Psychology of the Bully: ধর্ষণের আগে ও পরে কী চলে ধর্ষকের মনে? কী বলছেন মনস্তাত্ত্বিকরা

Psychology: যখন এক পুরুষ তাঁর শক্তি প্রদর্শন করে, নারী শরীরকে সামনে পেয়ে পাশবিক আচরণ করে, তার মধ্যে কী ধরনের মানসিকতা কাজ করে?—এই প্রশ্নের উত্তর কি রয়েছে কারও কাছে? আরও সহজ ভাষায় বললে, যখন পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, তার মনের ভিতর কী চলে? নারীর উপর ক্ষমতা ফলানো নাকি যৌন চাহিদা? এই উত্তরই খুঁজেছে TV9 বাংলা ডিজিটাল।

Psychology of the Bully: ধর্ষণের আগে ও পরে কী চলে ধর্ষকের মনে? কী বলছেন মনস্তাত্ত্বিকরা
যখন পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, তার মনের ভিতর কী চলে?
Follow Us:
| Updated on: Sep 05, 2024 | 6:41 PM

ভরা রাজসভায় শয়ে শয়ে লোকের সামনে তাঁকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করেছিল নিজেরই দেওররা! সেদিন সে সম্পূর্ণ রূপে বিবস্ত্র হয়তো হয়নি কিন্তু তাঁর সম্মান? তাঁর স্বাধীনতা? সেই সব কিছুকে এক লহমায় ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল তাঁর পাঁচ স্বামী। দ্রৌপদীকে নারী নয় ভোগ্যপণ্য হিসাবে দেখেছিল কৌরবরা। নারী তো কেবল ভোগের বস্তু, তাই তাঁর উপরে নিজের অধিকার কায়েম করতে, নিজের পুরুষত্বের অহংকার প্রকাশ করতে, বাহুবলের আস্ফালন, যৌন লালসার নিবারণ করতে করতে পাশবিক আনন্দে মেতে উঠেছিল দুই ভাই দুর্যোধন এবং দুঃশাসন। আজ থেকে ৪০০০ বছর আগে মহাভারতে যে কথা লেখা হয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়েও সেই চিত্রটা বদলালো কই?

আজও প্রতি পদে সেই একই ভাবে হেনস্থা হতে হয় মহিলাদের। প্রমাণ ‘তিলোত্তমা’ কাণ্ড। ঘটনার ২৬ দিন পরেও যেন ‘বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে’! কারা এমন নৃসংশ কাজ করেছে তিলোত্তমার সঙ্গে? কে কেড়েছে তাঁর প্রাণ?—এই প্রশ্নের উত্তর আজও নেই। কিন্তু সেই ধর্ষকেরা শান্তির ঘুম ঘুমোতে পারছে? তাঁদের মনে একটুও অনুতাপ কাজ করছে না? শাস্তি যে পেতেই হবে এই ভয় কাজ করছে? এসব প্রশ্ন হয়তো কারওই জানা নেই। যখন এক পুরুষ তাঁর শক্তি প্রদর্শন করে, নারী শরীরকে সামনে পেয়ে পাশবিক আচরণ করে, তার মধ্যে কী ধরনের মানসিকতা কাজ করে?—এই প্রশ্নের উত্তর কি রয়েছে কারও কাছে? আরও সহজ ভাষায় বললে, যখন পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, তার মনের ভিতর কী চলে? নারীর উপর ক্ষমতা ফলানো নাকি যৌন চাহিদা? এই উত্তরই খুঁজেছে TV9 বাংলা ডিজিটাল।

