Byzantine Food Recipe Part II: খানা খানদানি-পর্ব ০৮, পারশে তো বটেই, কাচকি, বাটা, ভাঙন সবই পড়ত বাইজ়ান্টাইন পাতে!

TV9 Bangla Digital

TV9 Bangla Digital | Edited By: Sohini chakrabarty

Updated on: Oct 24, 2021 | 9:00 AM

ভালো কথা, ওয়াইন ভিনিগার কিন্তু ওয়াইন নয়। ওয়াইন গাঁজিয়ে, ছেঁকে এই ভিনিগার তৈয়ার হয়। খুব সহজেই অনলাইনে কেনা যায়। হাতের কাছে না থাকলে, সহজলভ্য সাদা ভিনিগার দিন। তাও না থাকলে পাতি লেবুর রসও দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে গন্ধ বদলে যাবে।

Byzantine Food Recipe Part II: খানা খানদানি-পর্ব ০৮, পারশে তো বটেই, কাচকি, বাটা, ভাঙন সবই পড়ত বাইজ়ান্টাইন পাতে!

নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ৮

গত কাল আমরা এক বাজ়ান্টাইন মঠে ডাকসাইটে সন্ন্যাসীদের যে খানার বহর দেখেছিলাম, মন দিয়ে সেগুলি খোঁজ করলে তাতেই মিলে যাবে এমন অন্তত একটি মাছ যা আমাদের এই কলকেতার বাজারেও দিব্যি মেলে। আর যা আমার অতি মধ্যবিত্ত হেঁশেলেও দিব্যি রেঁধে ফেলা সম্ভব।

এক্ষণে আরেকবার মূল রেসিপিটায় চোখ বোলানো দরকার—

‘‘প্রথমেই এল বেক করা খানা, খুদে খুদে রসা-রসা পিসি মাছের ছানা। দুই নম্বর, হেক মাছ তাকে বলে, ডোবা গাঢ় ঝোলে। তিন নম্বরে এল টক-মিঠে খানা—জাফরানি, জটামাংসী, তগর, লবঙ্গ-দানা আর দারুচিনি, ছোট-ছোট ছাতু দেওয়া সাথে তার ভিনিগার আর ধোঁয়া-না-দেওয়া মধু এন্তার, মাঝখানে তার সোনালী গার্নার্ড এবং পারশে, তিন বিঘত-টাক চওড়া সে, ডিম ভরা, রাইজিন বন্দরে ধরা, আর ডেনটেক্স, কী যে সুন্দর, বড়সড়—তুলে নিয়ে আহা বাটি থেকে, চিবিয়ে-চিবিয়ে দাও খেয়ে নিতে, শুরুটা করতে দাও হে তারিয়ে, তারিয়ে-তারিয়ে, চারটি পেয়ালা চিয়ান মদিরা পান করে নিয়ে, অঢেল সে রসে, মন যেন থাকে ভরা সন্তোষে! চতুর্থ পদে এল গ্রিল করা, পঞ্চম খানা এল ভাজা-ভাজা: মাঝখান থেকে কাটা চাকা-চাকা; রেড মুলেট-ও তো (গোঁফ সহকারে) এল খান কয় বাটি ভরে-ভরে; গভীর থালায় দ্বিগুণ মাপের স্মেল্ট হাজির হয়; আর একখানা এল ফ্লাউন্ডার, খুব ভাল মতো গ্রিল তা করানো, ফিশ সস্ দিয়ে গভীরে ভেজান, মাথা থেকে লেজা শা-জিরে ছড়ান; এল শেষমেশ বড় একখান ভেটকির স্টেক, আহা বেশ বেশ, আহা বেশ বেশ।’’

