প্রীতম দে:
ত্রাণ নয়, চাই পরিত্রাণ। সাইক্লোনের থেকে, সমুদ্রের গ্রাস থেকে। বাঁধ নয়। পরিত্রাণ দিতে পারে একমাত্র ম্যানগ্রোভ। এই কথা এক ভূগোলের শিক্ষকের, যিনি সাড়ে ছয় লক্ষ ম্যানগ্রোভ বসিয়েছেন এখনও পর্যন্ত।
সুন্দরবন অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ নিয়ে ২০০৯ থেকে কাজ করে চলেছেন ‘ম্যানগ্রোভ ম্যান’ উমাশঙ্কর মণ্ডল। ২০০৯ সালের আয়লার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ম্যানগ্রোভ রোপনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ম্যানগ্রোভ লাগালে মিলছে কখনও শীতের কম্বল, কখনও পরনের শাড়ি। আবার কখনও পাওয়া যাচ্ছে স্যানিটারি ন্যাপকিন। এরকমভাবে যেনতেন প্রকারেণ মানুষকে আগ্রহী করতে মরিয়া উমাশঙ্কর। সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাঁর কথা হল: ম্যানগ্রোভই একমাত্র বাঁচাতে পারে সুন্দরবনবাসীদের।
“আন্দামানের রস আইল্যান্ড যেমন জলের তলায় চলে গিয়েছে, ঠিক সেভাবেই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ না থাকলে সমুদ্র ভূখণ্ডের আরও অনেক গভীরে প্রবেশ করে কলকাতা শহরকে শেষ করে দিতে পারে,” বলছেন উমাশংকর। তাঁর কতায়, “সুন্দরবন অত্যন্ত ডেলিকেট একটা সিস্টেম। তাকে আরও গভীর হতে দিতে হবে। ঠিক যেমন তার বায়োস্ফিয়ার, তেমনই কংক্রিটের বাঁধ ইকো-সিস্টেমের জন্য উপকারি না। সুন্দরবনকে স্পর্শ করা যাবে না। মানুষ যত কম থাকে সেখানে, মানুষের জন্য ততই ভাল। প্রকৃতিতে মানুষের বসবাস স্বাভাবিক, কংক্রিটের জঙ্গল স্বাভাবিক না। মানুষের তৈরি কোনও কিছুই প্রকৃতির জন্য উপকারি নয়, সহাবস্থান প্রয়োজন।”
সুন্দরবনের নদীর ও নদী বাঁধের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ম্যানগ্রোভ এই এলাকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল সাধারণ মানুষ ও প্রশাসন এই ম্যানগ্রোভ বাঁচানোর জন্য খুব বেশি সচেতন নয়। রাজনীতি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের অলিখিত যোগসাধনে প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ব্যাপকভাবে ধংস হয়ে চলেছে। নদী বাঁধগুলিতেও ম্যানগ্রোভ যথেষ্ট হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বাঁধের মাটি দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রশাসনের তরফে ব্যাপক প্রচার ও মানুষের সার্বিক নজরদারি এবং নিয়মিত ম্যানগ্রোভের সৃজন এই বিশাল নদী এলাকা বাঁচানোর একমাত্র পথ। কিছু এলাকায় হয়তো কংক্রিটের বাঁধ দেওয়া যায়। কিন্তু বিশাল সুন্দরবনের এত বিশাল নদী বাঁধ বাঁচানোর একমাত্র রক্ষাকবচ ম্যানগ্রোভ অরণ্য।
উমাশঙ্কর ম্যানগ্রোভ নিয়ে কয়েকটি নিদান দিচ্ছেন:
১. ম্যানগ্রোভ অরণ্য কৃত্রিমভাবে লাগানোর চেয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে লাগানো সহজ। নদীর চরকে নিরুপদ্রব রাখলে এবং নদীপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি না-করলে কয়েক বছরের মধ্যে ম্যানগ্রোভ জন্মে যায়।
২. ম্যানগ্রোভ বনসৃজন করতে গেলে চরের মাটির চরিত্র বুঝে লাগাতে হবে। কারণ সব মাটিতে সব ম্যানগ্রোভ হয় না। ম্যানগ্রোভ অরণ্য বড় হতে কয়েক বছর সময় লাগে। হঠাৎ তার থেকে সুফল পাওয়া যায় না।
৩. বুকে পলি জমে নদীগুলি মরতে বসেছে। গভীরতা বলে কিছু নেই। বাঁধ উঁচু আপাতত সমাধান, স্থায়ী সমাধান হবে না। নদী মরলে বন্যা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। বাঁধ ছাপিয়ে জল ঢুকলে কংক্রিটের বাঁধ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
৪. নদীচর এবং নদীর উপর সমস্ত রকমের দখলদারি উৎখাত না করলে আগামী দিনে আরও নদী মরবে।
৫. লোকালয়ের নদীগুলিতে ড্রেজিং করে পলি তুলে নেওয়া দরকার। চরে এই পলি জমা করলে বাঁধের সুরক্ষা হবে। নদীর গভীরতা বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।