নেটফ্লিক্সের লিমিটেড সিরিজ় ‘unbelievable’-তেমনই একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। যেখানে সিরিয়াল রেপিস্টের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে অপরাধী কিন্তু নারীকে ভোগপণ্য হিসেবেই দেখত। নারী তো ভোগ্যপণ্য নয়। চাইলেই তো আপনি যখন-তখন তার উপর অধিকার ফলাতে পারেন না। আর ব্যবহার করা হয়ে গেলেই ছুঁড়ে ফেলেও দেওয়া যায় না। তাও এই সমাজে ঘটে চলেছে ধর্ষণের ঘটনা। একটু পিছনে ফিরে তাকানো যাক। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের রাত মনে আছে? দিল্লিতে গণধর্ষণ করা হয়েছিল নির্ভ‌য়াকে। নগ্ন‌ অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রেখে দিয়ে গিয়েছিল ক্ষত বিক্ষত নির্ভ‌য়াকে। ঠিক যেমন করে পচা সবজি আমরা বাড়ির বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিই, তেমন করে। এই ঘটনায় ধরা পড়েছিল জড়িত ৬ ধর্ষকই। যাঁদের মধ্যে ৪ ধর্ষকের ফাঁসির সাজা হয় ঘটনার ৭ বছর পরে। এক ধর্ষক রাম সিংহ(ওই বাসের চালক) বিচারপর্ব চলাকালীন সময়ে আত্মহত্যা করে জেলের ভিতরেই। ষষ্ঠজন ধর্ষণ করার সময় নাবালক হওয়ায় একটি সেলাই মেশিন, ১০ হাজার টাকার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ পায়। তবে, সুপ্রিম কোর্ট এই ঘটনাকে উল্লেখ করেছিল ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলে।

এই ঘটনার পরে নড়েচড়ে বসে সরকারও। ধর্ষণ জনিত মামলার ক্ষেত্রে দোষীকে দ্রুত শাস্তি দেওয়ার জন্য বিচার ব্যবস্থায় আনা হয় একাধিক পরিবর্তন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ৫টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট তৈরি করা হয় দিল্লি হাইকোর্টে। যেখানে ১৮ বছরের নীচে দোষীদের ধর্ষণের জন্য কোনও সাজা হত না, সেখানে ধর্ষণের মতো মামলায় ১৬ বছর বয়স হলেই অভিযুক্তকে প্রাপ্ত বয়স্কের মতো বিবেচনা করে বিচার করার মতো আইন আনা হয়। আর এই জঘন্য অপরাধ করা ধর্ষক মুকেশ সিংহ একটুও লজ্জা না রেখে বলেছিল, “এই ঘটনার জন্য দায়ী নির্ভয়া নিজেই। প্রতিবাদ নয় তাঁর মেনে নেওয়া উচিত ছিল ধর্ষণকে।”

কিন্তু তবু পরিবর্তন হয়েছে কি?

দেশের অপরাধ পরিসংখ্যান কিন্তু সেই কথা বলছে না মোটেই। এনসিআরবি রিপোর্ট বলছে ২০২২ সালেই মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা বেড়েছে ৪ শতাংশ। যার মধ্যে ২৫.৮ শতাংশ অপরাধ যৌন হেনস্থা এবং ধর্ষণ সংক্রান্ত। এই রিপোর্ট অনুযায়ী ৮৫,৩০০ জন মহিলা হেনস্থার শিকার। আর মহিলাদের ধর্ষণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা পেয়েছেন মাত্র ২০,৯৬৮ জন। ২০২১ সালের তথ্য বলছে প্রতিদিন প্রায় ৪৬টি করে ধর্ষণের ঘটনা দায়ের হয় এই দেশে। অর্থাৎ প্রতি ৩০ মিনিটে গড়ে একজন নারীর ধর্ষণ করা হয় ভারতে।

এখন প্রশ্ন হল, কেন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে এই ধর্ষণের মতো অপরাধের সংখ্যা? পরিসংখ্যান বলছে যাঁরা ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার শিকার তাঁদের মধ্যেও ১৮-৩০ বছর বয়সীদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা সর্বাধিক। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড, হোক বা কলকাতার পার্কস্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ড, কিংবা কামদুনির ঘটনা—সব ক্ষেত্রেই নির্যাতিতারা ছিলেন ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। যদি বর্তমানে কলকাতায় দাঁড়িয়ে তিলোত্তমা কাণ্ডের দিকে চোখ রাখা হয়, সেখানে ‘তিলোত্তমা’র ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে তাঁরই কর্মক্ষেত্রে। আজ ১২ বছর পরেও যে পরিস্থিতির কোনও বদল ঘটেনি তার প্রতি মুহূর্ত বুঝিয়ে দিচ্ছে বর্তমান কলকাতার ছবি।

