সঞ্জীব নস্কর বেহালার বাসিন্দা। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার পদে কর্মরত, সারা দেশ তথা বিদেশের নতুন-নতুন জায়গা সম্পর্কে জানা, ছবি আঁকা আর বাইক রাইডিং শখ সঞ্জীবের। TV9 বাংলার ভ্রমণ বিভাগের জন্য মে মাসের প্রথম রবিবার থেকে প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বাইকার-অ্যাডভেঞ্চারিস্টদের জন্য সঞ্জীব ঝুলি থেকে বের করবেন এক-একটি সফরনামার গল্প… আজ, সেই ‘মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়’-এর দ্বিতীয় পর্ব।
লেপচাখা দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব:
প্রকৃতির সেই সুন্দর ক্যানভাসের রং যখন আস্তে-আস্তে গাঢ় কালো রঙের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, তখন মনে পড়ল আমাদের রাতের থাকার জায়গা এখনও ঠিক হয়নি। তাই আর সময় নষ্ট না-করে, সেই মাঠের এক কোণে আমাদের চারজনের ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়লাম সঠিক জায়গার সন্ধানে, যেখানে টেন্ট খাটানো যায়। ঠিক হল, একটি হোম-স্টের এক কোণায় পড়ে থাকা সবুজ ঘাসের জমির উপরেই আমরা টেন্ট খাটাব। তারপর সেই হোম-স্টের মালিকের সঙ্গে কথা বলে ঠিক হল, দৈনিক ৫০০ টাকার বিনিময়ে আমাদের থাকতে দেবে। আমরা তাতেই রাজি হয়ে জিনিসপত্র নিয়ে এসে ফোনের টর্চের আলোতে তাড়াতাড়ি দু’টো টেন্ট খাটিয়ে ফেললাম। লেপচাখাতে রিসোর্ট, হোটেল, হোম-স্টে বা টেন্ট হাউসের কোনও অভাব নেই। রিসোর্ট কিংবা হোটেলের ভাড়া আনুমানিক আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। টেন্ট হাউসের ভাড়া আপনাকে মাথাপিছু ৫০০ টাকা দৈনিক দিতে হতে পারে।
সারাদিন প্রচুর পরিশ্রমের পর সবুজ ঘাসে খোলা আকাশের নিচে শরীরটা যখন ছেড়ে দিতেই, শান্ত শীতল হাওয়ায় চোখটা বন্ধ হয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ চোখটা বন্ধ করে আবার যখন চোখ খুললাম, সেই তারায় ভরা আকাশ দেখে মনে হল এ অন্য এক পৃথিবী। মনে হচ্ছে, চোখের সামনে তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে। যেন হাত বাড়ালেই তাদের ছোঁয়া যায়। তারপর নিজেদের মধ্যে অনেকক্ষণ গল্প করে, রাত ন’টার মধ্যে ডিনার শেষ করে ফেললাম। রাতের খাবার শেষ করে যখন, চারপাশে একটু ঘুরতে বেরোলাম, তখন দেখি প্রায় প্রতিটা হোম-স্টেতে ট্যুরিস্টের দল তারা আগুন জ্বালিয়ে, চিৎকার এবং নাচ-গান করতেই ব্যস্ত। এই সুন্দর গ্রাম তথা পরিবেশ হয়ে উঠেছে একটা মাতাল বিভীষিকা। এই মাতলামিতে নেই কোনও সৃষ্টি কিংবা নতুনকে জানার আগ্রহ, আছে শুধু চিৎকার আর ধ্বংসের বিভীষিকা। চারিদিকের প্রকৃতি-পরিবেশ, গাছপালা পশুপাখি সবাই যেন চুপ করে কান বন্ধ করে আছে, আর ভাবছে কখন এর সমাপ্তি হবে। এইসব দেখে আমরা ঠিক করলাম: যাই, এবার আমাদের টেন্ট এর ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়ি।
