এক, দু’-মাস কোথাও ঘুরতে না গেলে মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায়। তাই অনেকদিন ধরে মন খারাপ নিয়ে, আজকে যখন সকাল হল খবরের কাগজে চোখ বোলাতেই একটি খবর চোখে পড়ল। তাতে লেখা ‘দার্জিলিংয়ের বেশ কিছু অংশে তুষারপাতের ফলে উপরে আটকে থাকা পর্যটকদের নীচে নামানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’ সঙ্গে সঙ্গেই মনের মধ্যে একটা হিসাব কষা শুরু হল। জানুয়ারি মাস প্রায় শেষ, সাগরের নিম্নচাপের কোনও সম্ভাবনা নেই, তার মানে এটি তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নামার ফলেই হয়েছে। আর এই তুষারপাত দুই-একদিনেই কমে যাবে। তারপর দেখা যাবে এই প্রকৃতির সেই অপরূপ দৃশ্য। তাছাড়াও মাত্র ৬০০ কিলোমিটার দূরে তুষারপাত হচ্ছে, আর আমি ঘরে বসে থাকব… তা আবার হয় নাকি? তাই ঠিক করে ফেললাম আগামীকাল ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়ব দার্জিলিং তথা সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে। সান্দাকফুতে ছোটবেলায় যখন বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম তখন, ‘স্লিপিং বুদ্ধা’র সম্পূর্ণ রেঞ্জ দেখতে পাইনি। তখন গিয়েছিলাম ব্রিটিশের ছেড়ে যাওয়া ল্যান্ড রোভার করে। আজ যাব নিজের বাইকে। আমার দেখা ভারতবর্ষের কঠিনতম রাস্তার মধ্যে এটি সর্বপ্রথম। তাই আমার এবং আমার বাইকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল সান্দাকফু পৌঁছনো। পেলিং, সিটং, দার্জিলিংয়ের বেশ কিছু অংশ থেকে দেখেছিলাম ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই আলো-মেঘের অস্পষ্ট দৃশ্য। তাই আর দেরি না করে কাজকর্ম গুছিয়ে সন্ধেবেলায় লাগেজ প্যাক (কীভাবে জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবেন, তা বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে ‘মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়’-এর দ্বাদশ পর্বে) করে বাইকে বেঁধে নিলাম।
ভারত-নেপাল সীমান্তে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এটি। সান্দাকফু ট্রেকারদের কাছে স্বর্গ হলেও একজন বাইকারের কাছে অ্যাচিভমেন্টের শীর্ষবিন্দু। সান্দাকফু গ্রামটি এত সুন্দর হওয়ার কারণ হল, সাধারণ মেঘের স্তরের উপরে গ্রামটির অবস্থান। এখান থেকে প্রায় সারা বছরই চারটি শৃঙ্গের দর্শন করা যায়। মাউন্ট লোডসে (৮৫১৬ মিটার), মাকালু (৮৪৬৩ মিটার), মাউন্ট এভারেস্ট (৮৮৪৮ মিটার), কাঞ্চনজঙ্ঘা (৮৫৮৬ মিটার)। এর সঙ্গে আরও সম্পূর্ণ একটি পর্বতশ্রেণির সমাবেশ দেখা যায়। নীল আকাশ এবং তুষার-আচ্ছাদিত পাহাড়, নীচে ছোট-ছোট পাহাড়, সবুজের জঙ্গল এবং হিমায়িত আবহাওয়ার শীর্ষে থাকা সবুজবনের মধ্যে পাহাড়ি গাছের সঙ্গে নানা প্রজাতির অর্কিডের সমাহার… এ এক আলাদা বৈচিত্র্য ধারণ করে।