আরও পড়ুন: জ্বালানো যাবে না আগুন, নিষিদ্ধ প্লাস্টিক, ভূস্বর্গে নয়া ভ্রমণবিধি
ম্যানগ্রোভ কী এবং তার উপকারিতা:
ম্যানগ্রোভ হল একটি ঝোপঝাড় বা ছোট গাছ যা উপকূলীয় স্যালাইন বা ব্র্যাকিশ জলে বেড়ে যায়। ম্যানগ্রোভ লবণ-সহিষ্ণু গাছ, একে হ্যালোফাইটও বলা হয় এবং কঠোর উপকূলীয় পরিস্থিতিতে জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া হয়। এগুলিতে লবণ জলের নিমজ্জন এবং তরঙ্গ ক্রিয়া মোকাবিলায় একটি জটিল লবণ পরিস্রাবণ সিস্টেম এবং জটিল মূল ব্যবস্থা থাকে (root)। জলাবদ্ধ কাদা কম অক্সিজেন অবস্থার সাথে এগুলি মানিয়ে নেয়। ম্যানগ্রোভ সুনামি, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য ঝড়ের বিরুদ্ধে বাফারকে সহায়তা করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এবং এগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলি বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক অভিযোজনের জন্য একটি ফ্ল্যাগশিপ সিস্টেম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ম্যানগ্রোভ অরণ্যগুলি অন্যান্য বনাঞ্চলের চেয়ে বেশি পরিমাণে বায়ুমণ্ডল থেকে দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয়স্থানে কার্বন ডাই অক্সাইড স্থানান্তরিত করে। নাসার নেতৃত্বাধীন একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে তারা গ্রহের সেরা কার্বন স্ক্রবারগুলির মধ্যে পরিণত হয়েছে।ম্যানগ্রোভ জলাভূমি উপকূলীয় অঞ্চলগুলিকে ক্ষয়, ঝড়ের উৎসাহ (বিশেষত হারিকেনের সময়) এবং সুনামি থেকে রক্ষা করে। ম্যানগ্রোভের বিশাল রুট সিস্টেমগুলি তরঙ্গ শক্তি অপচয় করতে কার্যকর। তেমনিভাবে, তারা জোয়ারের জলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ধীরে-ধীরে জোয়ার আসার সাথে সাথে এর পলি জমা হয়, জোয়ার-ভাঁটা পড়লে সূক্ষ্ম কণা বাদে সমস্ত ছেড়ে যায়। এইভাবে ম্যানগ্রোভগুলি নিজস্ব পরিবেশ তৈরি করে।
ম্যানগ্রোভ হল গ্রীষ্মমন্ডলীয় গাছ যা বেশিরভাগ কাঠ কখনই সহ্য করতে পারে না–লবণাক্ততা, উপকূলীয় জলে এবং জোয়ারের অন্তর্বর্তী প্রবাহ এবং প্রবাহ। প্রচুর পরিমাণে কার্বন সংরক্ষণের ক্ষমতা-সহ ম্যানগ্রোভ বনগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মূল অস্ত্র। তবে তারা বিশ্বজুড়ে হুমকির মধ্যে রয়েছে। ম্যানগ্রোভ সুরক্ষার মাধ্যমে আমরা আমাদের গ্রহের ভবিষ্যত রক্ষা করতে সহায়তা করতে পারি। ম্যানগ্রোভের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা করা এই সময়ের প্রয়োজন। গত তিন দশক ধরে ভারতের পশ্চিম উপকূলের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি এবং আবাসন কলোনিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
থাইল্যান্ডে, কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট ক্ষতিগ্রস্থ ম্যানগ্রোভগুলি পুনরুদ্ধারে কার্যকর হয়েছে। এছাড়াও, ম্যানগ্রোভ মধু উৎপাদন ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা থেকে বিরত রাখা এবং একটি স্বল্পমেয়াদী উপার্জন থেকে বিরত রাখে কাছের মানুষদের জন্য টেকসই আয়ের উপায় হিসাবে অনুশীলন করা হয়।
মাদাগাস্কারে মধুও ম্যানগ্রোভের (অ-ধ্বংসাত্মক) আয়ের উৎস হিসাবে উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া বন্য রেশম উৎপাদনের জন্য স্থানীয় রেশম পোকার প্রজাতির সিল্ক পোডগুলি মাদাগাস্কার ম্যানগ্রোভে সংগ্রহ করা হয়। বাহামাতে, উদাহরণস্বরূপ বিমিনি এবং গ্রেট গুয়ানা কে দ্বীপগুলিতে ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের সক্রিয় প্রচেষ্টা চলছে। ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতেও, স্টিল মিল এবং একটি বন্দর নির্মাণের ফলে হুমকির মুখে থাকা ম্যানগ্রোভকে রক্ষার চেষ্টা চলছে।
“আমাদের বাংলায় কি হবে না?,” মানগ্রোভের চারা লাগাতে-লাগাতে প্রশ্ন এই ভূগোলের শিক্ষকের।