Anubrata Mondal: অনুব্রত এলেন, বিদায় নিলেন ‘ছায়া’ অনুব্রত! এবার ‘বীরের’ সম্মান মেলার অপেক্ষা!

জয়দীপ দাস | Edited By: সোমনাথ মিত্র

Sep 26, 2024 | 12:04 PM

Anubrata Mondal: অনেকই বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব পছন্দের কিছু মানুষ যদি থাকে, অনুব্রত মণ্ডল সেই তালিকায় উপরের সারিতে থাকবে। ভালবেসে অনুব্রতকে ‘কেষ্ট’ বলে ডাকেন মমতা। তাঁর চলে যাওয়ার পরও এতটুকু ভরসা টলেনি তাঁর।

Anubrata Mondal: অনুব্রত এলেন, বিদায় নিলেন ‘ছায়া’ অনুব্রত! এবার বীরের সম্মান মেলার অপেক্ষা!
৭৪০ দিন শ্রী ঘরে শ্রীমান! ‘অনু’ প্রবেশের আগে কেমন ছিল বীরভূম?
Image Credit source: Getty Images

Follow Us

 

২০২৩, মার্চ মাস। চাঁদিফাটা গরম। অনুব্রত মণ্ডলকে দিল্লিতে নিয়ে আসতে ঘেমে নেয়ে একশা ইডির তদন্তকারীরা। শেষমেশ ৮ মার্চ দোলের দিন রবিঠাকুরের ‘লালমাটির দেশ’ থেকে কেষ্টকে উড়িয়ে নিয়ে গেলেন তাঁরা। যেমন বিসর্জনের পর শূন্যতায় ঢাকে ঠাকুরদালান, তেমনই খাঁ খাঁ করছিল নিচুপট্টির নীলরঙা দোতলা বাড়ি। এক সময় গমগম করত বাড়ির নীচে অনুব্রতর অফিস। নেতা মন্ত্রী থেকে পুলিশ, কে থাকত না! সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত নীলবাতির গাড়ি। সে দিন শুধুই শূন্য। তবে, সেদিন থেকেই অলক্ষ্যে বীরভূমে প্রবেশ হয় ছায়া-অনুব্রতর। যাঁর অবাধ চরাচর। কে এই ছায়া-অনুব্রত? অনেকে মনে করেন, অনুব্রত চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ছায়া রয়ে গিয়েছে এই বীরভূমে। তাঁকে ছাড়া কোনও কাজ সম্ভব নয়। এমনকী, গাছের পাতাও পড়ত এই ছায়া-অনুব্রতর অনুমতিতেই। তবে, এই ছায়া-অনুব্রতরও উত্থান-পতন দেখা গিয়েছে। ৭৪০ দিন তিহাড়ে বন্দি ছিলেন অনুব্রত। তাঁর অবর্তমানে বীরভূম অনেকটাই বদলেছে। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কেষ্ট-বিরোধীরা। প্রকট হয়ে ওঠে গোষ্ঠী কন্দোল। সেই সময় কেমন  ছিল এই ছায়া-অনুব্রতর ভূমিকা? কীভাবে তিনি না থেকেও প্রতি মুহূর্তে তাঁর উপস্থিতি জানান দিয়েছেন, চলুন দেখা যাক।    

মমতা ও কেষ্ট

অনেকই বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব পছন্দের কিছু মানুষ যদি থাকে, অনুব্রত মণ্ডল সেই তালিকায় উপরের সারিতে থাকবে। ভালবেসে অনুব্রতকে ‘কেষ্ট’ বলে ডাকেন মমতা। তাঁর চলে যাওয়ার পরও এতটুকু ভরসা টলেনি তাঁর। অন্তত সেই সময় তৃণমূল সুপ্রিমো যে সব বক্তব্য রাখেন তাতেই তা স্পষ্ট। অনুব্রতর গ্রেফতারির পর মমতা উদ্বেগের সঙ্গেই বলেছিলেন, “কেন কেষ্টকে দিল্লি নিয়ে যাচ্ছে, পঞ্চায়েত ভোট আসছে বলে? তাহলে পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত বা লোকসভা ভোট, ওরা অনেককে গ্রেফতার করবে। যাতে ভোট যেভাবেই হোক দখলে নিতে পারে। এটাই ওরা করে। ওদের অভ্যাস।” 

এমনকী কর্মীদের নির্দেশও দিয়েছিলেন, “কেষ্ট এখন জেলে। ওর মেয়ে একা রয়েছে। তোরা ওর বাড়ির খোঁজ খবর রাখিস।” অভিভাবকের মতো কেষ্টর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মমতা। সেখান থেকেই জন্ম নেয় ছায়া অনুব্রতর, যাঁর কলেবর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হতে থাকে।

জেলা সভাপতিই অনুব্রত!