কিছু বছর আগেও মানেভঞ্জন থেকে বাইক অথবা নিজের গাড়ি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রবেশ করতে দেওয়া হত। পরে কিছু পর্যটকের অভদ্র আচরণের কারণে এই সিঙ্গালিলা অভয়ারণ্যের বেশ কিছু পশুপাখি (লাল পান্ডা) ভয়ে নেপালে চলে যায়। তারপরে বনদপ্তরের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এই পথে যেতে গেলে ল্যান্ডরোভার এবং একজন গাইডকেও সঙ্গে নিতে হবে। এইসব কারণের জন্যেই আজ বন্যপ্রাণী থেকে গাছপালা ধ্বংসের মুখে। তাই সবাইকেই আমি বারবার করে বলি কোনও একটি নতুন জায়গায় গেলে নিজের অস্তিত্ব না জানিয়ে বরং সেই জায়গার অস্তিত্ব জানুন, দেখবেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে।
সকাল-সকাল কলকাতাকে ‘গুডবাই’ বলে এনএইচ টুয়েলভ ধরে সোজা চলে আসুন কৃষ্ণনগর, যার দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। তারপর আবার মোটামুটি ১০০ কিলোমিটার মানে, বেথুয়াডহরি-পলাশি হয়ে বহরমপুর। কলকাতা থেকে বহরমপুর পর্যন্ত প্রায় ২০০ কিলোমিটার রাস্তা। গ্রাম, বাজারঘাট, লোকালয় বেশি থাকার জন্য একটু বেশি সময় লেগে যেতে পারে। তা-ও সকালে যাত্রা শুরু করার জন্য মোটামুটি ছ’ঘণ্টা লাগবে। এখন দুপুর ১২টা। সূর্যের প্রচণ্ড তাপের ফলে বাইককে একটু বেশি সময়ের জন্য ঠাণ্ডা করা দরকার। আর নিজেকে এক লিটার ওআরএস অবশ্যই দিতে হবে। আর একটা কথা বলা দরকার, রাস্তায় কোনও রকমের অসুবিধা হলে হেল্পলাইন ছাড়া যে কোনও পেট্রোল পাম্পে সাহায্যের জন্য আসতে পারেন। জল, বাথরুম, রেস্টুরুম এবং গাড়ির সংক্রান্ত কোনও অসুবিধা হলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সাহায্য করতে তাঁরা বাধ্য।
এরপরে চলে আসুন সাগরদিঘি, রঘুনাথগঞ্জ, ধুলিয়ান হয়ে ফারাক্কা। এখানে আপনি দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ুন রায়গঞ্জের উদ্দেশ্যে। বহরমপুর থেকে রায়গঞ্জের রাস্তা খুব ভাল, বিকেল পাঁচটা নাগাদ রায়গঞ্জ থেকে ডালখোলা। কিষাণঞ্জে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিন। সন্ধের টিফিন করে ইসলামপুরে রাতে থাকার মতো হোটেল খুঁজে নিন। ৭০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে ভাল মানের ঘর পেয়ে যাবেন। এছাড়াও একার জন্য কমন রুমের ব্যবস্থাও আছে। ইসলামপুর থেকে সকাল-সকাল বেরিয়ে চলে আসুন ভারত-নেপাল সীমান্তের পশুপতিনগরে, যার দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে আপনার প্রায় তিন ঘণ্টা লেগে যাবে, কারণ মাঝে পড়বে মিরিক লেক, চারিপাশে ঝাওবাগানের জঙ্গল এবং সুন্দর পাহাড়ের উপরে আঁকাবাঁকা রাস্তা। এরপর পশুপতিনগরের কাছে বর্ডারে এন্ট্রি করে মাথাপিছু ভারতীয় মুদ্রা দেড়শো টাকা প্রতিদিনের মূল্য হিসেবে নেপাল সরকারকে দিয়ে প্রবেশ করতে হবে।
আজকের গন্তব্যস্থল হল মাইপখারি, যার দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। এই ৭০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে আপনার অনেকটা সময় লেগে যাবে হয়তো। বিকেল অথবা সন্ধে হয়ে যেতে পারে, তার কারণ একে তো পাহাড়ি রাস্তা… এছাড়াও জঙ্গল-পাহাড় এবং মাইপখারি লেকে কিছুটা সময় না কাটিয়ে যেতে পারবেন না। তাই ব্রেকফাস্ট এবং মাঝে কোথাও দাঁড়িয়ে দুপুরের খাওয়ার খেয়ে সময় নষ্ট না করাই ভাল। মাইপখারিতে অনেক হোটেল অথবা হোমস্টে আপনি পেয়ে যাবেন। তাই আগে থেকে বুকিং করার কোনও প্রয়োজন নেই। ভাল জায়গা দেখে রাতের গন্তব্যস্থান খুঁজে নিন। হোম-স্টেতে পৌঁছে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ুন, তার কারণ আগামী দিনে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার হলেও এই যাত্রাপথ সবচেয়ে কঠিন এবং দুর্গম।