শুধু শহর বা গ্রামের রাস্তাঘাটে নয়, এমনকি নিজেদের কর্মক্ষেত্রে, পুলিশের দ্বারা, সেনা কর্মীদের দ্বারা, উর্ধতন কর্মচারীর দ্বারাও যৌন হেনস্থা এবং ধর্ষণের শিকার মহিলারা। এমনকি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে জেলের মধ্যেও। কয়েকদিন আগেও এই নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। বঙ্গের কারাগারগুলিতে মহিলাদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার পরিসংখ্যান চিন্তায় ফেলেছিল শাসক পক্ষকে। কিন্তু সে অন্য বিষয়!

প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ফাঁসির মতো দৃষ্টান্ত মূলক সাজা পাওয়ার পরেও একচুল বদলায়নি পরিস্থিতি। প্রশ্ন হল, ধর্ষকেরা মানসিকতায় কি কোনও পরিবর্তন এসেছে? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া এর উত্তরে ৯০ ভাগ মানুষ ‘না’-ই বলবেন। কিন্তু যখন একজন পুরুষ মহিলার উপর শারীরিক অত্যাচার চালায়, তাকে ধর্ষণ করে, তার মধ্যে কী ধরনের মানসিকতা কাজ করে? ঠিক কতটা বিকৃত মানসিকতা হলে মানুষ পশুর থেকেও অধম আচরণ করতে পারে? এই উত্তরের খোঁজে TV9 বাংলা ডিজিটালের তরফে যোগাযোগ করা হয়ে মনরোগ চিকিৎসক ডাঃ অংশুমান দাশ, কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন নগরপাল গৌতম মোহন চক্রবর্তী এবং সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা তথা নিয়মিত জেলবন্দিদের নিয়ে কাজ করে চলা টুম্পা বিশ্বাসের সঙ্গে।

ধর্ষণের মতো অপরাধ এক ধরনের বিকৃত মানসিকতার প্রমাণ— এ নিয়ে দ্বিমত প্রকাশের কোনও জায়গা নেই। এই প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা টুম্পা বিশ্বাস বলেন, “এই ধরনের অপরাধীদের জেলের ভিতরেও একটু নীচু চোখে দেখা হয়। এমনকি যাঁরা খুন বা অনান্য অপরাধের দায়ে জেলে রয়েছেন তাঁরাও এই অপরাধীদের পছন্দ করেন না। বাকিরা তাঁদের সঙ্গে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলেন।” অর্থাৎ, শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বড় বড় দাগী আসামীদের কাছেও ধর্ষক গ্রহণযোগ্য নয়। তাই জেলেও যে ধর্ষণে অভিযুক্তদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা হয়, এমনটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। টুম্পা দেবীর সঙ্গে কিছুটা সহমত পোষণ করে কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন নগরপাল গৌতম মোহন চক্রবর্তী বলেন, “এই বিষয়টিশুধু জেল বলে নয়, সমগ্র সমাজেই নীচু চোখে দেখা হয়। যাঁরা মহিলাকে কোনও কারণ ছাড়াই ধর্ষণের করে, তাঁদের প্রতি না সমাজে, না জেলে কোথাও কারও কোনও সহানুভূতি থাকে না।”

কেন বারবার ঘটে ধর্ষণের ঘটনা?

