Civic Volunteers: লক্ষাধিক সিভিকের বেতন আসে কোথা থেকে? কেন এত ‘সর্বনাশা’ সিভিক?

Civic Volunteers: আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলায় মূল অভিযুক্ত একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। সেই মামলা শুনতে গিয়ে সিভিক ভলান্টিয়ারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়।

Civic Volunteers: লক্ষাধিক সিভিকের বেতন আসে কোথা থেকে? কেন এত 'সর্বনাশা' সিভিক?
Image Credit source: GFX- TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Oct 17, 2024 | 7:59 PM

দীক্ষা ভুঁইঞা ও সিজার মণ্ডলের রিপোর্ট

আনিস খানের মৃত্যুর ঘটনা এখনও স্মৃতি থেকে মোছেনি। বিচারের আশায় এখনও পথে পথে ঘুরছেন ছাত্রনেতার বাবা। তাঁর বাড়িতে পুলিশি অভিযান চলাকালীন মৃত্যু হয় আনিসের। অভিযোগ ছিল, সিভিক ভলান্টিয়ারের নেতৃত্বেই হয় সেই অভিযান। ঘটনায় এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতারও করা হয়। হইহই পড়ে যায় রাজ্যে। সিভিকের হাতে এত ক্ষমতা!

তবে সব সীমা ছাড়িয়ে গেল আরজি কর কাণ্ডে। যে ঘটনায় গোটা দেশ তোলপাড়, ২ মাস ধরে রাজপথে চলছে আন্দোলন, সেই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। আনিস খানের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছিল কলকাতা হাইকোর্টে। আর এবার প্রশ্ন তুললেন দেশের প্রধান বিচারপতি। কোন আইনে সিভিক নিয়োগ? এদের অপরাধের খবর কে রাখে? এই সব প্রশ্নের মুখে পড়তে হল রাজ্যকে।

রাজ্যে সিভিকের সংখ্যা লক্ষাধিক

কলকাতা এবং রাজ্যের সব জেলা মিলিয়ে এই মুহূর্তে সিভিক ভলান্টিয়ারের সংখ্যা মোট ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৬৯৬। বর্তমানে কলকাতা পুলিশে সিভিকের মোট অনুমোদিত পদ ৭৫৭৬। বর্তমানে কলকাতায় কর্মরত সিভিকের সংখ্যা ৭২১৮। আর রাজ্য রাজ্য পুলিশে মোট সিভিকের অনুমোদিত পদ ১, ২৫, ১০০। কর্মরত সিভিকের সংখ্যা ১,১৬,৪৭৮।

কারা এই সিভিক? কত বেতন পান? কোথা থেকে আসে সেই বেতন?

২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। তারপরই সিভিক নিয়োগ শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে নিয়োগের পরিমাণ। শুরু হয় সিভিক ভলেন্টিয়ার নিয়োগ। সেই সময় দিন প্রতি ১৪১ টাকা ৮১ পয়সা বেতন পেতেন তাঁরা। এরপর গত কয়েক বছরে ধাপে ধাপে বেতন বেড়েছে। বর্তমানে সিভিক ভলান্টিয়ারদের বেতন মাসে ১০ হাজার টাকা।

২০১৭ সালে অর্ডারে কিছু পরিবর্তন করা হয়। তখন ৫০০০ মাসিক বেতন দেওয়া শুরু হয়। সেটা এখন বেড়ে হয়েছে ১০,০০০ টাকা। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, পুলিশ সুপারের দফতর ও কমিশনারেটগুলি থেকে সিভিকদের অ্যাকাউন্টে টাকা যায়। স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে বরাদ্দ করা থাকে তাঁদের টাকা। অর্থবর্ষের শুরুতেই সেই টাকা বরাদ্দ করা হয় বলে জানা গিয়েছে।

কোন আইনে সিভিক নিয়োগ?

বাম জমানায় কিছু গ্রিন পুলিশ ছিল। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০১১ সালে ‘অর্ডার’ বের করে প্রাথমিকভাবে হাওড়া এবং আসানসোল পুলিশ কমিশনারেটের জন্য ২০০০ সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করা হয়। সেটাই ছিল শুরু। পদস্থ আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, সাংবিধানিকভাবে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রয়েছে রাজ্যের হাতে। রাজ্য সরকার ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অর্ডার’ বের করে এই সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ শুরু করেছে।

আর কী কী সুযোগ-সুবিধা পান সিভিক ভলান্টিয়াররা?

পিএফ (EPFO), ইএসআই (ESI)-এর সুযোগ না থাকলেও রয়েছে মেডিক্লেম। বছরে তার প্রিমিয়াম সাড়ে ৪ হাজার টাকা। এই টাকা বেতন থেকেই কাটা হয়। এছাড়াও ৬ মাস অন্তর ৩ দিন করে কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়। বছরে ১৪টি ক্যাজুয়াল লিভ পাওয়া যায়। প্রতি বছর পুজোয় বোনাস দেওয়া হয় সিভিকদের। ২০২৪ সালে দুর্গা পুজোয় ৬০০০ টাকা করে বোনাস পেয়েছেন তাঁরা।

কী কী কাজ করানো হয় সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে?