পাখির আওয়াজে সকালে আমাদের ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণ স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে এ পাশ-ও পাশ করে অবশেষে সূর্যের হালকা আলো দেখে মনে পড়ল সূর্যোদয় দেখার কথা। আমরা চারজনে মিলে গ্রামের এক কোণে গিয়ে সূর্যোদয় উপভোগ করলাম। দেখলাম দূরে দু’টো পাহাড়ের শ্রেণি মিশে গিয়েছে একটি নদীতে, যার নাম গদাধর। সেই পাহাড়ের উপর দিয়ে সূর্য উঠছে, আর নিচের ধোঁয়াশাময় পরিবেশ ধীরে-ধীরে পরিষ্কার হয় যাচ্ছে। পাখিদের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার গ্রামের মানুষজনের দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে। আশেপাশের ছোট-ছোট দোকানের কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে—আমাদেরও সকাল শুরু হল চা আর বিস্কুটের মাধ্যমে। তারপর আমরা এ দিক-ও দিকে ঘুরে বেড়ালাম, আর নানা ধরনের ফুলের ও ফলের ছবি তুললাম। তাদের মধ্যে বেগুন, ঢেঁড়স, বাঁধাকপি, ফুলকপি, নানা ধরনের গোলাপ, ডালিয়া, নানা পাতাবাহারী গাছের নাম উল্লেখযোগ্য। তারপর আঞ্চলিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, এখানকার মানুষের দিন শুরু হয় মনেষ্ট্রিতে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে। আরও জানতে পারলাম, এখানকার ছোট-ছোট বাচ্চাদের স্কুলে পড়াশোনা আর সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের রুটিন। আর জানলাম এখানকার মানুষের খাবার-দাবার, তাদের চিন্তাভাবনা আর তাঁদের উপার্জনের পথ। ভাল দোকানে আমরা মোমো, ব্রেড ইত্যাদি খেয়ে সকালের আহার শেষ করলাম। তারপর আমরা রোভারস পয়েন্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। এই যাত্রার প্রথম দিকের কিছুটা পথ নিচের দিকে নামা, তারপর আবার অন্য পাহাড়ের উপরে একটি গ্রামের নাম রোভারস পয়েন্ট। লেপচাখার মতো এতটা জনবহুল না-হলেও এই গ্রামটা বেশ পরিষ্কার এবং সুন্দর। রাস্তাঘাট প্রায় নেই বললেই চলে। এখানকার মানুষেরা নিজেদের চলার মতো করে রাস্তাঘাট তৈরি করেছে। কাঁচা মাটি কিংবা পাথরের রাস্তা। এই পয়েন্টে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার আমরা ফিরে এলাম লেপচাখায়। এইভাবে সম্পূর্ণ দিনটা আমরা লেপচাখা ঘুরে-বেড়িয়েই সময় কাটালাম।
সন্ধ্যেবেলার একটা ঘটনা কথা না-বললেই নয়। ঠিক সন্ধেবেলায় একদল মানুষের আবির্ভাব হল যাদের ট্যুরিস্ট বলা যায় না। তাঁদের সঙ্গে সেরকম কোনও লাগেজ ছিল না—মুখ গামছা দিয়ে বাধা, তাদের চলাফেরা একটু অন্যরকম যেন এই গ্রামের প্রায়ই এসে থাকে, এই গ্রামের মানুষজন ওদের চেনে, প্রত্যেকের হাতে ওয়াকিটকি। আর প্রায় ৭-৮ জনের দল। রাত ১০-১১টার সময় তিন থেকে চারজন আগুন জ্বালিয়ে নাচ-গান করতে ব্যস্ত, আর কিছু মানুষ লামা বস্তির দিকে যাওয়ার রাস্তায় অন্ধকারের মধ্যে ওয়াকিটকির মাধ্যমে কথা বলছে, টর্চের আলো দিয়ে সিগনাল দিচ্ছে, আর ঘনঘন ওয়াকিটকি ফ্রিকোয়েন্সি চেঞ্জ করছে। ওয়াকিটকির আওয়াজ, কথাবার্তা ইত্যাদি শুনে মনে হল কোনও চোরাকারবারের সঙ্গে যুক্ত। যাই হোক, এভাবে রাত ১-২টো অবধি তাদের কথাবার্তা চলে। এসবের পর আমরা আমাদের টেন্টে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন আমরা ব্যাগপত্র টেন্ট সবকিছু বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থান মহাকাল