Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ১৪—প্রকৃতির মাঝে এ এক অন্য লাদাখ, তৃতীয় পর্ব

megha |

Aug 27, 2023 | 9:45 AM

Ladakh Bike Trip From Kolkata: প্রায় ৫১০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছেছি অমৃতসর শহরের মূল ফটকে। অনেকটা গুরুদোয়ারার চূড়ার আদলে গড়া মূল প্রবেশদ্বার রাতের আলোয় বেশ ঝলমল করছিল।

Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ১৪—প্রকৃতির মাঝে এ এক অন্য লাদাখ, তৃতীয় পর্ব

Follow Us

২৪ শে মে

শরীর চায় না খাদ্য। সে চায় সুন্দর পরিবেশ, ভাল প্রকৃতি আর মানুষের মেলবন্ধন… আর সঠিক মনের বিকাশ। তার কারণ সুষম খাবার না খেলেও রাতের ঘুমটা খুবই দরকার। মন ও শরীর—দুই সঠিক সময়ের ব্যবধানে নিজেকে হিল (heal) বা রিপেয়ার (repair) করে থাকে। ঘুমের দেশে প্রচুর পরিমাণে শক্তি লুকিয়ে আছে। আর সেই শক্তি হল মন, যা শরীরকে প্রদান করা হয়। এখন থাক সে সব কথা…. আমরা গাড়ি চালানো যখন শুরু করলাম, তখন ঘড়িতে বাজে ভোর সাড়ে চারটে। ভোরের হালকা আলো আর নিস্তব্ধতার আমেজটা এক্কেবারে অন্যরকম। মানুষের ভিড় নেই, গাড়ির যানজট নেই। নেই কলকারখানা ধোঁয়ার দাপাদাপি। আছে শুধু একটা শান্ত পরিবেশ। গ্রেটার নয়ডা ছাড়িয়ে দিল্লিকে বাঁ দিকে ফেলে রেখে উঠলাম গাজিয়াবাদে। সকাল-সকাল আমাদের তেমন কোনও জ্যামের মধ্যে পড়তে হল না। গুগল ম্যাপের ভাষায় একটা শর্টকাট বাইপাস রাস্তা ধরে খালের পাশ থেকে গিয়ে কারনাল যাওয়ার রাস্তা ধরলাম। মাঝে একবার খালের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা সকালের খাবার খেয়ে নিলাম। খালপাড় শেষ করে আমরা এনএইচ-এ উঠলাম। এর পাশে ভুট্টার ক্ষেতগুলো সবে লাগানো গাছে সবুজ হয়ে উঠছে। এই রাস্তাটার একটা নাম হলো এশিয়ান হাইওয়ে-টু। এই AH-২ এর মধ্যে রয়েছে উত্তর ভারতের NH-9, NH-3। আর আমরা যে রাস্তা দিয়ে চলেছি, তা হল NH-44। পূর্ব ভারতের শিলিগুড়ি এবং উত্তর-পূর্ব শিলংও এই রাস্তার অধীনে পড়ে। মানে এক কথায় পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার ডেনপাসর থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড-মায়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-পাকিস্তান হয়ে ইরানের খোশরাভী পর্যন্ত ১৩ হাজার ১০৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ। আর এই পথেই ভারতে বিভিন্ন সময়ে নানা জাতির মানুষ এসেছে বাণিজ্য করতে। আবার কেউ শাসন করতে। আমরা একে-একে পানিপথ-কারনাল-কুরুক্ষেত্র হয়ে আম্বালায় এসে পৌঁছলাম। আম্বালায় এসে দেখলাম যানজটের সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজও বেড়েছে। তাই শরীরে জলের পরিমাণ ঠিক রাখতে ফলের শরবত এবং লোকাল ভাষায় আডু নামে এক ধরনের টক মিষ্টি ফল খেয়ে আবার চলতে থাকলাম। গাছের তলায় কম-বেশি বিশ্রাম নিয়ে বিকেল তিনটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ফাগোয়ারা নামক স্থানে। এখানেই এক পঞ্জাবি ধাবায় সবাই মিলে ঢুকে পড়লাম। এই ধাবাটি বেশ পরিষ্কার এবং মানুষজনের তেমন কোনও ভিড় ছিল না। আমরা ধাবার বাইরেই বসতে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই ধাবার মালিক একসঙ্গে ১০ জনকে দেখে এক গাল হেসে আমাদের ভিতরের একটা বড় ঘরে কুলার এবং পাখা চালিয়ে সুন্দর চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করে দিলেন। খাবার টেবিলের কথা বলতে গেলে অনেক সময় চলে যাবে। তাই… চলুন বেরিয়ে পড়ি অমৃতসরের উদ্দেশ্যে।