সকালে উঠে হোম-স্টেতেই খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়ুন সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে। রাস্তায় কিছুদূর যাওয়ার পর আপনি দেখতে পাবেন নানা জায়গা এবং রাস্তার বেশ কিছু অংশ ধ্বসে যাওয়ার চিহ্ন। কিছু দূর যাওয়ার পরপরই গাড়ি হাঁপিয়ে উঠবে। তাই মাঝেমধ্যেই ১৫-২০ মিনিটের ব্রেক নিতে হবে। নইলে ক্লাচপ্লেট পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর সরু হয়ে আসা রাস্তার দু’পাশ বরফে সাদা হয়ে উঠবে এবং মাঝের রাস্তা একেবারেই কর্দমাক্ত মনে হবে। যেন কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। চাকার গ্রিপ প্রায়ই নেই বললেই চলে। তার সঙ্গে গাড়িও যেন বলছে আর উপরে ওঠা সম্ভব নয়। এত কিছু প্রতিকূলতার পরও আপনি যদি উপরে ওঠেন, তাহলে পাবেন শেষের পাঁচ কিলোমিটারের রাস্তা—সবচেয়ে কঠিন এবং খাড়াই।
এতকিছু প্রতিকূলতার পেরিয়ে আপনি যখন পৌঁছবেন, তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে মনে হয় শরীরে আর একটুকুও শক্তি অবশিষ্ট নেই। চারিপাশের প্রকৃতি দেখে আপনার প্রায় সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। চারিদিকে শুধু সাদা বরফে ঢাকা পাহাড় আর গাছগুলোয় মনে হয় যেন কেউ সাদা তুলো লাগিয়ে গিয়েছে। এখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সরকারি হোটেলে আছে। এছাড়া নেপালের বড়-বড় হোটেল এবং হোম-স্টে আপনার থাকার জন্য আদর্শ জায়গা। আমি সরকারি হোটেলের একটি বেড ৩০০ টাকার বিনিময়ে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেপালের হোটেলে পৌঁছে গেলাম, কিছু খাবার এবং গরম পানীয় পান করার জন্য। চারিদিকের প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া ঝড়ের মত শোঁ-শোঁ শব্দ করে প্রবাহিত হচ্ছে। নেপালের হোটেলগুলো একটু উঁচুতে এবং চারতলা হওয়ার জন্য এখান থেকে দেখার ভিউ খুবই ভাল।
হ্যাঁ, রাতে দেখেছি চাঁদের আলোয় পাহাড়ের সমস্ত রেঞ্জ। ১৮০° পরিষ্কার ভিউ। নীচে আছে ছোট-ছোট সারি-সারি পাহাড়। আর তার উপরে হালকা সাদা মেঘ যেন পাহাড়গুলোকে ঢেকে রয়েছে, আর তার উপরে ‘বুদ্ধা’র ‘ঘুমন্ত’ প্রাকৃতিক দৃশ্য। হাড়কাঁপানো ঠান্ডার সঙ্গে এই দৃশ্যের কোনওই তুলনা নেই। রাতে বেশ কয়েকবার হোটেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম এই সৌন্দর্য বারবার উপভোগ করতে। আর কিছুক্ষণ পরেই দু’টো কম্বলের মধ্যে ঢুকেও ঠান্ডায় সারারাত ঘুম হয়নি। কিছুক্ষণ পরপরই হাওয়ায় প্রচন্ড শব্দের ঘর, দরজা-জানালা আবার কেঁপে ওঠে আবার শান্ত হয়ে যায়। আবার প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে। এভাবেই ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করা সকালে।
আগামী পর্বে থাকবে ভোরের সান্দাকফু, ধত্রে, শ্রিখোলা এবং দার্জিলিংয়ের বেশ কিছু গ্রামের বাইক নিয়ে ভ্রমণকাহিনি।