ছোটখাটো আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে নামানো হয় সিভিককে। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রেও হাত লাগাতে দেখা যায় তাদের। এমনকী কখনও কখনও গোয়েন্দাগিরিতেও। কোথাও পুলিশের গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করেন তাঁরা। পুলিশের শীর্ষকর্তাদের অনেকেই স্বীকার করেছেন যে, বর্তমানে এ রাজ্যের পুলিশি ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ সিভিক বাহিনী।

পুলিশ বিভাগে রয়েছে ব্যাপক শূন্যপদ, যা পূরণ হচ্ছে না। সেই জায়গায় সিভিক নিয়োগ করে সামাল দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন পুলিশকর্মীদের একাংশ। থানা প্রতি গড়ে প্রায় ৩৫০ জন সিভিকের বাহিনী রয়েছে। ফবে বাস্তবে তারাই যে থানার মূল ‘ম্যানপাওয়ার’, তা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে গ্রামের দিকে এই সিভিকদের ভরসাতেই থানা চলে। শহরাঞ্চলেও অবশ্য সিভিকের উপস্থিতি বর্তমানে চোখে পড়ার মতো।

এক্তিয়ার কতটা? সিভিকের ‘কাজ’ বেঁধে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট

দিনের পর দিন যখন সিভিক নিয়ে অভিযোগ উঠতে শুরু করে, তখন হাইকোর্টও এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ২০২৩ সালে সরশুনার একটি মামলা শুনতে গিয়ে সিভিকের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল হাইকোর্ট। রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সিভিক ভলান্টিয়ারদের কী ভূমিকা? কোন কোন কাজে সিভিক ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার করা হয়? তা রাজ্যের কাছে জানতে চেয়েছিল আদালত। পরবর্তী শুনানিতে কার্যত কাজের সীমা বেঁধে দেয় হাইকোর্ট। নির্দেশ দেওয়া হয়, পুলিশকর্মীরা যখন কোনও কর্তব্য পালন করবেন, তখন শুধুমাত্র তাঁদের সাহায্য করতে পারবেন সিভিক ভলান্টিয়াররা ৷

গত সেপ্টেম্বর মাসেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কলকাতা হাইকোর্ট। প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হীরন্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছিল, ‘ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা যেতে পারে, নিয়মিতভাবে নয়।’ পুরসভা থেকে রাজ্যের সব সরকারি দফতরে কেন নিয়োগ হচ্ছে চুক্তি ভিত্তিতে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ডিভিশন বেঞ্চ বলেছিল, ‘দেশের আর কোথাও এমনটা হয় না।’

সিভিক পদে চাকরি পেতে কী যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন?

২০১১ সালে যে অর্ডার বেরোয়, সেখানে যোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। স্কুল বা ক্লাব স্তরে খেলার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। থানায় কোনও পূর্ব অপরাধের রেকর্ড থাকবে না। শারীরিকভাবে ‘ফিট’ বলে বিবেচিত হতে হবে। পুলিশ লাইনে ১০ দিনের ট্রেনিং কোর্স করতে হয় এই পদে নিয়োগের জন্য।

সিভিক ভলান্টিযার নিয়োগ করার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট জেলার সুপার বা কমিশনারের হাতে দেওয়া হয়েছিল অর্ডারে। যে কমিটির কথা বলা হয়েছিল, সেটিতে একজন ডিসি পদমর্যাদার অফিসার, একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার , একজন ইনস্পেক্টর, দু জন সাব- ইনস্পেক্টরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

নিয়োগ নিয়েই রয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ

রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী, যোগ্যতার মাপকাঠি বিচার করেই সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করা হয়। সাধারণত এই নিয়োগের ক্ষেত্রে, চাকরি প্রার্থী যে থানা এলাকার বাসিন্দা, সেখানে বা তার আশপাশের থানা এলাকায় নিয়োগ করা হত তাঁকে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উঠেছে একাধিক অভিযোগ।

অভিযোগ ১: শাসকদলের কর্মীদের সিভিক পদে নিয়োগ করা হচ্ছে। অভিযোগ ২: অনেক নীচু তলার পুলিশ আধিকারিক তাঁদের পছন্দমতো লোক নিয়োগ করছে সিভিক পদে। অভিযোগ ৩: এই সিভিক পদে নিয়োগ করা হবে বলে বিনিময়ে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে।

একই প্রশ্ন উঠল সুপ্রিম কোর্টে?

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলায় মূল অভিযুক্ত একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। সেই মামলা শুনতে গিয়ে সিভিক ভলান্টিয়ারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়।

রাজ্যকে সিভিকের বিষয়ে ৬টি প্রশ্ন করেছেন তিনি:

প্রশ্ন ১: কোন আইনের ক্ষমতাবলে সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে?

প্রশ্ন ২: কী পদ্ধতিতে সিভিক নিয়োগ করা হচ্ছে?

প্রশ্ন ৩: সিভিকদের যোগ্যতার মাপকাঠি কী?

প্রশ্ন ৪: সিভিকদের নিয়োগের আগে তাঁদের অপরাধের রেকর্ড রয়েছে কি না, তা কীভাবে যাচাই করা হয়?

প্রশ্ন ৫: কোন কোন প্রতিষ্ঠানে সিভিক নিয়োগ করা হচ্ছে?

প্রশ্ন ৬: সিভিকদের জন্য কীভাবে বেতন দেওয়া হচ্ছে? এর জন্য কত অর্থ বরাদ্দ করা হয়?

কোথাও হুমকি, কোথাও শ্লীলতাহানির মতো অভিযোগ উঠেছে সিভিকদের বিরুদ্ধে। আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে হওয়া রাত দখল কর্মসূচির মাঝে এসে পড়েছিলেন এক মদ্যপ সিভিক ভলান্টিয়ার। মালদহে একটি ধর্ষণের ঘটনায় নির্যাতিতাকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগই হোক বা স্বরূপনগরে বাংলাদেশের মহিলাকে শ্লীলতাহানি, সিভিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনও অন্ত নেই। এবার সিভিক প্রসঙ্গে শীর্ষ আদালতে জবাব দিতে হবে রাজ্যকে। কী হবে উত্তর, কী থাকবে যুক্তি, সিভিক নিয়ে কি বড় কোনও নির্দেশ দেবে শীর্ষ আদালত? প্রশ্ন থাকছে।