জলন্ধর থেকে এনএইচ-৪৪কে ডানদিকে রেখে এনএইচ-২ ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। দিল্লি হয়ে ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে এই রাস্তাটাই লাহোর হয়ে কাবুল গিয়েছে। না… ‘গদর টু’-এর মতো বারবার পাকিস্থানে ঢুকে ঝামেলা না-করে চলুন অমৃতসর ঘুরে আসি। একটা ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে হলে দরকার হয় পাসপোর্ট ও ভিসা। সঙ্গে গাড়ির কারনেট, আরও অনেক প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস, তারপর হাজারো কৈফিয়ৎ। আর খারাপ উদ্দেশ্য হলে কিছুই দরকার হয় না। একজন মহান ব্যক্তি বলেছেন, ‘উদ্দেশ্য শুধু উদ্দেশ্যই হয়—সেটা ভাল অথবা খারাপ কি না, তা বিচার করে মানুষ।’

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এসেছে। প্রায় ৫১০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছেছি অমৃতসর শহরের মূল ফটকে। অনেকটা গুরুদোয়ারার চূড়ার আদলে গড়া মূল প্রবেশদ্বার রাতের আলোয় বেশ ঝলমল করছিল। আমরা সবাই এখানে দাঁড়িয়ে ফটোসেশন সেরে ফেললাম। এখানে বেশি সময় দেওয়া যাবে না। সেই কারণে স্বর্ণমন্দিরের রাস্তা ধরলাম। মেইন রোডে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বাঁ দিকে কাট আউট নজরে এল। এখান থেকে রাস্তা কিছুটা চওড়া। তারপর ভিড়ে ঠাসাঠাসি গলি। গলিগুলো প্রায় একই রকমের। জিপিএস দেখাচ্ছে স্বর্ণমন্দির সামনেই। তাই আর ভিড়ের মধ্যে ঠাসাঠাসি না করে সাদা পোশাক পরা পুলিশকে পার্কিং প্যালেস কোথায় জিগ্যেস করায় সে বাঁদিকে হাত দেখিয়ে দিল। ৮টি বাইক পার্ক করে যখন মন্দিরের সামনে পৌঁছলাম, তখন রাত সাড়ে দশটা। সকালেই আবার আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব বলে লাগেজ সমেত বাইক কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়ে মন্দির দর্শনে বেরোলাম। মহারাজা রঞ্জিত সিংহের বিজয় স্তম্ভ দেখে আগে যাওয়ায় রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন রকম জামাকাপড় এবং অন্যান্য বনেদি জিনিসপত্রের দোকান। রাস্তার ডান পাশে কালো পাথরের উপর তৈরি কিছু মূর্তি যা পঞ্জাবে ঐতিহ্য বহন করছে। দোকানগুলোয় সেই মন্দিরে পুজো দেওয়ার নানা ধরনের উপকরণ আর সঙ্গে খাবার-দাবারের নানা সমহার। মন্দিরে প্রবেশের মোট চারটি গেট। এই গেটের মধ্য দিয়ে তারা বোঝাতে চেয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের জন্যই এই মন্দির। ইতিমধ্যে আমাদের মধ্যে অনেকেই রুমাল দিয়ে তাঁদের মাথা ঢেকে নিয়েছেন। এই মন্দিরে প্রবেশ করার এটাই নিয়ম। খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকের ঘরে আমাদের জুতোগুলো ওঁদের দেওয়া জুতোর ব্যাগের মধ্যে ভরে কাউন্টারে জমা দিলাম। তারপর আমরা একে-একে গুরুদোয়ারায় প্রবেশ করলাম।

১৫০২ খ্রিস্টাব্দে শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক একটি মন্দির গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখান। সেই সময় তিনি এই জলাশয়ের নাম রাখেন অমৃতসায়র। তা থেকেই শহরের নাম হয় অমৃতসর। তাঁর স্বপ্ন বাস্তব করেন ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিং। এখানে দেখতে পাবেন একটি প্রাচীন গাছ, যাকে বলা হয় ‘দুখ ভঞ্জনি বেরি’। রাত বারোটার সময় মূল মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। তার কারণ গুরু নিদ্রায় যান। আবার ভোর চারটের সময় এই প্রধান মন্দিরের দরজা খোলে। সে এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্য। স্বর্ণ মন্দিরের প্রতিচ্ছবি জলে প্রতিফলিত হয়ে এক অদ্ভুত শোভা ধারণ করে। আর এখানে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার মানুষের খাবারের আয়োজন করা হয় লঙ্গরখানায়। মন্দির দর্শনের পর আমরা একটি ফাঁকা জায়গায় উপস্থিত হলাম। তখন প্রায় রাত একটা। দর্শনার্থীর ভিড় কখনও দেখার মতো। কেউ-কেউ এখানে মন্দির প্রাঙ্গণে শুয়ে আছে। আবার কেউ দর্শনের জন্য অপেক্ষা করছে। পরে ঠিক হল আমরা ছ’জন একটা রুম নিয়ে এই রাত্রিটা বিশ্রাম নেব। আর চারজন মন্দিরের সেই চাতালেই শুয়ে থাকবে।

