিবিআই, এনআইএ চিনি না।’
বিজেপিকে নিশানা করে মমতা: ‘ওদের যা আচারণ, যে নির্বাচনী ইস্তেহার দেখছি, যে শারীরিক, মৌখিক ভাষা… যদি কেউ মনেই করে জিতবে, যদি এতই আত্মবিশ্বাসী হয়… তাহলে গালাগালি দেব কেন? এজেন্সিকে কাজে লাগাবে কেন? মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করবে কেন? প্রতিদিন বিরোধী দলের বাড়িতে এনআইএ পাঠাবে কেন? বুথ এজেন্টদের গ্রেফতার করবে কেন?’
বিজেপির আত্মবিশ্বাস প্রসঙ্গে মমতা: ‘আমার মনে একটা প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। অনেকে নির্বাচন কমিশনে আরটিআই করে জানতে চেয়েছে, কোন কোম্পানিকে দিয়ে ইভিএম মেশিনের চিপ বসানো হচ্ছে। আমি এটাকে নির্বাচন কমিশন বলব না। ওটা বিজেপি কমিশন। একেবারে কাঠের পুতুলের মতো চলছে। তারা কিছু বলছে না। মুখই খুলছে না। এটা তো বলতেই পারে কোন কোম্পানিকে দিয়ে বানানো? তাহলে কি বিজেপি চিপের উপর ভরসা করছে? ভোটের মেশিনকে কবজা করবে বলে বলছে? এই ৪০০ পার বলার কোনও যৌক্তিকতা নেই।’
রাকেশ টিকাইত সম্প্রতি বলেছেন, কেজরীবাল হয়ে গিয়েছে, হেমন্ত সোরেন হয়ে গিয়েছে, এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টার্ন… সেই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় যে কোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি। আমার ঘর যা জেলও তাই। কোনও যায় আসে না। আমি অনেক সংঘর্ষ করেছি। মার খেতে খেতে জিন্দা লাশ হয়ে বসে আছি। কাজে আমাকে ওরা কবে জেলে পাঠাবে, সেই ভয়ে বসে থাকার পাত্রী আমি নই। জেলে গেলে বরং আমি একটু বিশ্রাম পাব। এদের যা অত্যাচার, তার থেকে জেলে যাওয়া অনেক ভাল। দেশের গণতন্ত্রটাকেই তো জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
বিজেপি ২০০ পার করতে পারবে কি না, সে নিয়ে সম্প্রতি একাধিক সভায় সংশয় প্রকাশ করেছে মমতা। সেই প্রসঙ্গে প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আগের বার সবথেকে উচ্চতায় ছিল। তখন পেয়েছিল ৩০৩। তারপর তো একে ভেঙে, ওকে ভেঙে, কিছু পার্টিকে নিয়ে করছিল। একবার ভারতে কংগ্রেস ৪০০ পেয়েছিল। সেইবার ইন্দিরা গান্ধী মারা গিয়েছিলেন। রাজীবজি নিজেও জানতেন। বাংলা থেকে সেবার কংগ্রেস ১৬টি আসন পেয়েছিল। সেই বার মানুষের মধ্যে একটা বিদ্রোহ ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা মানুষ মেনে নিতে পারেনি। আমি অনেক প্রধানমন্ত্রী দেখেছি। অটলজrকেও দেখেছি। তিনিও স্লোগান দিয়েছিলেন, ইন্ডিয়া ইজ় শাইনিং। লাভ কী হয়েছিল? হেরে গিয়েছিলেন। ওরা ৪০০ পার করবে, কীভাবে বলছে আমি জানি না।’
বিজেপির ‘৪০০ পার’ দাবি প্রসঙ্গে মমতা: ‘আগামী দিনে সরকার কে করবে, সেটা জনগণ ঠিক করবে। কেউ তার সংখ্যা বলে দিতে পারে না। এমনকী জ্যোতিষীরাও বলতে পারে না। কোন হিসেব নিকেশের ভিত্তিতে মোদীবাবু বা বিজেপিবাবুরা একথা বলছেন, তা আমি জানি না। ২০২১ সালের নির্বাচনে এসে বলেছিল, ইস বার ২০০ পার। যেহেতু বাংলায় ২৯৩টা বিধানসভা আসন। পেয়েছিল ৭৫-এর কাছাকাছি। তারপর দশটা ফিরে এসেছে। একশোও পার করতে পারেনি। এবার বড় মুখ করে বলছে ইস বার ৪০০ পার। ৪০০ পার বলতে গেলে, ৪২০-ও হতে পারে, তাহলে ৩৯৯ হবে না? মানেটা কী? জনগণ এন্ট্রি করবে, জনগণ আবার নো এন্ট্রিও করে দেবে।’