ধর্ষকদের প্রতি সহানুভূতি থাকা উচিত বলেও মনে করে না আজকের কলকাতা, আজকের সমাজ। কিন্তু তারপরেও কেন এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটে? তা বুঝতে গেলে ফিরে তাকাতে হয় সেই নির্ভয়া কাণ্ডের দিকে। যেখান থেকে খানিকটা হলেও ধারণা মেলে। ২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের পরে ২০১৫ সালে বিবিসি নির্ভয়া কাণ্ড নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। যেখানে এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত মুকেশ সিংহ (পরবর্তী কালে যার ফাঁসি হয়)-এর সাক্ষাৎকারে উঠে আসা কিছু বক্তব্য নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সেই সাক্ষাৎকারে অভিযুক্তের মধ্যে কোনও রকম আত্মগ্লানি ধরা পড়েনি। বরং মুকেশ বলেন “রেপের মতো ঘটনার জন্য ছেলেদের থেকে অনেক বেশি দায়ী মহিলারাই। একজন ভদ্র ভালো মেয়ে কখনই রাত ৯টার সময় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না।” তাঁর এই কথা থেকেই বোঝা যায় ধর্ষণের মতো ঘটনাকে কোনও অপরাধ বলেই মনে করেন না তিনি। বরং এই কাজ তাঁর কাছে অনেকটা অধিকারের মতোই। যা ধারণা করা যায় তাঁর এই বক্তব্য থেকেই। মুকেশ বলেন, “মেয়েটির ধর্ষণের সময় আমাদের বাধা দেওয়া উচিত ছিল না। ও বাধা না দিলে আমরা এত অত্যাচার করতাম না। কেবল ছেলেটিকেই আঘাত করতাম। মেয়েটির প্রতিবাদ না করে চুপ করে মেনে নেওয়া উচিত ছিল।” সেই সাক্ষাৎকারেই মুকেশ আরও বলেন, “ফাঁসির সাজা মহিলাদের জন্য অবস্থা আরও ভয়াবহ করে তুলবে। এরপর থেকে কেউ আর শুধু তাঁদের মতো, ধর্ষণ করেই মহিলাদের ছেড়ে দেবে না। বরং ধর্ষণের পরে তাঁদের প্রাণও নিয়ে নেবে।” শেষ অবধি সেই কাণ্ডই কিন্তু ঘটল ‘তিলোত্তমা’র সঙ্গেও। শুধু ধর্ষণ নয়, খুনও করা হয়েছে তাঁকে।

ঠিক কোন মূহুর্তে এই ঘটনা ঘটায় ধর্ষকরা?

মুকেশের বক্তব্য এবং দিল্লির সেই রাতের ঘটনা বিবেচনা করলেই ধর্ষকদের মনস্তত্বের দুটি দিক উন্মোচিত হয়। এক ‘সুযোগ সন্ধানি’। এই প্রসঙ্গে মনরোগ চিকিৎসক ডাঃ অংশুমান দাশ বলেন, “অনেক সময় কেউ যদি এমন কোনও কাজে লিপ্ত থাকেন যা তাঁর যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি করে (যেমন নেশাগ্রস্থ হয়ে যৌন উত্তেজক ছবি দেখা বা আলোচনা করা ইত্যাদি) সেই মূহুর্তে এমন কোনও সুযোগ যদি সে পায় তাহলে অনেক সময় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এই ধরনের অপরাধ করতে পারে।” কিন্তু যৌন মিলনই ধর্ষণের পিছনে প্রধান বিষয়? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হওয়ার দরুণ মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ করার যে প্রবৃত্তি তা থেকেও এই ঘটনা ঘটান। নির্ভয়া কাণ্ডের পরেও মুকেশের মধ্যে কোনও আত্মগ্লানি না থাকাই তাঁর প্রমাণ। অংশুমানবাবু আরও বলেন, “শুধু এই বিষয়গুলোই নয়। দুঃখের বিষয় হল, ধর্ষণ করার সময় অনেকেই বোঝেন না যে এর ফলে তিনি কোনও মহিলার উপর নির্যাতন করছেন। তাঁরা ভাবেন এতে মহিলাটিকেও শারীরিক সুখ অনুভব করাচ্ছেন। অর্থাৎ এর পিছনে ‘ফ্যাটিজিম’-এর একটি বিষয় কাজ করে। অর্থাৎ যৌন মিলনের সময় শারীরিক নানা যন্ত্রণাকে উপভোগ করা, বা নিজের যৌন সঙ্গীকে আঘাত করার মধ্যে একটি আনন্দ উপভোগ করে ধর্ষকরা।”