সেরকম ঘুম হল না। মোটামুটি হাত-পা ছড়িয়ে একটু শুয়ে থাকাই হল। কারণ সকাল হলেই পরবর্তী দিনের যাত্রা শুরু হবে। তাই সকালেই যাবতীয় কাজকর্ম সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম জালিয়ানওয়ালাবাগের উদ্দেশ্যে। ছবি তোলা হল এবং হাতে সময় কম থাকায় ভিতরটা তাড়াতাড়ি ঘুরে দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। গেটের সোজাসুজি একটি গলি। সেই সরু লম্বা গলি দিয়ে হাঁটতেই সামনে দেখি ইতিহাসের সেই নৃশংস মর্মান্তিক ঘটনা, যা আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠল। ইতিহাসের বইয়ে পড়ার সময় এরকম মনে হয়নি। তাই আবারও মনে পড়ে গেল জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে পরাধীন ভারতের স্বাধীনচেতা নিরস্ত্র মানুষগুলির রক্তাক্ত দেহ। ইতিহাসে এর থেকে বড় মর্মান্তিক ঘটনা আর হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। ঢুকেই ঠিক ডান দিকে সেই বিপ্লবী মানুষের স্মরণে জ্বলছে মশাল। আধুনিকতার টানে এবং ঘন সবুজ ঘাসের গালিচায় চাপা পড়ে গিয়েছে হাজার-হাজার মানুষের রক্তের কালশিটে দাগ। আমরা একে-একে সবাই ঘুরে দেখলাম, আর সেই কুঁয়োতে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপ দিয়েছিল…. আজ সেখানে মানুষ টাকাপয়সা কেন ছুড়ছে, তা জা নিনা। আর সেই দেওয়ালের একটি বিশেষ জায়গায় এখনও দেখা যাচ্ছে গুলির দাগ। ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। আর দেরি না করে সাইকেলরিক্সার যানজট ফেলে এগিয়ে চললাম বড় রাস্তার উদ্দেশ্যে। অমৃতসর শহরকে পিছনে ফেলে আমরাই এগিয়ে চললাম। কিছু পরে একটি মোটরসাইকেল সার্ভিসের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার কারণ অনেকের মোবিল ড্রেন করার সময় হয়ে এসেছে। যদি সেমি সিনথেটিক ইঞ্জিন অয়েল হয়, তাহলে দু’হাজার কিলোমিটার। ফুল সিন্থেটিক ইঞ্জিন অয়েল হলে চার হাজার কিলোমিটার। আর প্রতিদিনের শুরুতে বাইকে কতটা ইঞ্জিন অয়েল আছে, তা চেক করা খুবই দরকার> কম হলে টপআপ করে নেওয়া আবশ্যক।

যতই হাইওয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই বড় গাড়ির ধুলোয় নাজেহাল হয়ে পড়ছি। তার সঙ্গে সকালের খাবার না খাওয়ার জন্য আরও বেশি অসুবিধা হচ্ছিল, যদিও আমরা প্রতিদিন সকালে ছাতুর জল খেয়ে যাত্রা শুরু করি। ছাতুর জল খাওয়ারও যে অনেক কায়দা আছে, তা এই ট্রিপ না করলে বুঝতেই পারতাম না। কিছুদূর যেতেই সামনে দেখি, এক ভান্ডারায় শরবত, সুজির হালুয়া বিতরণ করা হচ্ছে। তাই আর লোভ সামলাতে না পেরে পেট ভরে সুজির হালুয়া খেয়ে নিলাম। হালুয়াটা সত্যিই খুব ভাল হয়েছিল। কাজু, কিসমিস, ঘি ইত্যাদি দিয়ে সে এক এলাহি ব্যাপার। গুরদাসপুর পর্যন্ত একটানা অনেকটা ফাঁকা রাস্তা। দু’পাশে আখের ক্ষেত এবং বিস্তীর্ণ ভুট্টা জমি। যত সময় যাচ্ছে, ততই রোদের তেজ বাড়ছে। কিন্তু এখানে লু-এর প্রভাব বেশ কম। রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট পেট্রোল পাম্পের ছাওয়ায় একটু দাঁড়িয়ে আমরা ব্রেড-জ্যাম-কলা এসব দিয়েই লাঞ্চটা সেরে ফেললাম। বাইক চালানো বা যে কোনও ড্রাইভিংয়ের সময় ভারি খাবার খাওয়া যায় না। তার কারণ শরীরের এক ধরনের ক্লান্তি আছে এবং ঘুম পায়। প্রত্যেক শরীরেই কম-বেশি এরকম হয়ে থাকে। আবার শরীরকে ডিহাইড্রেট করাও যাবে না। তাই বারবার জল বা ফ্লুইড মেশানো খাবার খেয়ে এবং কম-কম খাবার খেয়ে চলাই ভাল। আমরা কিন্তু থেমে নেই। লাদাখ উন্মাদনা আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে সব ক্লান্তিকে পিছনে ফেলে। বাইকের সামনে লাগানো চার্জার কাম মোবাইল হোল্ডারে ম্যাপে দেখে বুঝলাম, আর কিছুটা গেলেই জম্মু-কাশ্মীরের নাগাল পেয়ে যাব।
….. হঠাৎ এক ভয়ংকর শব্দে আমাদের বাইকের গতি কমে শূন্যে নেমে এল।

Next Article