মানুষের জীবন আর একটি নদীর মধ্যে মিল কোথায়, জানেন? দু’জনেরই জীবনপথে যত ঘাত-প্রতিঘাত আসে, ততই তাদের জীবন সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে, গড়ে তোলে জীবনের একাধিক বাঁক। তার সঙ্গে সৃষ্টি হয় অপূর্ব ভাস্কর্যের। আর এই জীবনের সঙ্গী যখন হয়ে ওঠে মোটরবাইক, তখন নতুনকে জানার ইচ্ছে জন্মায় অসীম ধৈর্য্যের জোরে। একজন বাইক চালকের গতি কোনও ব্যাপারই নয়। যেটা আসল বিষয়, সেটা হল: তাঁর অসীম ধৈর্য্য। হতে পারে কোনও এক সময় তিনি বিবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন। একজন প্রকৃত রাইডার অসুবিধার কথা না-ভেবে এক-একটি করে সমস্যার সমাধান করে পৌঁছে যান অন্তিম গন্তব্যস্থলে। ঠিক যেমন একটি নদী তার গতিপথে আসা পাহাড়কে ভেঙে গিরিখাত তৈরি করে পৌঁছে যায় সমুদ্রে।
তাই আর দেরি না করে চলুন মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তথা পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার কাছে অবস্থিত গনগনিতে। যাওয়ার পথে রয়েছে মুকুটমণিপুর জলাধার এবং ফেরার পথে বাঁকুড়ার জয়পুরের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চাঁপাডাঙ্গা হয়ে কলকাতা। যেহেতু ওয়ান ডে রাইডের জন্য ৫০০ কিলোমিটার রাস্তাটা অনেকটাই বেশি, তাই এই দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য আপনাকে কলকাতা থেকে ভোর পাঁচটার সময় বেরোতেই হবে। আগের দিন রাতে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে ভোর চারটেয় অ্যালার্ম দিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন। জানি অ্যালার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে যাবে, তাই আর দেরি না করে ভোরের আলো ফোটার আগে কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়ুন গনগনির উদ্দেশ্যে।
আমি এখনও গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখিনি, যা সাধারণত সকলকে আতঙ্কিত করে। তবে, আমাদের নিজস্ব বাড়ির উঠোনে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের একটি ছোট সংস্করণ রয়েছে, যা গনগনি নামে পরিচিত। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার মতো দুর্দান্ত না-ও হতে পারে, তবে এটি অবশ্যই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। গড়বেতার কাছে কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত। গনগনি আসলে গভীর গিরিখাত তৈরি করে লাল ল্যাটেরাইট মাটিতে, যা দেখতে খুব সুন্দর লাগে। জল ও বাতাসের কারণে সৃষ্ট কংসাবতী নদীর তীরে বছরের পর বছর মাটি ক্ষয়ে সম্ভবত এমন সুন্দর এবং অনন্য মাস্টারপিস সৃষ্টি করেছে। আসল ল্যান্ডস্কেপ বর্ষাকালে—কংসাবতীর জল চ্যানেলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, যা পুরো জায়গাটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলে।
চলুন তবে আর দেরি না করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি গনগনির উদ্দেশ্যে। কলকাতা থেকে গনগনি যাওয়ার দু’টি রাস্তা আছে। একটি কোলাঘাট, মেদিনীপুর হয়ে রায়পুর এবং মুকুটমনিপুর ড্যাম হয় সোজা গনগনি। আর অন্যটি হলো ডানকুনি, আরামবাগ হয়ে জয়পুর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বিষ্ণুপুর হয়ে সোজা গনগনি। আমার বাইক রাইডিং-এর একটাই নিয়ম: আসা-যাওয়ার রাস্তা আলাদা হওয়া চাই। তাহলে অনেক কিছু দেখা যায়। এক্ষেত্রে আমি প্রথম রাস্তাটা যাওয়ার এবং দ্বিতীয় রাস্তাটা আসার জন্য ঠিক করলাম। আজ প্রায় ৫০০ কিলোমিটার রাইড করতে হবে; তাই ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গনগনির উদ্দেশ্যে। আমার প্রথম গন্তব্যস্থল মুকুটমণিপুর ড্যাম।
ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। একটা কুয়াশা আচ্ছন্ন পরিবেশ কাটিয়ে সোজা কোলাঘাট-পাঁশকুড়া-ডেবরা টোল প্লাজা ক্রস করে আমি চললাম মেদিনীপুরের উদ্দেশ্যে। আমি এবার শালবনি-চন্দ্রকোনা রোড না ধরে একটা নতুন রাস্তা, মানে ভাদুতলা থেকে বাঁ-দিক নিয়ে ভাদুতলা রিজার্ভ ফরেস্ট এবং গোদাপিয়াশাল, শালবনি ফরেস্টের মধ্য দিয়ে গোয়ালতোড় চৌমাথায় পৌঁছলাম। ভাদুতলা থেকে পিরাকাটা হয়ে গোয়ালতোড় চৌমাথা রাস্তা… অপূর্ব সুন্দর চারপাশে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে জামকালো পিচের রাস্তার এক অপূর্ব অনুভূতি, যা বলে বোঝানো যাবে না। তারপর গোয়ালতোড় চৌমাথা থেকে বাঁ-দিক নিয়ে রায়পুর হয়ে সোজা চলে এলাম মুকুটমণিপুর ড্যামে। কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর ড্যাম আনুমানিক ২০০ কিলোমিটারের রাস্তা… এনএইচ এবং এসএইচ হওয়ার কারণে রাস্তা যথেষ্ট সুন্দর এবং এই রাস্তা অতিক্রম করতে আপনার চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগবে।
কংসাবতী নদীর উপর গড়ে ওঠা এই মুকুটমণিপুর ড্যামটি ভারতবর্ষের দ্বিতীয় দীর্ঘতম মাটির বাঁধের ড্যাম, যার দৈর্ঘ্য ১২ কিলোমিটার এবং চওড়ায় দু’কিলোমিটার। এই ড্যামের একটি বিশেষত্ব হল, বাঁধের উপর দিয়ে প্রায় ১১ কিলোমিটারের রাস্তা দিয়ে বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা এক কথায় অসাধারণ। রাস্তার মাঝখানে পাবেন পরেশনাথ পাহাড় নামে একটি ছোট টিলা। যেখানে জৈন ও হিন্দু দেবতার মূর্তি পূজা করা হয়। বাঁধ নির্মাণের সময় ক্ষরণকালে এই মূর্তিগুলো উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও পরেশনাথ পাহাড়ের নিচে কয়েকটি জৈন মূর্তি এখনও পড়ে আছে। এছাড়াও এখানে দেখার জন্য রয়েছে মুসাফিরানো ভিউ পয়েন্ট। এ ছাড়া মুকুটমণিপুর ট্যুরিস্ট স্পট, যেখানে বোটিংয়েরও সুবিধা রয়েছে। আর রয়েছছে দুর্গাদি ড্যাম ভিউ পয়েন্ট, যা থেকে মুকুটমণিপুর ড্যামের দৃশ্য সত্যিই অসাধারণ। এই সুন্দর ড্যামকে ভালভাবে ঘুরে, দেখে, ছবি তুলে এবং বোটিং করে আপনার কখন যে দু’থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় চলে যাবে, বুঝতেও পারবেন না।
এরপরে আমি বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গনগনির উদ্দেশ্যে, যা মুকুটমণিপুর ড্যাম থেকে মোটামুটি ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যাওয়ার পথে মানবাজারে সকাল এবং দুপুরের খাবার একসঙ্গে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম কেন্দা হয়ে গনগনির উদ্দেশ্যে। যখন গনগনিতে পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে প্রায় দু’টো ছুঁইছুঁই। এই ৮০ কিলোমিটার রাস্তা মোটামুটি ভালই… কেন্দা থেকে যে রাস্তাটা গনগনের উদ্দেশ্যে যায়, সেই রাস্তাটা একটু খারাপ। মানে মাটির উঁচু-নিচু রাস্তা। তাই বাইক চালাতে একটু কষ্টই হয়। বাইক যেখানে পার্ক করলাম, সেই জায়গাটা দূর থেকে দেখে মনে হল সামনেই গিরিখাত, আর কোনও রাস্তা নেই। সত্যিই এ এক লাল মাটির গিরিখাত, মেঘালয় গিয়ে অনেক গিরিখাত দেখেছি, যেখানে পাহাড় শেষ হয়ে গিয়েছে… আর এটি হল মাটির গিরিখাত। এটি সম্পূর্ণরূপে একটা আলাদা পৃথিবীর মতো ছিল, আমার চারপাশে বিশাল কমলা রঙের গঠন, গিরিখাতগুলির নিজস্ব একটি গল্প রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিছু অংশ দেখতে বিশাল দৈত্যের মতো, আবার কিছু অংশের পাথরের গঠন পৌরাণিক প্রাণীর মতো। আবার কখনও দেখতে