দু’জন সম্পর্ক থাকা মানুষ, সে স্বামী-স্ত্রী হোক বা প্রেমিক-প্রেমিকা, এক্ষেত্রেও ‘ইচ্ছা’ বা ‘অনুমতি’ (Consensual Sex) বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তা না থাকলে সম্পর্কে থাকা দুই ব্যক্তির ক্ষেত্রেও শারীরিক সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ বলেই ধরা হবে। অর্থাৎ অমিতাভ বচ্চনের ‘পিঙ্ক’ সিনেমার ডায়লগ ধরেই বলতে হয় ‘নো মিনস নো’ (NO MEANS NO)

ধর্ষণের দায় কার? পুরুষ, নারী নাকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের?

মানসিকতা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে, তখন নির্ভয়া কাণ্ডে অভিযুক্তদের আইনজীবী এমএল শর্মার আরেকটি বক্তব্য তুলে ধরা দরকার। যেখানে নিজের মক্কেলে সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আপনি যদি রুটি বা মিষ্টি রাস্তায় রেখে দেন তাহলে তা কুকুরে ছিঁড়ে খাবেই। প্রতিটার মহিলার দায়িত্ব নিজেকে সুরক্ষিত পরিবেশে রাখা। বদলে এমন কোনও পরিবেশ তৈরি করা নয় যা তাঁকে ধর্ষণের মতো ঘটনার দিকে ঠেলে দেবে।” অর্থাৎ, আইনজীবির এই বক্তব্য থেকে মহিলাদের প্রতি পুরুষের অধিকার বোধ বা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি আরও স্পষ্ট। কিন্তু এমন মনোভাব জন্ম নিল কী করে? এর পিছনে কি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দায়ী? একটু গভীর গিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, আপনি কোন পরিবেশে বড় হয়ে উঠছেন, তার আপনার আগামী জীবনের উপর প্রভাব ফেলে। যে কারণে মহিলাদের সম্মান করার বিষয়টি খুব ছোট থেকেই শেখা প্রয়োজন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই যখন বাবা-মা কর্মসূত্রে সারাদিন বাইরে থাকে তখন তাঁদের সন্তানকে দেখার কেউ থাকে না। তাঁরা কী ভাবে সেই সময় কাটাচ্ছে তাও গুরুত্বপূর্ণ। আবার এখন সর্বত্র ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার। অথচ সেই সমন্ধে কোনও শিক্ষা নেই। নেট মাধ্যমে ক্রমাগত অশ্লীল জিনিস দেখাও মনকে প্রভাবিত করে। তারই সঙ্গে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠায় পুরুষ হওয়ার অহঙ্ককার। যার ফলে মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ করাটা তাঁদের জন্মগত অধিকার বলে মনে করেন অনেকেই। সমাজকর্মী টুম্পার কথায়, “রেপ হয় আমার অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবল ইচ্ছা থেকে। একটি ধর্ষণের পিছনে তিন ধরনের মানসিকতা কাজ করে। প্রথমত অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার বাসনা, দ্বিতীয়ত নিজের ক্ষমতার প্রদর্শন এবং তৃতীয়ত রাগ। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও ধর্ষণের ঘটনা ঘটান।” এই একই প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন নগরপাল গৌতম মোহন চক্রবর্তী বলেন, “যাঁরা ধর্ষণের মতো অপরাধ করেন তাঁরা যে কেবল যৌন সুখ পেতেই এই কাজ করেন তা নয়। বরং তাঁর সঙ্গেই কাউকে শাস্তি দেওয়া, প্রতিশোধ নেওয়া, পুরুষত্বকে প্রতিষ্ঠা করা বা মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো বিষয়গুলি বিশেষ ভূমিকা নেয়।” এমনকি শিশুদের বিরুদ্ধেও এই ধরনের ঘটনা সেই নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছাকেই সমর্থন করে। টুম্পা বলেন, “শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। তাঁরা বেশি প্রতিবাদ করে না। তাই স্কুল থেকে, বাড়ি সর্বত্র শিশুদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপরাধের উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি।” এই একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন গৌতমবাবুও। তিনি বলেন, “এই বিষয়টি যে কোনও বড় অপরাধ তাই মনে করেন না বেশিরভাগ অপরাধীরা। পুরুষের মধ্যে সব সময় একটি বিষয় কাজ করে, তাঁরা মহিলাদের থেকে বেশি শক্তিশালী এবং ধর্ষণ সেই শক্তির প্রদর্শন।”

