Ganesh Writes Mahabharata: মহাভারত লিখতে কেন গণেশকেই বেছে নিয়েছিলেন ব্যাসদেব?

Ganesh Writes Mahabharata: ব্রহ্মার নির্দেশে গণেশকে ডেকে ব্যাস বলেন 'লেখকো ভারতসাস্য ভব ত্বং গণ-নায়ক' অর্থাৎ 'তুমি গণনায়ক, তাই সমগ্র ভারতের গণহৃদয় তোমাকেই লিখে দিতে হবে'।

Ganesh Writes Mahabharata: মহাভারত লিখতে কেন গণেশকেই বেছে নিয়েছিলেন ব্যাসদেব?
Follow Us:
| Updated on: Sep 09, 2024 | 12:53 PM

‘একদন্তায় বক্রতুণ্ডায় গৌরীতনয় ধীমহি/ গজেশনায় ভালচন্দ্রায় শ্রীগণেশায় ধীমহি/ গুরুজীতায় গুরুদৈবতায় গুরুকুল গুরুকুলস্থায়ীনে/ গুরুবিক্রমায় গুহীপ্রভারায় গুরুভে গুণগুরুভে’

একদাঁত বিশিষ্ট, বক্র শুঁড়ের অধিকারী, গৌরীপুত্র তিনি। তাঁর কপালে চন্দ্রের অধিষ্ঠান, তিনিই গুরুর গুরু, সংসারের গুরুদের পূজনীয় তিনি। তিনি হলেন আমাদের সবার পূজনীয় শ্রী গণেশ। তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধির ঝলকে বার বার আলোকিত হয়েছে ত্রিভূবন। আবার তিনি বিঘ্নহর্তাও বটে। অর্থাৎ কারও জীবনের পথে কোনও কাজে বাধা আসলে তাও দূর করেন তিনিই। সংসারে যখন বারবার বিপদের কালো ছায়া ঘনিয়ে এসেছে, যখন সেই বিপদ কাটাতে ব্যর্থ হয়েছেন ত্রিদেব তখন নিজের বুদ্ধির জোরে পুনরায় ধর্ম স্থাপন করেছেন গণেশ।

এ হেন গণেশেরই জন্মদিন আজ। ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের চতুর্থী তিথিতে জন্ম তাঁর, তাই এদিনটি গণেশ চতুর্থী নামে পরিচিত বিশ্ব সংসারে। শিবপুরাণ মতে, একবার পার্বতী স্নানে যাওয়ার সময় শিব ভক্ত নন্দীকে দ্বার রক্ষক রূপে রেখে স্নানে গিয়েছিলেন। কিন্তু শিব এসে তাঁকে ভৎর্সনা করে ভিতরে চলে যান। এতে অপমানিত বোধ করেন পার্বতী। পরের দিন জল থেকে পাঁক তুলে সুন্দর বালক মূর্তি নির্মাণ করেন। তারপর সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এভাবেই জন্ম হয় গৌরী পুত্রের।

কিন্তু এরপরেই মহাদেব এসে প্রবেশের চেষ্টা করলে বালক গণেশ পথ রুখে দাঁড়ান। মহাদেবের পথ রোখায় ছুটে আসেন দেব-দেবীগণ থেকে ভগবান বিষ্ণুও। কিন্তু সকলেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষে মহাদেব ক্রোধ সামলাতে না পেরে ত্রিশূলের আঘাতে শিরচ্ছেদ করে দেন গণেশের। সন্তানের এই অবস্থা দেখে ক্রোধে জ্বলে ওঠেন মাতা পার্বতী। বিশ্ব সংসার ধ্বংস করতে উদ্যত হয়ে ওঠেন তিনি। শেষে স্ত্রীকে শান্ত করতে শিবগণ কে উত্তর দিকে মুখ করে শুয়ে থাকা প্রাণীর মাথা কেটে আনতে বলেন শিব। তখন শিবগণ হাতির মাথা কেটে আনেন। এই ভাবেই গণেশ হয়ে ওঠেন গজমুখী।

আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে গণেশের জন্মের পরে সব দেব-দেবীর সঙ্গে শনিদেবকেও আমন্ত্রণ জানান পার্বতী। কিন্তু শনিদেব গণেশের দিকে তাকাতেই ভস্ম হয়ে যায় গণেশের মাথা। তারপর হাতির মাথা এনে পুনরায় প্রাণ দান করা হয় গণেশকে।

আরম্ভের দেবতা তিনি। এ জগত সংসারের যে কোনও শুভ কাজ শুরু করা হয় গণেশকে দিয়েই। এমনকি পুজোর বেলাতেও তাই। তাই পুজোর ক্ষেত্রেও সবার আগে পুজিত হন গজানন। আবার তিনিই জ্ঞান, শ্রেষ্ঠত্ব, বিদ্যার আধার। তাঁর বুদ্ধিমত্তা নিয়েও প্রচলিত রয়েছে নানা কাহিনীও। যেমন একবার কার্তিক আর গণেশের মধ্যে শুরু হয় তুমুল বাক যুদ্ধ। হর-পার্বতীর দুই পুত্রের মধ্যে কে বড় তাই নিয়ে ঝগড়া। শেষে দুই ভাইয়ের ঝগড়া সামলাতে এগিয়ে আসেন নারদ মুনি। ঠিক হয় দুজনের মধ্যে যে প্রথম ত্রিলোকের তিন বার পাক খেয়ে এসে শংকর এবং শংকরীকে প্রণাম করবেন তিনিই হবেন বড়। সেই মতো পিতা-মাতা কে প্রণাম করে বাহন ময়ূরের পিঠে চেপে ত্রিলোকের পাক দিতে বেড়িয়ে পরেন দেবসেনাপতি। আর গণেশ কেবল তাঁর মাতা-পিতাকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে প্রণাম জানান। কেন তিনি ত্রিভূবন প্রদক্ষিণ করতে গেলেন না? প্রশ্ন করা হলে উত্তরে গণেশ বলেন তাঁর পিতা-মাতা হর-পার্বতীই এই বিশ্বসংসার। তাই তাঁদের প্রদক্ষিণ করা মানেই ত্রিভূবনের দর্শন করা। তাঁর অকাট্য যুক্তি শুনে হার মেনেছিলেন খোদ দেবতারও। জয়ী হয়েছিলেন গণেশ।

গণেশের এই পাণ্ডিত্যের আরও বড় প্রমাণ হল মহাভারত রচনার সময় তাঁর প্রয়োজনীয়তা। এই সমন্ধে পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি তাঁর ‘মহাভারতের ছয় প্রবীণ’ বইটিতে লিখেছেন ‘মহাভারত শুধু আর্যতন্ত্র বা ব্রাহ্মণ্যের ইতিহাস নয়, মহাভারত সমগ্র ভারতবর্যের জনজাতির ইতিহাস, সমগ্র ভারতবর্ষের সমাজনীতি, ধর্মনীতি, রাজনীতি আলোড়িত এবং আবর্তিত হয়েছে বিশালবুদ্ধি ব্যাসের কবিহৃদয় জুড়ে। কাজেই সেই বিশালত্ব ধারণ করে প্রকাশ করার জন্য এমন একজনের লেখনী প্রয়োজন, যিনি শুধুমাত্র বেদ এবং ব্রাহ্মণ্যের প্রতীক নন; যিনি সমস্ত মানুষের হৃদয় বোঝেন, যিনি গণতত্ত্ব বোঝেন সেই গণপতি গণেশ’।