মুখ্যমন্ত্রী: ‘আমি আমার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এখন কোনও আলোচনা করব না। বাংলায় আমরা একাই লড়ছি। বাংলায় কোনও ইন্ডিয়া জোট নেই। কারণ, সিপিএম-কংগ্রেস আলাদা আলাদা লড়ছে এবং বিজেপির হাত শক্তিশালী করছে। প্রতিবারই করে। কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের কুস্তি, আবার বাংলায় দোস্তি। একটা পার্টির দু’টো মুখ – এটা কখনও হতে পারে না। আমি প্রথম থেকেই বলেছিলাম, হয় অ্যাডজাস্ট করো, নাহলে আমি একা লড়ব। আমরা বাংলায় একা লড়ছি। তৃণমূল লড়ছে বিজেপির বিরুদ্ধে। লড়াইটা আমরা একাই করতে চাই। বিজেপিকে হারানোর জন্য আমরা কোনও কম্প্রোমাইজ করব না। সিপিএম, কংগ্রেস কম্প্রোমাইজ করতে পারে। কিন্তু আমরা এটা করব না।’
কলকাতা: প্রথম দফার ভোটের মুখে টিভি নাইন বাংলায় একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা ভোটের আগে রাজ্য রাজনীতি থেকে শুরু করে জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন আঙ্গিক উঠে এল মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত আলাপচারিতায়। বাংলায় একলা চলার নীতি, ইন্ডিয়া জোটের আগামীর রূপরেখা… সব নিয়েই খোলামেলা আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরএসএস প্রসঙ্গে মমতা: ‘আমি একসময় আরএসএস-কে ভাবতাম, এদের মধ্যে কিছুটা মাধুর্য্য থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু সেটা এখন ফুরিয়ে গিয়েছে।’
মমতা: ‘কেউ যদি আমাকে গালি দেয়, আমি তাকে শুভনন্দন বলব। কিছুদিন আগেই, চালসা দিয়ে যাচ্ছিলাম। বিজেপি একটা মিছিল করছিল। আমার গাড়িটা দেখে অশ্রাব্য ভাষায় কথাবার্তা বলছিল। অন্য কেউ হলে টেনে দুটো চড় মারত। আমি কিচ্ছু করিনি, হাসতে হাসতে বেরিয়ে গিয়েছি। রাজনীতি করতে গেলে ধৈর্য্য ধরতে হয়।’
সন্দেশখালি নিয়ে প্রশ্নে মমতা: ‘এত ঘটনা থাকতে, একটা ঘটনার কথা কেন বলছেন? সারা বাংলায় কত ব্লক আছে। কেন বাকিগুলির বিষয়ে কথা বলছেন না? ওখানে কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। যদি কিছু ঘটেও থাকে, জানার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ পদক্ষেপ করেছে। আমি সন্দেশখালির মা-বোনদের সম্মান করি। আমি অনেকের থেকে শুনেছি, যাঁরা তদন্ত করছিলেন, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও টাকার বান্ডিলও পৌঁছেছিল। হ্যাঁ, সন্দেশখালিতে কিছু কিছু হয়েছিল। সেটা হল জমি সংক্রান্ত বিষয়। সেটা তো দুয়ারে সরকারে বা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীতে অভিযোগ জানাতে পারত। আমার কাছে তো কোনও অভিযোগ জানায়নি। আমি যদি কোনও কাগজেও দেখতাম, তাহলেও অ্যাকশন নিতে পারতাম। আমি যখনই জেনেছি, সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নিয়েছি। এটা আর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম এক নয়।’
অভিষেক প্রসঙ্গে মমতা: ‘অভিষেক দলের একজন একনিষ্ঠ সৈনিক। ছোট্টবেলা থেকে আমি তৈরি করেছি। ওর যখন আড়াই বছর বয়স, তখন আমাকে হাজরায় মেরেছিল সিপিএম। ও তখন থেকে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বলত, দিদিকে মারলে কেন সিপিএম জবাব দাও। তখন থেকেও ওর রাজনৈতিক মনন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কলেজ পাশ করার পর থেকে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে আসে। আমি চাই ওরা ভালভাবে তৈরি হোক। নতুন প্রজন্মকেও দরকার। আজকের দিনে দেখুন, দেবাংশু টিকিট পেয়েছে। সায়নী টিকিট পেয়েছে। রচনা থেকে শুরু করে অনেকে টিকিট পেয়েছে। আমি তিনটে প্রজন্ম তৈরি করে দিয়েছি। এটা আমার গর্ব। কারণ, আমি যদি প্রজন্ম তৈরি না করি, তাহলে আমার স্বপ্নের তৃণমূল কংগ্রেসকে কে রক্ষা করবে!’
মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের প্রশ্নে মমতা: ‘আমরা সবাইকে নিয়ে চলি। এটা নিয়ে ভাগাভাগি করবেন না। সবাই আমাদের সঙ্গে আছে। এখানে হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই। আমরা সর্বধর্ম সমন্বয় মেনে চলি। আমরা মসজিদ, মন্দির, গুরুদ্বার, গির্জা সর্বত্রই যাই।’
বামেদের প্রসঙ্গে মমতা: ‘আমি ওদের বিশ্বাস করি না। ওরা পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে পুরসভা, বিধানসভায় চিরকাল বিজেপিকে সাহায্য করেছে। তার বিনিময়ে ওরা কেউ জেলে যায়নি। সবথেকে বেশি চিটফান্ড তো ওরাই এনেছিল বাংলায়। আমরা তো কাশ্মীর থেকে সারদাকাণ্ডে গ্রেফতার করে এনেছিলাম। বামদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উঠেছে? যত অভিযোগ চেপে দিয়েছে। কারও ওরা বিজেপির গোপন বন্ধু। ওদের ভোট দিয়ে একটাও লাভ নেই। ওদের ভোট দিলে হয় বিজেপিতে যাবে, নাহলে ভোটটা নষ্ট হবে। যদি স্লোগানও হয় নো ভোট টু বিজেপি, আমি বলব ভোটটা তৃণমূলকে দিন। প্রত্যেকটি ভোট মূল্যবান।’
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমার মতে, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও দারিদ্র। বাংলায় দারিদ্র আমরা ৪০ শতাংশ কমিয়েছি।’
মমতা: ‘সবটাই জনমুখী হবে। এখানে দেখেছেন আমরা কত প্রকল্প করেছি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। কেন্দ্রে যদি আমাদের ক্ষমতা আসে, তাহলে আমাদের হাত আরও শক্তিশালী হবে। রাজ্যে যেমন রাজ্যের পাওনা পাবে, আমরা মানুষের কাজ আরও ভালভাবে করতে পারবে। একইসঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথভাবে আরও মানুষের উপকার করতে পারবে। বেকারত্বের সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকদের সমস্যা, মহিলাদের সমস্যাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
দু’জন মন্ত্রী জেলে গিয়েছেন, সেই প্রসঙ্গে প্রশ্নে মমতা: ‘এখনও বিচার শেষ হয়নি। বিচারের রায় কারা দিয়েছে, তাদের মধ্যে একজনকে দেখতেই পাচ্ছেন… বিজেপির হয়ে লড়ছেন। আমাকে এই প্রশ্ন করতে গেলে, আগে বিজেপির দুর্নীতির কথা বলতে হবে। পিএম কেয়ার ফান্ডের টাকা কেউ জানে কোথায় গেছে? ইজরায়েলে গিয়ে এত প্রতিরক্ষার ডিল হল, কেউ জানে কত কোটি কোটি টাকার ডিল হয়েছে? কালো টাকা দেশে নিয়ে আসবে বলেছিল… কী হল! আর গরু ব্যবসা? সে তো বিএসএফ-এর হাতে। আমাদের হাতে তো নয়। কেন রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ হয়ে গরু আসবে? কোল ইন্ডিয়া কার অধীনে? কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। যেগুলি বলা হচ্ছে, সেটা একটা ভাওতা। ৩৫০টা টিম পাঠিয়ে একটাও দুর্নীতি পায়নি। যা প্রশ্ন জানতে চেয়েছে, সব উত্তর আমরা দিয়েছি। আবাস থেকে একশো দিনের কাজ। বের করতে বলুন শ্বেতপত্র। বাংলার সঙ্গে উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও মহারাষ্ট্র – চারটি রাজ্য নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক।’