—গরিব প্রোদ্রোমোস, কবিতা ৩

আগে দেখে নিই তবে কী-কী মাছ পড়ছে সেই ফাইলোথেউয়ের ডাকসাইটে সন্ন্যাসীদের পাতে—

১। ‘পিসি মাছ’। না, মাসি-পিসির পিসি নয়। ‘pisi’—বলছে ‘টেস্ট্স অফ বাইজ়ান্টিয়ুম’ কেতাবে দেওয়া অ্যান্ড্রু ড্যালবির তরজমা। তিনি জানাচ্ছেন এটি আসলে ‘টারবট’ পরিবারের যে-কোনও মাছ হতে পারে। ব্রিল মাছও বলে। ভূমধ্যসাগরে খুব মেলে।

২। হেক। কড, হ্যাডক ইত্যাদি মাছ। ছোটবেলায় আমরা কড-লিভার অয়েল খুব শুনতাম। আর আমাদের খিচুড়ি যখন কালাপানি পার করে ‘কেজরি’ (kedgeree) নাম নিয়ে খাস বাকিংহ্যাম প্রসাদে মহারানির পাতে পড়ল, হ্যাডক মাছ তার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গেল। সে কেজরি-কাহিনিও আমরা এই সিরিজেই শুনব। তবে আজ নয়।

৩। গার্নার্ড। বিচিত্র-দর্শন—পাখনা যেন ডানা। ব্রিটিশ আর অস্ট্রেলিয়ানদের ভারি প্রিয় মাছ।

৪। চার নম্বরটি আমাদের সাধের পারশে। গ্রিক ভাষায় কী বলে জানি না। তবে অ্যান্ড্রু ড্যালবি এবং অধ্যাপক আলেক্সিউ দু’জনেই তরজমা করেছেন ‘grey mullet’। খোঁজ করতে গিয়ে তো আমি থ—বাংলাদেশের একটা দুরন্ত সাইট আছে। সে-দেশে-মেলে এমন হরেক মাছের ঠিকুজি-কুষ্ঠি দেওয়া। তাতে দেখি মুলেট বহু কিসিমের হতে পারে—কাচকি, বাটা, পারশে, ভাঙন। এর মধ্যে ভাঙন আমার বিশেষ, বিশেষ প্রিয়—কী মিষ্টি মাছ! কিন্তু হাতের কাছে পেলাম পারশে। আমি খুব বড় ধ্যাবড়া-ধ্যাবড়া পারশের থেকে একটু ছোটই পছন্দ করি বেশি। তাই নেওয়া হল। অনায়াসে বদলে নিতে পারেন। তিন বিঘত যেহেতু—আমার ধারণা ভাঙনের দিকেই সমঝদার কবির ইশারা।

৫। ডেন্টেক্স। বিপুলাকার মাছ। তিন ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ভূমধ্যসাগর, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রে, ভারত মহাসাগর, অতলান্তিক মহাসাগর সর্বত্রই এনতার পাওয়া যায়।

৬। স্মেল্ট—অতলান্তিক ও উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের মাছ মূলত। বাংলাদেশেও নাকি মেলে এক কিসিম—তুলার ডান্ডি! বা হুন্দ্রা। পশ্চিমবঙ্গে নাকি বলে তুল মাছ। আমি তো জিন্দেগিতে নামই শুনিনি।

৭। ফ্লাউন্ডার। বিচিত্র এ মাছ। সমুদ্রের বা মোহনার তলায় থাকে। এক্কেবারে মাছেদের মধ্যে বহুরূপী। শত্রু এড়াতে হুবহু আশেপাশের রঙ নিয়ে নিতে পারে। বঙ্গোপসাগরেও আছেন ইনি। নাম সরবতি।

৮। ভেটকি। ইংরেজি তরজমায় যাকে দুনিয়ার লোক চেনে ‘সি বাস্’ বা ‘বারামুন্ডি’ নামে।

এর মধ্যে সব থেকে বিশদ রেসিপি দেওয়া আছে পারশে বাবাজির। আধুনিক কুকবুকের মানানসই করে লিখলে ব্যাপারটা এ রকম দাঁড়াবে—