পুরুষকে ধর্ষক করে তুলতে এই সমাজ কতটা দায়ী?

ধর্ষণের মতো অপরাধকে পরিণাম দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও দুটি বিষয় দেখা যায় বলে জানিয়েছেন প্রাক্তন নগরপাল। তিনি বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অপরাধীরা বেশিরভাগ একাকীত্বে ভোগেন, বা নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতাকে ভুলতে তাঁরা এই কাজ করে বসেন। আবার নিজে ছোটবেলায় বা কখনও যৌন হেনস্থায় শিকার হওয়ায় সেই আক্রোশ থেকেও অনেকে এই জঘন্য অপরাধ ঘটিয়েছেন, এমন উদাহরণ আছে।” অংশুমানবাবু বলেন, “ছোট বেলায় কোনও ছেলে যদি যৌন হেনস্থার মধ্যে দিয়ে যায় তাহলে তাঁর সেই রাগ বা আক্রোশ অনেক সময় গিয়ে পড়ে সমগ্র মহিলাজাতির উপরে। আবার অনেকে নানা ধর্মীয় ও অনান্য মতে বিশ্বাস করে যৌন কর্মীদের কাজকেও পাপ বলে মনে করেন। ফলে সেই পাপকে শেষ করার তারণা থেকে অথবা ছোটবেলার আক্রোশ থেকেও ধর্ষণ করেন।”

কিন্তু অপরাধবোধ? আমি যে একটা মানুষ, একজন নারীর সঙ্গে অন্যায় করেছি—এই অপরাধবোধ কি জন্ম নেয় ধর্ষকের মনে?

অন্তত মুকেশের ইন্টারভিউ তেমনটা বলছে না। ধর্ষকের মধ্যে যে ন্যূনতম লজ্জা বা অপরাধবোধ কাজ করে না—এটা বলার অবকাশ রাখে না। হয়তো খুন বা অন্য কোনও অপরাধের ক্ষেত্রে এতটা প্রকট নয়। গৌতমবাবু বলেন, “এমন কোনও কথা নেই যে, আজকে ধর্ষণ করল সে আর কোনও দিন করবে না। বরং আবার সুযোগ পেলেই এই কাজ করবে। এমনকি এই ধর্ষণ করতে করতে অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়ে। কারণ এই কাজকে খুব একটা বড় অপরাধ বলে তাঁরা মনেই করে না। তাঁর সঙ্গে ‘আমি পুরুষ, আমি তো এটা করতেই পারি’ এই ধরনের একটা মানসিকতাও কাজ করে।” অপরাধীদের সঙ্গে কথা বলে একই অভিজ্ঞতা টুম্পারও। তিনিও কোনও অপরাধ বোধ লক্ষ করেননি দোষীদের মধ্যে। তাই এই অপরাধ আটকাতে তাঁর পরামর্শ ধর্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা দরকার। তাঁদের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী তাঁদের কাউন্সিলিং প্রয়োজন। স্কুল, কলেজে আরও বেশি করে এই বিষয়ে কথা বলা এবং শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন। যে কারণেই হোক একজন পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, এর পিছনের মূল বিষয় হল তাঁর ব্যক্তিত্বের ‘অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি’ বা অপরাধ করার প্রবণতা। মনরোগ বিশেষজ্ঞের কথায়, “যে কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির মধ্যেই এই অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি কম-বেশি থাকেই। অর্থাৎ তাঁরা এই অপরাধকে অপরাধ বলেই মনে করেন না।”

ধর্ষণ করার সময় ঠিক কী চলে একটি পুরুষের মনে? 