তৃণমূলের নেতাদের সম্প্রতি ভাষণ দিতে গেলে, উন্নয়নের কথা বলতে গেলে, দুর্নীতির প্রসঙ্গে উত্তর দিতে হচ্ছে। এটা কি অস্বস্তির? প্রশ্ন শুনে মমতা বললেন: ‘আমাকে তো কেউ জিজ্ঞেস করেনি আজ পর্যন্ত। আমি তো বরং বলছি, লোকে বলছে, অলি গলি মে শোর হ্যায়, বিজেপি চোর হ্য়ায়। সব গুন্ডা মাফিয়ারা ওদের দলে। কারণ, ওয়াশিং মেশিন। কালোগুলো ওখানে ফেললেই সাদা হয়ে যাচ্ছে।’
উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের ঝুলি শূন্য প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা – ‘ঝুলি শূন্য কি ভরা আমি জানি না। আমার একটা দায়বদ্ধতা ছিল উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন করা। আমি আমার কাজ করেছি। কোচবিহারে হেরিটেজ টাউন, মদনমোহন মন্দির, জল্পেশ মন্দির, কোচবিহার বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ভোরের আলো, বেঙ্গল সাফারি, ডুয়ার্স কন্যা, জলপাইগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ, আলিপুরদুয়ার মেডিক্যাল কলেজ, দার্জিলিং মেডিক্যাল কলেজ করেছি। সবটাই করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ-ভুটান-নেপালকে সংযোগকারী রাস্তা করা হয়েছে। কত ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে, হোম স্টে বেড়েছে।’
উত্তরবঙ্গ প্রসঙ্গে মমতা: ‘আমি উত্তরবঙ্গকে ভালবাসি। যখন রেলমন্ত্রী ছিলাম, উত্তরবঙ্গ রেললাইন করে দিয়েছিলাম। শতাব্দী প্রথম আমি করে দিয়েছিলাম। কাঞ্চনকন্যা, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, পদাতিক এক্সপ্রেস করে দিয়েছিলাম। পুরো উত্তরবঙ্গকে কানেক্ট করেছিলাম পঞ্জাবের সঙ্গে, দিল্লির সঙ্গে, দিঘার সঙ্গে, কামাক্ষার সঙ্গে। উত্তরবঙ্গের প্রতি ভালবাসা আমার সবসময়ই আছে। দার্জিলিং টয় ট্রেন যে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ, এটাও তো আমি এসেই করেছিলাম। কেউ কেউ ওদের বিপরীত দিকে বিচরণ করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু এখন ওরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে। আমাদের সরকার ওদের ৫৯টি চা বাগান খুলে দিয়েছে। ‘
প্রশান্ত কিশোর সংক্রান্ত প্রশ্নে মমতা: ‘এরা কোনও ভোটকুশলী নয়। এরা হল পেশাদার। যাদের আমরা টাকা দিয়ে ভাড়া করি। এরকম অনেক সংস্থা আছে। তারা যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে কাজ করতে পারে। সেটা তাদের স্বাধীনতা। এখন এরকম অনেক আইটি সংস্থা দেশে আছে। ওরা তো আগে চন্দ্রবাবু নাইডু, জগনের হয়েও কাজ করেছে। এবার তো বিজেপি-চন্দ্রবাবু নাইডুর জোটের হয়েও কাজ করছে। ওরা কী বলবে না বলবে, সেটার উপর কিছু নির্ভর করে না। ওরা কোনওদিন আমার ভোটকুশলী নয়। আইটি সংস্থা যা করতে পারে, সেটা ডেটা দেওয়া। কিন্তু এরা নীতি নির্ধারক নয় এবং মানুষের সঙ্গে এদের সরাসরি কোনও যোগ নেই।’
বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট প্রসঙ্গে মমতা: ‘ইন্ডিয়া জোটই থাকবে। নেতৃত্বে কে থাকবে, সেটা আমরা নিজেরা ঠিক করে নেব। দরকার হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ছোট্ট ভূমিকা পালন করবে- যাতে সরকার শক্তিশালী হয়, মানুষের কাজ হয়, স্থায়ী সরকার হয়, যুবক-কৃষক-মহিলাদের কাজগুলি হয়। এটা আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমার একটা ভূমিকা থাকবে।’