একটি মনোরম দুর্গের মতো মনে হয়েছিল। আমি খুঁজে পেয়েছি যে দু’টি খুব আকর্ষণীয় গঠন রয়েছে, সেগুলি হল: একটি আয়তাকার গঠনের মতো একটি গুহা রয়েছে। মনে হচ্ছিল আমি কোনও এক লুকনো গুহায় প্রবেশ করেছি। আরেকটি শিলার গঠন পাহাড়ের আকার তৈরি করেছে। সত্যি কথা বলতে কী, সেই জায়গাটি ফটোগ্রাফে ক্লিক করার জন্য একটি ভাল জায়গা। নিচে নদীতে যাওয়ার পথটা একটু জটিল ছিল, এখন শুনেছি প্রায় হাফ রাস্তা সিঁড়ি করে দিয়েছে। আমার সময় সিঁড়ি বলতে কিছুই ছিল না, ছিল মাটির ধাপ-কাটা রাস্তা। নদীর তীরে প্রচুর ঘাস জন্মানোর কারণে পরিষ্কার নয়।
স্থানীয়দের কাছ থেকে নানা পৌরাণিক কাহিনী জানা যায় এই জায়গা সম্পর্কে। তার মধ্যে একটি হল স্থানীয়দের বিশ্বাস যে, গনগনিতে এক সময় বকাসুর অসুরের আবাস ছিল। বকাসুর, রাক্ষস প্রতিদিন গ্রাম ভাঙচুর করত। নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য, স্থানীয় রাজা প্রতি সপ্তাহে একজন মানুষ বকাসুরকে খাবার হিসাবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। তারপর একদিন পাণ্ডবরা তাঁদের মা কুন্তীর সঙ্গে বনবাসের সময় ওই অঞ্চলে গিয়েছিলেন। গ্রামের এক স্থানীয়ের বাড়িতে থাকতেন। ভাগ্য যেমন… এবার সেই পরিবারের একজন সদস্যকে বকাসুরের কাছে অর্পণ করার পালা। তার ফলে পরিবারটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। কুন্তী এটা দেখে তাঁর এক পুত্র ভীমকে বকাসুরের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। ভীম একজন মহান যোদ্ধা ছিলেন এবং খুশি হয়ে বকাসুরের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সেখানে গেলে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং অবশেষে ভীম বকাসুরকে পরাজিত করেন। বেশ কয়েকদিন ধরে চলা এই মহাযুদ্ধ পৃথিবীর ভূ-প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এইভাবে, গনগনি গিরিখাত গঠিত হয়েছিল।
যাই হোক, পরে বাস্তবে ফিরে এসে বাংলার এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের প্রচুর ছবি এবং তার সঙ্গে আমার বাইকের ছবি তুলে পড়ন্ত বিকেলে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথ প্রায় ২০০ কিলোমিটার। সন্ধের সময় নাকাইজুড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বিষ্ণুপুর হয়ে জয়পুর জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বনলতা রিসর্টে। বনলতা রিসর্টে যখন পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে প্রায় আটটা বাজে। তাই আর এখানে সময় নষ্ট না-করে চা-বিস্কুট এবং কিছুক্ষণ পরে ২০ টাকা দামের বড় একটা রাজভোগ খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। গনগনি থেকে জয়পুর ফরেস্ট পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার রাস্তা সত্যিই অসাধারণ, যা ভাষায় বলা যায় না। এই রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য আপনাকে একবার রাত্রে বাইক রাইড করতেই হবে।
এরপর আরামবাগ হয়ে চলে এলাম চাঁপাডাঙ্গা। চাঁপাডাঙ্গা মানেই আমার এক রাইডার ভাই ‘আজ়াদ পরিন্দে’, মানে দেবুর বাড়ি। এখান থেকে যাব, আর আমার ভাইকে ফোন করব না, তা-ও আবার হয় নাকি। তাই ওর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা সময় কাটিয়ে ডানকুনি হয়ে পৌঁছে গেলাম সেই আমার শহর কলকাতায়। তখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। কলকাতা শহরে তখন বড় গাড়ির চাপ। তাই বাড়ি পৌঁছতে একটু রাত হয়ে গেল, সঙ্গে রয়ে গেল একটা পুরো দিনের অসম্ভব ভাল অভিজ্ঞতা… কিছু অ্যাডভেঞ্চার আর অজস্র ছবি।