বাইজ়ান্টাইন সুইট অ্যান্ড সাওয়ার পারশে

উপকরণ

পারশে—মাঝারি ৪টি বাটন মাশরুম—২৫০ গ্রাম লবঙ্গ—১২টা দারুচিনি—২ গ্রাম মধু—৪ টেবিল চামচ ওয়াইন ভিনিগার—৬ থেকে ৮ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল—৬ টেবিল চামচ নুন-গোলমরিচ—স্বাদ মতো জ়াফরান—১ গ্রাম দুধ—৬ টেবিল চামচ কর্ন ফ্লাওয়ার—২ টেবিল চামচ বা প্রয়োজন মতো

চাইলে

জটামাংসী—এক ইঞ্চি টুকরো তগর—এক চিমটে

প্রকরণ

প্রথমে অল্প একটু দুধ গরম করে আঁচ থেকে নামিয়ে তাতে জ়াফরান গুলে ঢাকা দিয়ে রেখে দিন। চার চামচ অলিভ অয়েলে নুন-মাখান-মাছ হাল্কা করে ভেজে নিন। সরিয়ে রাখুন। কড়াইতে দু’ চামচ অলিভ অয়েল দিয়ে দারুচিনি লবঙ্গ আর গোটা গোল মরিচ ভেজে নিন, লবঙ্গ ফুট-ফুট করে ফাটা পর্যন্ত। যাকে ‘ক্র্যাকল’ বলে। সেই তেলেই টুকরো-করা ছাতু (কলকেতার লোকেরা যাকে বলবেন বাটন মাশরুম) ভেজে নিন ভাল করে জল বেরনো পর্যন্ত। জল বেরলেই মধু দিন, ভাজতে থাকুন। জল মরে এলে নুন ভিনিগার দিয়ে একটু নেড়ে বড় দেড় বাটি জল দিন। ঢাকা দিয়ে মাশরুম সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত ফুটতে দিন। এরপর প্রয়োজন মতো কর্ন ফ্লাওয়ার এক কাপ জলে গুলে কড়াইতে দিন। আচ্ছা করে নাড়ুন। টেস্ট করে দেখুন, প্রয়োজন মতো মধু, ভিনিগার, গুঁড়ো গোলমরিচ দিয়ে স্বাদ নিজের পছন্দ মতো করে নিন (খেয়াল রাখবেন মাছে নুন দেওয়া আছে)। আঁচ থেকে নামান। একটা পরিষ্কার সাদা কাপড় দিয়ে পুরো ঝোলটা ছেঁকে নিন। কাপড় থেকে ছাতুর টুকরোগুলি সাবধানে আলাদা করে তুলে ছাঁকা ঝোলে দিন। কড়াই ফের আঁচে চাপিয়ে ছাঁকা ঝোল ও ছাতু দিয়ে, তাতে ভাজা মাছগুলি ছেড়ে, মিনিট পাঁচেক ঢাকা দিয়ে ফুটতে দিন। দুধে গোলা জ়াফরান ছড়িয়ে ভাল করে নাড়ুন, সাবধানে যাতে মাছ ভেঙে না যায়। ভাল চালের সাদা ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।

ভালো কথা, ওয়াইন ভিনিগার কিন্তু ওয়াইন নয়। ওয়াইন গাঁজিয়ে, ছেঁকে এই ভিনিগার তৈয়ার হয়। খুব সহজেই অনলাইনে কেনা যায়। হাতের কাছে না থাকলে, সহজলভ্য সাদা ভিনিগার দিন। তাও না থাকলে পাতি লেবুর রসও দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে গন্ধ বদলে যাবে। বাইজ়ান্টাইন না থেকে ব্যাপারটা অনেকটা লেবু পাতা কিংবা লেমন গ্রাস দেওয়া চাইনিজ় সুইট অ্যান্ড সাওয়ার হয়ে যাবে। জ়াফরানও হাতের কাছে না থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই পর্বটা স্রেফ বাদ দিয়ে দিন।