বিজেপি কি এবারের ভোটে পরাস্ত হবে? সেই প্রশ্নে মমতা বললেন, ‘কেন হারবে না?… যদি তারা এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে এত এজেন্সি কাজে লাগাবে কেন? এত গ্রেফতার করবে কেন? এত ভয় পাচ্ছে কেন? আমাদের তো কিছু না থেকেও, আমরা ভয় পাচ্ছি না। দেশটাকেই তো বিক্রি করে দিয়েছে। ওয়ান নেশন, ওয়ান ইলেকশন মানে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো বলে আর কিছু থাকবে না। গোটা দেশটায় হয়ে যাবে প্রেসিডেনশিয়াল ফর্ম অব ইলেকশন।’
এজেন্সির অতিসক্রিয়তার অভিযোগ সব বিরোধী দলগুলিই করছে, বিবৃতিও দিচ্ছে। কিন্তু, বিরোধীদের সংগঠিত আন্দোলন কি দেখা যাচ্ছে? সেই প্রসঙ্গে প্রশ্নে মমতা বললেন, ‘কেজরীর ব্যাপারে প্রতিবাদ হয়েছে, আমরাও আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠিয়েছি। আমাদের প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে, এই মুহূর্তে আমি যেতে পারছি না। হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী ফোন করেছিলেন, ২১ তারিখ ঝাড়খণ্ডে প্রোগ্রাম আছে। আমি সেখানে দু’জনকে পাঠাচ্ছি। আমি যেহেতু প্রচারে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি, যেহেতু আমাকে লড়তে হচ্ছে কংগ্রেস-সিপিএমের বিরুদ্ধে… তাই একমঞ্চে আমি কীভাবে থাকব? আমি এখানে লড়ব আর ওখানে একসঙ্গে প্রোগ্রাম করব… এটা দ্বিচারিতা হবে না? ইন্ডিয়া নামটা আমার দেওয়া। সে জন্য আমার একটা দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা আছে। সেটা আমি পালন করি। কিন্তু এখানে কোনও জোট হয়নি। এর জন্য দায়ি কংগ্রেস ও সিপিএম। সিপিএমের নিজস্ব ইন্টারেস্ট আছে। তারা চায় না, আমি কোনও ভাল কাজ দায়িত্ব নিয়ে করি।’
কপ্টার তল্লাশি প্রসঙ্গে মমতা: ‘বেছে বেছে পার্টিগুলিকে কেন (টার্গেট করা হচ্ছে)? প্রথমে কপ্টার কম্পানিগুলিকে বলেছে, বিরোধী দলগুলির কাউকে দেওয়া যাবে না। দেওয়ার পর নানান রকম চাপ দেওয়া হচ্ছে। যাতে আমরা প্রোগ্রাম ঠিকমতো করতে না পারি। আমারও তো দুদিন মেশিন খারাপ হয়ে গিয়েছে। সাত ঘণ্টা গাড়িতে জার্নি করে পুরুলিয়ায় গিয়ে সভা করলাম। অভিষেক হলদিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল। আয়কর দফতরকে পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে, সোনা-টাকা নিয়ে যাচ্ছে। গিয়ে তো একটাও সোনার পয়সাও পায়নি। আমি তো অভিষেককে বলব, মানহানির মামলা কর, ১০ হাজার কোটি টাকার। চরিত্রহনন করা হয়েছে। কিছু পেলে নিশ্চয়ই অ্য়াকশন নিত। কিন্তু যা ইচ্ছে তাই করবে, এটা ভারতবর্ষ নয়। আমি এই দেশকে চিনি না। আমি এই বাংলাকে চিনি না। আমি এই আয়কর দফতর, ইডি, সিবিআই, এনআইএ চিনি না।’
বিজেপিকে নিশানা করে মমতা: ‘ওদের যা আচারণ, যে নির্বাচনী ইস্তেহার দেখছি, যে শারীরিক, মৌখিক ভাষা… যদি কেউ মনেই করে জিতবে, যদি এতই আত্মবিশ্বাসী হয়… তাহলে গালাগালি দেব কেন? এজেন্সিকে কাজে লাগাবে কেন? মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করবে কেন? প্রতিদিন বিরোধী দলের বাড়িতে এনআইএ পাঠাবে কেন? বুথ এজেন্টদের গ্রেফতার করবে কেন?’