গরুপাচার মামলায় অনুব্রত যখন জর্জরিত, একের পর এক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করছে ইডি, সিবিআই চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে, বিরোধীদের খোঁচায় তৃণমূল বিপর্যস্ত, এমন ঘোর দুঃসময়ে বীরভূমের জেলা সভাপতির পদ থেকে একচুলও সরানো যায়নি অনুব্রত মণ্ডলকে। কারণ, আর্শীবাদের হাত ছিল খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কেষ্টকে বহিষ্কার তো দূর, জেল থেকে ফিরলে ‘বীরের’ সম্মান দেওয়ার ‘ঘোষণা’ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কেষ্ট জেলে যাওয়ার পরই বীরভূমের তৃণমূল নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে জেলা তৃণমূল সভাপতির পদ নিয়ে এক বর্ণও আলোচনা হয়নি। বরং মমতা খোদ বীরভূমের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেন। সঙ্গে আরও তিন হেভিওয়েট নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজ্যের নগরন্নোয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম (কলকাতা), আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক (পশ্চিম বর্ধমান), পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (পশ্চিম বর্ধমান)। সেখান থেকে বোঝাই যায়, কেষ্টর ওজন কতটা। আর কেষ্ট না থাকলেও কেষ্টর জন্য সযত্নে জেলা সভপতির পদ দেরাজে তুলে রাখলেন মমতা। ফিরে এলে সেই সিংহাসনে বসবেন কেষ্ট। না-হলে মমতা বলেন, ‘‘এ বার সবাইকে তিন গুণ লড়াই করতে হবে। কেষ্টকে বীরের সম্মান দিয়ে জেল থেকে বার করে আনতে হবে।’’

অনুব্রতহীন বীরভূমে তৃণমূলের কৌশল এবং পঞ্চায়েত ভোট

এই প্রথম তৃণমূল অনুব্রতকে বাদ দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে নেমেছিল। প্রতিবার উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত, চড়াম চড়াম ঢাক বাজত, গুড় বাতাসা নকুলদানা দেওয়া হত, বিরোধীদের প্রয়োজন হলে পাঁচনও দেওয়া হত- এ সব ছিল অনুব্রতর জমানার ট্র্যাডিশন। তাতে ফল মিলেছিল হাতেনাতে। প্রায় ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল তৃণমূল। কিন্তু সেই অনুব্রতও নেই, সেই জমানাও নেই। এখানেই তৃণমূল বেশ কৌশলী চাল নেয় বীরভূমে।

একদিকে জেলা সভাপতি পদ অক্ষুন্ন রেখে অনুব্রত গোষ্ঠীকে হাতে রাখা, অন্যদিকে কেষ্ট বিরোধী বলে পরিচিত কাজল শেখকে তুলে আনা, এই দুই সমন্বয়ে বীরভূমের ভোটের ময়দানে নামে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

তৈরি হয় নতুন কোর কমিটি। তাতে থাকেন জেলা সভাধিপতি কাজল শেখ, সিউড়ির বিধায়ক বিকাশ রায় চৌধুরী। লাভপুরের  বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ। বোলপুরের বিধায়ক চন্দ্রনাথ সিংহ। যুব নেতা সুদীপ্ত ঘোষ। রামপুরহাটের বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রের খবর, এই কমিটিতে কিন্তু কাজল শেখ বাদে বাকিরা কেউ অনুব্রতর বিরুদ্ধে কখনও গলা তোলেলনি। এমনকী কাজল শেখ ঘনিষ্ঠ বলেও কাউকে দেগে দেওয়া যায়নি। বোলপুরের সিয়ানে কোর কমিটির সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন অভিষেক। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভুলে কাজের নির্দেশ দেন তিনি। 

ফিকে হতে থাকে ছায়া-অনুব্রত

কেষ্ট ছাড়া বীরভূমে তৃণমূল ভাল ফল করতে পারে, প্রমাণ হয়ে যায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে। নেতৃত্বে ছিলেন কাজল শেখ। যিনি অনুব্রতর দাপুটে সময়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচক ছিলেন। কাজল শেখের হাতে জেলার রাশ চলে আসতেই, ধীরে ধীরে সরতে থাকে অনুব্রতর ছায়া। পার্টি অফিস থেকে সরিয়ে নেওয়া অনুব্রতর ছবি। দেওয়ালে কেষ্ট নাম মুছে ফেলা হয়। বীরভূমে রাজনৈতিক সভায় আর দেখা যায় না অনুব্রতর প্লাকার্ড। 

এরপর বীরভূমের জেলা পরিষদের স্থায়ী সমিতিতে জায়গা পেলেন না কেষ্ট ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায় চৌধুরী। অনুব্রতর বৃত্তে থাকা আরও অনেকে বাতিলের খাতায় নাম লেখালেন। বীরভূমের জেলা পরিষদের সভাধিপতি হিসাবে শপথ নেন ‘ফিনিক্স  পাখি’ কাজল শেখ। মুখে কেষ্টকে অভিভাবক বললেও, বিভিন্ন সময়ে কাজল টিপ্পনী করে গিয়েছেন। 