সে কী? তাহলে ওই অদ্ভুত নামের দুই বস্তু—জটামাংসী ও তগর? সে-ও কম বিচিত্র নয়। সেটা বুঝতে গেলে খান দুয়েক বাদশাহি হেঁশেলের পাকপ্রণালীর অনবদ্য কেতাবের পাতা ওল্টাতে হবে। এক, Annals of the Caliph’s Kitchen। বাগদাদের ডাকসাইটে খলিফ হারুন অল-রশিদের বংশের হেঁশেলের কুকবুক ‘কিতাব অল-তবিখ’-এর তরজমা। দশম শতক নাগাদ লেখা। এটি তরজমা করেছেন অধ্যাপক নাওয়াল নাসরাল্লা। তিনি এর মুখবন্ধে লিখছেন, ‘জানা যায় হারুন অল-রশিদ ও তাঁর বংশধরেরা খাওয়া-দাওয়া সারতেন বিখ্যাত চিকিৎসক ইউহানা বিন মাসোয়ি-র শ্যেন দৃষ্টির সামনে।’ আবার ১৩৩০ সালের একটা দুরন্ত চিনা কুকবুক আছে —‘ইনশান ঝেঙ্গিয়াও’—ইংরেজি তরজমায় Proper and Essential Things for the Emperor’s Food and Drinks। কোন এমপারর? কুবলাই কান-এর বংশধরদের। এই পাকোয়ান প্রক্রিয়া প্রণালীর লেখক বিখ্যাত চিনা বৈদ্য হু সিহুই। এই সিরিজে দু’টি কেতাবেরই আশ্চর্য সব রেসিপি আর কিস্সা কাহিনি থাকবে। তাই বিশদে কিছু এখানে লিখছি না। শুধু এইটুকুই যে খানদানি খানার ওপর চিকিৎসকদের কড়া নিয়ন্ত্রণ মধ্য যুগে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এবং বাইজ়ান্টাইন রেসিপিতে জটামাংসী ও তগরের উল্লেখ তাই চমকে দেওয়ার মতো হলেও অস্বাভাবিক নয়। ড্যালবির তরজমায় প্রথমটি ‘spikenard’, দ্বিতীয়টি ‘valerian’। ভারতের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের ‘জটামাংসী’ ও ‘তগর’। মার্কিন সরকারের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ’-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র জানাচ্ছে, জটামাংসী আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত হয় মৃগি, মানসিক রোগ সারানো, রক্ত পরিষ্কার করা (যাকে বলে ‘অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট’) ইত্যাদি নানা প্রয়োজনে। ওই একই সাইটে আরেক প্রবন্ধ জানাচ্ছে ‘তগর’ ব্যবহৃত হয় ঘুমের ওষুধ হিসেবে।

দু’টি ওষুধই ভারতে খোলা বাজারে আয়ুর্বেদের দোকানে পাওয়া যায়। তবে কোনও ওষুধই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা কখনওই উচিত নয়। আমি সামান্য পরিমাণে করেছিলাম, আর সম্পূর্ণ ভিন্‌দেশী স্বাদের সেই পারশের ঝোল আর ভাত এক রোববার দুপুরে জমিয়ে খেয়ে যে জম্পেশ একপ্রস্থ ঘুম মেরেছিলাম, তা পষ্ট মনে আছে!

আরও পড়ুন- Byzantine Food Recipe Part I: খানা খানদানি-পর্ব ০৭, বাইজ়ান্টাইন সাম্রাজ্যের বিখ্যাত মঠে ডাকসাইটে সন্ন্যাসীরা তারিয়ে খেতেন পারশে মাছের সুইট অ্যান্ড সাওয়ার?

খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার

গ্রাফিক্স ও অলংকরণ- অভীক দেবনাথ

Latest News Updates

Follow us on

Related Stories

Most Read Stories

Click on your DTH Provider to Add TV9 Bangla