বিজেপির আত্মবিশ্বাস প্রসঙ্গে মমতা: ‘আমার মনে একটা প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। অনেকে নির্বাচন কমিশনে আরটিআই করে জানতে চেয়েছে, কোন কোম্পানিকে দিয়ে ইভিএম মেশিনের চিপ বসানো হচ্ছে। আমি এটাকে নির্বাচন কমিশন বলব না। ওটা বিজেপি কমিশন। একেবারে কাঠের পুতুলের মতো চলছে। তারা কিছু বলছে না। মুখই খুলছে না। এটা তো বলতেই পারে কোন কোম্পানিকে দিয়ে বানানো? তাহলে কি বিজেপি চিপের উপর ভরসা করছে? ভোটের মেশিনকে কবজা করবে বলে বলছে? এই ৪০০ পার বলার কোনও যৌক্তিকতা নেই।’
রাকেশ টিকাইত সম্প্রতি বলেছেন, কেজরীবাল হয়ে গিয়েছে, হেমন্ত সোরেন হয়ে গিয়েছে, এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টার্ন… সেই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় যে কোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি। আমার ঘর যা জেলও তাই। কোনও যায় আসে না। আমি অনেক সংঘর্ষ করেছি। মার খেতে খেতে জিন্দা লাশ হয়ে বসে আছি। কাজে আমাকে ওরা কবে জেলে পাঠাবে, সেই ভয়ে বসে থাকার পাত্রী আমি নই। জেলে গেলে বরং আমি একটু বিশ্রাম পাব। এদের যা অত্যাচার, তার থেকে জেলে যাওয়া অনেক ভাল। দেশের গণতন্ত্রটাকেই তো জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
বিজেপি ২০০ পার করতে পারবে কি না, সে নিয়ে সম্প্রতি একাধিক সভায় সংশয় প্রকাশ করেছে মমতা। সেই প্রসঙ্গে প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আগের বার সবথেকে উচ্চতায় ছিল। তখন পেয়েছিল ৩০৩। তারপর তো একে ভেঙে, ওকে ভেঙে, কিছু পার্টিকে নিয়ে করছিল। একবার ভারতে কংগ্রেস ৪০০ পেয়েছিল। সেইবার ইন্দিরা গান্ধী মারা গিয়েছিলেন। রাজীবজি নিজেও জানতেন। বাংলা থেকে সেবার কংগ্রেস ১৬টি আসন পেয়েছিল। সেই বার মানুষের মধ্যে একটা বিদ্রোহ ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা মানুষ মেনে নিতে পারেনি। আমি অনেক প্রধানমন্ত্রী দেখেছি। অটলজrকেও দেখেছি। তিনিও স্লোগান দিয়েছিলেন, ইন্ডিয়া ইজ় শাইনিং। লাভ কী হয়েছিল? হেরে গিয়েছিলেন। ওরা ৪০০ পার করবে, কীভাবে বলছে আমি জানি না।’
বিজেপির ‘৪০০ পার’ দাবি প্রসঙ্গে মমতা: ‘আগামী দিনে সরকার কে করবে, সেটা জনগণ ঠিক করবে। কেউ তার সংখ্যা বলে দিতে পারে না। এমনকী জ্যোতিষীরাও বলতে পারে না। কোন হিসেব নিকেশের ভিত্তিতে মোদীবাবু বা বিজেপিবাবুরা একথা বলছেন, তা আমি জানি না। ২০২১ সালের নির্বাচনে এসে বলেছিল, ইস বার ২০০ পার। যেহেতু বাংলায় ২৯৩টা বিধানসভা আসন। পেয়েছিল ৭৫-এর কাছাকাছি। তারপর দশটা ফিরে এসেছে। একশোও পার করতে পারেনি। এবার বড় মুখ করে বলছে ইস বার ৪০০ পার। ৪০০ পার বলতে গেলে, ৪২০-ও হতে পারে, তাহলে ৩৯৯ হবে না? মানেটা কী? জনগণ এন্ট্রি করবে, জনগণ আবার নো এন্ট্রিও করে দেবে।’
মুখ্যমন্ত্রী: ‘আমি আমার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এখন কোনও আলোচনা করব না। বাংলায় আমরা একাই লড়ছি। বাংলায় কোনও ইন্ডিয়া জোট নেই। কারণ, সিপিএম-কংগ্রেস আলাদা আলাদা লড়ছে এবং বিজেপির হাত শক্তিশালী করছে। প্রতিবারই করে। কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের কুস্তি, আবার বাংলায় দোস্তি। একটা পার্টির দু’টো মুখ – এটা কখনও হতে পারে না। আমি প্রথম থেকেই বলেছিলাম, হয় অ্যাডজাস্ট করো, নাহলে আমি একা লড়ব। আমরা বাংলায় একা লড়ছি। তৃণমূল লড়ছে বিজেপির বিরুদ্ধে। লড়াইটা আমরা একাই করতে চাই। বিজেপিকে হারানোর জন্য আমরা কোনও কম্প্রোমাইজ করব না। সিপিএম, কংগ্রেস কম্প্রোমাইজ করতে পারে। কিন্তু আমরা এটা করব না।’