কেষ্টহীন লোকসভা নির্বাচন

লোকসভা ভোট আসতেই অনুব্রত মণ্ডলের জায়গা পুরোপুরি দখল করে নেন কাজল শেখ। কেষ্ট সুরেই বীরভূমে দাঁড়িয়ে কাজল শেখের হুঙ্কার, “খেলা হবে অপেক্ষা করুন।” তারপরের পরের গল্প তো মোটামোটি সবার জানা। কেষ্টহীন বীরভূমে দিকে দিকে ফুটেছিল ঘাসফুল। বেড়েছিল জয়ের ব্যবধান। বীরভূম লোকসভা আসনে শেষ হাসি হেসেছিলেন শতাব্দী রায়। বোলপুর লোকসভা আসনে শেষ হাসি হেসেছিলেন অসিত মাল। ভোট প্রচারে সশরীরে অনুব্রতর উপস্থিতি না থাকলেও ছায়া অনুব্রত ছিলেন। দেওয়ালে দেওয়ালে, পোস্টারে পোস্টারে। তাঁর অনুগামীরা বিশ্বাস করতেন, জেল থেকে সব নজর রাখছেন অনুব্রত মণ্ডল। মমতা তো বলেই দিয়েছিলেন,  ‘জেলে ভরে রেখেছে, মানুষের মন থেকে মুছতে পারেনি’। 

ছায়া কেষ্ট বনাম কাজল

অজয় নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা তৃণমূল মোটের উপর গুছিয়ে নিতে পেরেছে। কাজল শেখের বাড়বাড়ন্ত হলে গোষ্ঠী কোন্দল প্রকট হতে থাকে তৃণমূলের। কেমন ছিল সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব?

একটা উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। গত বছরের শেষ দিকে হোসেনপুর গ্রামে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির পাশেই ছিল অনুব্রতর ছবি। লেখা ছিল ‘মমতা ব্যানার্জি জিন্দাবাদ’, ‘অনুব্রত মণ্ডল কেষ্টদা জিন্দাবাদ’। সেখান থেকে ‘অনুব্রত মণ্ডল কেষ্ট’ শব্দ তিনটি মুছে  সাদা রং করে দেওয়া হয়। এর নেপথ্যে কাজল শেখের অনুগামীরা বলে অভিযোগ ওঠে দলের অন্দরে।

এরপরও অনুব্রতকে সম্পূর্ণ  মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। অনেকে মনে করেছিলেন,প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে অনুব্রত মণ্ডলের। তিনি না থাকলেও ভোটে জেতা তৃণমূলের সম্ভব। কিন্তু সেটা সাহস করে উচ্চারণ করার ক্ষমতা কারোর ছিল না।  লোকসভা নির্বাচনে বীরভূমের  দেওয়াল লিখন শুরু হয়, ‘তিহাড় বসেই খেলা হবে’।  তৃণমূলের সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যেমন ভগবান অন্তরালে থেকে ভক্তদের সাহায্য করেন, ঠিক তেমন। তিনি তো তিহাড় থেকে সশরীরে এখানে আসতে পারবেন না। তাঁর শুভেচ্ছা, শুভকামনা, আশীর্বাদ নিয়েই কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এবং তাঁর অনুপ্রেরণাতেই আগামী দিনে নির্বাচনে জয়লাভ করব।’’ লোকসভা ভোটের সময় ফের কেষ্ট ঘনিষ্ঠ নেতারা ফিরে আসেন।

আবার ছায়া-অনুব্রতকে ফিরিয়ে আনলেন মমতা

অনুব্রত-কাজল অনুগামীদের দ্বন্দ্ব যখন প্রকট, তখন ফের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাশ নিজের হাতে নেন। ন’জনের কমিটিকে আরও ছোট করে দেন। কাজল শেখকে সরিয়ে দেন। পাশাপাশি অসিত মাল এবং শতাব্দী রায়ও বাদ পড়েন। পাঁচ জনের যে কমিটি মমতা তৈরি করেন, তাতে জায়গা পান অধিকাংশ অনুব্রত ঘনিষ্ঠরাই। ফের চড়াম চড়াম শব্দ শোনা যায়, অনুব্রত আগমনীর সুর বেজে ওঠে বীরভূমের আকাশে। চারদিকে আবার ফিরে আসে অনুব্রতর ছবি, প্লাকার্ড।

২ বছর ৯ দিন পর জেল থেকে মুক্ত অনুব্রত মণ্ডল। জামিন পেয়ে  ঘরে ফিরেছে ঘরের ‘বাঘ’। ঝরেছে ৩০ কেজি মেদ। আবার সেজেছে নীচুপট্টি। নেতাদের ভিড় বাড়ছে। পুলিশে ছয়লাপ। কৌতূহলী লোকজনের আনাগোনা। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে নীলবাতির গাড়ি। হয়ত আগের মতো সবই সাজছে। অনুব্রত আসতেই যার যাওয়ার পালা, যিনি নীরবে নিভৃতে বিদায় নিয়েছে, তিনি ছায়া-অনুব্রত।

দেরাজ থেকে পেড়ে কবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা সভাপতির পদ ফিরিয়ে দেবেন, বীরের সম্মান দেবেন, হয়তো সেই অপেক্ষায়  ‘আসল’ অনুব্রত।

Next Article