গৌতমবাবু বলেন, “এই ঘটনা সংঘটিত করার সময় ধর্ষক সেই মেয়েটির মানসিক বা শারীরিক কষ্ট হচ্ছে যে তা বোঝে না। এমনকি তার পরেও খুব একটা বুঝতে পারে এমন নয়। তাই কাউন্সিলিং-এর সঙ্গেই কঠোর সাজাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে ‘সিভিয়ারিটি অফ পানিশমেন্ট’ অর্থাৎ কি শাস্তি হচ্ছে বা ফাঁসি হচ্ছে কিনা তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ‘সারটেনিটি অফ পানিশমেন্ট’ অর্থাৎ অপরাধ করলে শাস্তি নিশ্চিত এই বিষয়টি। এক্ষেত্রে সমাজকে বার্তা দিতেও শাস্তি দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।” বিশেষ করে ধর্ষকদের মধ্যে তা আরও বেশি করে বিদ্যমান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের অপরাধকে মেনে নিতেও অস্বীকার করেন অভিযুক্ত বা দোষীরা। সর্বোপরি ধর্ষকদের মধ্যে এই কাজ করার পরেও কোনও অনুশোচনা না তৈরি হওয়া সেই অপরাধী মানসিতার প্রমাণ। এমনকি মহিলাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়ার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিতে নারাজ এই ধরনের অপরাধীরা। তাই গৌতমবাবুর সুরেই ডাঃ অংশুমান দাশ বলেন, “এই কারণে এঁদেরকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের অপরাধ কমাতে ‘পলিসি মেকার’দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।”

ধর্ষণ আটকাতে শাস্তির ভূমিকা কতটা? 

‘অনুমতি’—এটাই অনেক মানুষের মধ্যে কাজ করে না, সে ধর্ষক হোক বা প্রেমিক। সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে গেলে এই প্রতিটা মানুষকে ‘অনুমতি’র বিষয়ে আরও শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তবে, যাঁদের মধ্যে অপরাধ বোধ প্রবল, তাঁদের কঠোর শাস্তি দিতেই হবে। আবার যদি কোনও মানসিক সমস্যা থাকে, সেক্ষেত্রে শাস্তিটাই সব নয়। প্রয়োজন সেই নির্দিষ্ট মানসিক রোগের চিকিৎসা করাতে হবে, কাউন্সেলিং করাতে হবে এবং অপরাধ করার প্রবণতা থেকে তাকে বের করে আনতে হবে। শুধু পুলিশ বা প্রশাসন বিশেষ ভূমিকা পালন করবে, তা নয়। কিছু শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই দিতে হবে। সমাজকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। তবেই বন্ধ হবে এ সমাজে ধর্ষণ। এই দায়িত্ব নিতে হবে প্রত্যেকে শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিকে।

তবে, এটাও অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই ধর্ষণ রুখতে অতিদ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে তোলা। সর্বোপরি সেই শাস্তির প্রচার এমন ভাবেই করা যাতে এই ধরনের অপরাধ করার আগে অপরাধী সতর্ক হয় এবং ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে, বলেই মত মনরোগ বিশেষজ্ঞের। ঠিক যেমন করে ৪০০০ বছর আগে এক ধর্ষণের বিচার করতে দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত দিয়ে দ্রৌপদীর চুল ধুয়ে দিয়েছিল ভীম। যেমন করে নিজের স্ত্রীর অপমান করা ঊরুদ্বয়কে চূর্ণ করেছিল গদা। তেমনই আজও ধর্ষকদের বিচার চায় দ্রৌপদীরা, বিচার চায় তিলোত্তমারা।