যদিও গণেশকে মহাভারতের লেখক হিসাবে বেছে নেওয়ার নেপথ্যেও একটি কাহিনী রয়েছে। বলা হয় মহাভারতের রচনা করেছিলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। আগে থেকে নিজের মনের অন্দরে মহাভারতের কাহিনী বৃত্তান্ত,তাঁর পর্যায়ক্রম, তাঁর বিষয়বস্তু সব ঠিক করে ফেলেছিলেন ব্যাসদেব। কিন্তু সেই মহাকাব্য রচনার আগে সমস্যার মুখোমুখি হন ব্যাস। তিনি ব্রহ্মদেবকে মহাকাব্যের সৃষ্টির পরিকল্পনা জানান, সঙ্গে তাঁর মনের ভিতরের ভাবনার এক খসড়া করে তাঁকে দেন। এর পরেই তিনি জানান বেদ উপনিষদের তত্ত্ব থেকে লোকশিক্ষা, ন্যায়শিক্ষা, চিকিৎসা, ইতিহাস, ভূগোল, অ্যানথ্রপোলজি, যুদ্ধকৌশল এবং বিরাট কালচক্রের রহস্য এই সব সবিস্তারে নিজের মহাকাব্যে উদ্ধৃত করতে চান তিনি। তবে তিনি নিজেই মস্তিষ্কের প্রয়োগ করে তা রচনা করলেও, এত শ্লোক নিজের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। তাই তাঁর একজন উপযুক্ত পাত্র চাই যিনি তাঁর শ্লোক শুনে লিখে দেবেন। এই গ্রন্থ মহান এবং ভারীও বটে। তখন ব্রহ্মা দেব পরিস্থিতির গাম্ভীর্য বুঝে গণেশকে দিয়ে লেখানোর প্রস্তাব দেন ব্যাসদেবকে।

আসলে গণেশ বিরাটত্ব, গাম্ভীর্য, বিজ্ঞতার প্রতীক। যা পরবর্তীকালে মহাভারতের মধ্যেও দেখা যায়। তাঁর বিশাল হাতির মতো মাথাও সেই বিশালত্ব জ্ঞানেরই প্রতীক। আবার নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি তাঁর ‘মহাভারতের ছয় প্রবীণ’ বইতে লিখেছেন পুরাণে উল্লেখ আছে গণেশর জন্মলগ্নেই দেবী সরস্বতী তাঁকে ‘বর্ণলোচনা’ লেখনী দিয়েছিলেন একখানি, আর স্বয়ং ব্রহ্মা তাঁকে দিয়েছিলেন জপমালা। জপমালার মধ্যে যে ধ্যানগম্ভীরতা আছে, আর লেখনীর মধ্যে যে দ্রুত লেখার ক্ষমতা আছে এই দুটিই ব্যাসের প্রয়োজন ছিল মহাভারতের রচনার জন্য। তাই ব্রহ্মার নির্দেশে গণেশকে ডেকে ব্যাস বলেন ‘লেখকো ভারতসাস্য ভব ত্বং গণ-নায়ক’ অর্থাৎ ‘তুমি গণনায়ক, তাই সমগ্র ভারতের গণহৃদয় তোমাকেই লিখে দিতে হবে’।

ব্যাসদেবের কথা শুনে রাজি হলেও মহাভারত রচনার জন্য একটি শর্ত দেন গণেশ। তিনি বলেন তিনি ব্যাসদেবের বর্ণনা শুনে লিখে তো দেবেন কিন্তু তিনি ঝড়ের গতিতে লিখবেন এবং একবার লেখা শুরু করলে আর থামা যাবে না। আর যদি একবারও তাঁর কলম থামে তিনি আর লিখবেন না। ব্যাসদেব দেখলেন এতো মহা মুশকিল। এত বড় একটি মহাকাব্য তাঁর এত ঘটনাবলী, এত গল্প, তাঁর পিছনে এত রকমের আবেগ, রাজনীতি, কূটনীতি, নীতিশিক্ষা,ধর্মজ্ঞান আরও কত কিছু! এই সব কিছু না ভেবে অনর্গল বলা যায় নাকি!

তাই তিনিও বুদ্ধি খাটিয়ে একটি উপায় বার করলেন। গণেশের শর্তে রাজি হয়ে তিনি বললেন ‘অবুদ্ধা মা লিখ ক্কচিৎ’ অর্থাৎ তিনি রাজি কিন্তু গণেশও না বুঝে কোনও শ্লোক লিখতে পারবেন না। এই শুনে রাজি হয়ে গেলেন গণেশও। এই বার শুরু হল মহাকাব্যের রচনা। বিশাল ১৮ পর্বের চিত্রায়ণ। একের পর এক শ্লোক বলে চলেছেন ব্যাসদেব আর তা ঝড়ের গতিতে লিখে চলেছেন গণপতি।

আর এরই মাঝে যখন কোনও বিষয় নিয়ে বা শ্লোক রচনার ক্ষেত্রে ব্যাসদেবের একটু চিন্তা করার প্রয়োজন বা বিশ্রামের দরকার হত তখন এমন এক কঠিন শ্লোক তিনি গণেশকে বলতেন যা বুঝতে গিয়ে বেগ পেত হত স্বয়ং গজাননকেও। এদিকে না বুঝে লেখা যাবে না কোনও শ্লোকই। তাই যতক্ষণ গণেশ সেই শ্লোক বুঝতে সময় নিতেন সেই ফাঁকে ব্যাসদেব একটু জিরিয়ে নিতেন।

এখানে একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। আগেই বলেছি গণেশ ‘একদন্তায়’ নামেও পরিচিত। তার কারণ গণেশের একটি দাঁত ভাঙা। প্রচলিত এই মহাভারত রচনার সময়ে নাকি লিখতে লিখতে কলম ভেঙে যায় গণেশের তখন নিজের একটি দাঁত ভেঙে তা কালিতে ডুবিয়ে পুনরায় লিখতে শুরু করেন গণেশ। যদিও এই কাহিনি সত্য নয় বলেই দাবি পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির। তিনি জানান কার্তবীর্যাজুনের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে ভগবান পরশুরাম যখন তাঁর আরাধ্য মহাদেবের দর্শনের জন্য যান, তখন তিনি গৌরীর সঙ্গে একান্তে ছিলেন। তাই পরশুরামকে ভিতরে যেতে বাধা দেন তাঁদের পুত্র বালক গণেশ। সেই সময়ে পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধে নিজের বাম দাঁত খোয়াতে হয়েছিল গণেশকে। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির কথায়, “আমরা বলি কলম ভাঙে মূর্খের। কারণে সে লিখতে জানে না। গণেশ ছিলেন মহাজ্ঞানী, তাঁর হাতির মতো মাথাও সেই বিরাটত্বের প্রতীক। তাই গণেশের কলম কখনও ভাঙতে পারে না।”

সুতরাং গণেশ যে জ্ঞান এবং অপার বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন তা এই সব ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। বিশেষ করে বিশ্ব সংসারে এত পরাক্রমী দেব-দেবী, গুণী,পণ্ডিত, ঋষি মুনি থাকতেও ভারত তথা আর্যাবর্তের ইতিহাসের দুই সবচেয়ে প্রাচীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের মধ্যে মহাভারত রচনার ক্ষেত্রে গণেশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মাও। যা পুনরায় তাঁর উপর সরস্বতী দেবীর কৃপার প্রমাণ দেয়।

কতদিন ধরে মহাভারতের লেখনী সম্পন্ন করেছিলেন গণেশ?

এ বিষয়ে পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি মহাভারত বলা হয়েছে। প্রথমেই তা লেখা হয়নি। আর কবে লেখা হয়েছে তা কেউ বলতে পারেন না। তবে পণ্ডিতরা অনেকে মনে করেন খ্রীস্ট পূর্বাব্দ ৩০০-৪০০ বছর আগে লেখা শুরু হয়েছিল মহাভারত। এবং মহাভারত লেখা চলেছিল খ্রীস্টের জন্মের ১০০-২০০ বছর পর অবধি। অর্থাৎ মহাভারত সম্পূর্ণ লিখতে সময় লেগেছিল প্রায় ৪০০ বছর। আবার আরেকটি মতে মহাভারতের শ্লোক সংখ্যা বাস্তবে অনেক কম ছিল। পরবর্তী কালে তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।”

কোথায় রচনা করা হয়েছিল মহাভারতের?

কোথায় বসে গণেশ মহাভারত লিখেছিলেন তা নিয়েও বেশ কিছু গল্প প্রচলিত রয়েছে। অনেকে মনে করেন বদ্রিনাথ থেকে কয়েক কিলোমিটার ট্রেক করে গেলে পৌঁছোনো যায় মানা গ্রামে। সেখানেই হিমালয়ের কোলে কোনও এক গুহায় বসে ব্যাসদেব মহাভারত রচনা করেছিলেন এবং তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন গণেশ। তবে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি অবশ্য বলেন, “বদরিকাশ্রমে বসে তপস্যা করতেন ব্যাস দেব। কিন্তু এখানেই বসেই মহাভারত রচনা করা হয়েছিল এমন কোনও উল্লেখ নেই।”