বাবার দর্শন করে জয়ন্তী হয়ে, আবার সান্তালাবাড়ি। আমাদের চারজনের টিমে গাইড না-থাকার জন্য প্রথমে আমরা জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলি। আগের দিন আঞ্চলিক মানুষদের জিজ্ঞাসা করে মোটামুটি একটা ধারণা করেছিলাম। তাঁরা বলেছিলেন, এই রাস্তায় অনেক আঞ্চলিক লোক যাতায়াত করে। কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু আমরা পথ ভুল করে লামা বস্তি পেরিয়ে পাহাড়ের গা দিয়ে যে রাস্তা নদীর দিকে নেমে যাচ্ছে, সেই রাস্তায় না-গিয়ে সোজা জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করি। তার ফলেই হয় বিপত্তি। জঙ্গলের মধ্যে এক-একটি জায়গায় এক-এক ধরনের বুনো গন্ধের কারণে খুবই ভয় পেয়ে যাই। তাই ঠিক করি আগে না-গিয়ে আমাদের পিছনের দিকে যাওয়াই উচিত। পরে সেই লামা বস্তির কাছে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকি। এখানে বলা দরকার লামা বস্তিতে আগে মানুষজন বসবাস করত। পরে এখানকার মানুষেরা এই জঙ্গলের মধ্যে না-থেকে লেপচাখা এবং জয়ন্তী নদীর পাশেই বসত করেছে। এই অঞ্চলে প্রায়ই নানা ধরনের হিংস্র জন্তুর আক্রমণ হত বলেই এমন সিদ্ধান্ত। আজও তাদের ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখা যায়। পরে এই লামা বস্তির কাছে একটি মানুষকে দেখে মহাকালের রাস্তার কথা বুঝে নিয়ে সেই পথেই অগ্রসর হলাম।
পরে আমরা পাহাড় থেকে নিচে নেমে গলাধর নদীতে এসে পড়লাম। নদীর ডান পাশ দিয়ে নদী বরাবর সোজা চলে গেলে মহাকাল মন্দিরের কাছে পৌঁছে যাব। এখান থেকে মহাকাল মন্দির এর দূরত্ব অনেকটাই। রাস্তায় শুধু ছোট-বড় নুড়ি পাথর আর দু’পাশে পাহাড় আর জঙ্গল মাঝে গলাধর নদী বয়ে যাচ্ছে তার নিজের খেয়ালে। চারপাশে সারি-সারি গাছ পাহাড় আর খোলা আকাশ সে এক অপূর্ব দৃশ্য। প্রকৃতি কোনও কিছুই সহজভাবে তৈরি করেনি, এই পৃথিবী গড়ে উঠেছে হাজার-হাজার বছরের পরিশ্রমে, আর এই প্রকৃতিকে দেখার জন্য আপনাকেও কষ্ট করতে হবে। পায়ে হেটে না-দেখলে, মানে তাকে কাছ থেকে না-দেখলে বোঝাই যায় না তার সৌন্দর্য। নদীতে কখনও এসে পড়ছে লাল রঙের জল। অর্থাৎ জলে লৌহকণিকা বেশি থাকায় শ্যাওলাগুলোর রং লাল হয়ে গেছে। কখনও আবার ছোট-বড় পশুদের থাবার দাগ, কখনও একদল পাখি চিৎকার করে আমাদের অবস্থান কাদের যেন জানিয়ে যাচ্ছে। কখনও বা নদী বলছে আমার ওপর দিয়ে তোকে যেতে হবে। মাঝে নদী এতটাই খরস্রোতা যে তার আওয়াজে কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, প্রায় একটা নাগাদ আমরা মহাকাল মন্দিরের কাছে এসে পৌঁছালাম। এতটাই ক্লান্ত এবং মুগ্ধ ছিলাম যে, বাবার আর দর্শন করা হল না। এই প্রকৃতির মধ্যেই তাকে খুঁজে পেয়েছি, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষের অবস্থান… মানুষ কত ক্ষুদ্র, কত দুর্বল।
তারপর আমরা জয়ন্তী অটোস্ট্যান্ড থেকে অটো ধরে আবার সন্তালাবারি বাড়ি চলে এলাম। বাইকে লাগেজপত্র বেঁধে, আজকের রাতটা আলিপুরদুয়ারে এক বন্ধুর বাড়িতে স্টে করলাম। পরের দিন সকালে আলিপুরদুয়ার থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলাম।