বাইডেন না রবার্ট ব্রুশ! তোতলা ছেলের ‘শ্বেত প্রাসাদ’ অভিযান, ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের গল্প

সুমন মহাপাত্র |

Dec 02, 2020 | 6:59 PM

ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও এই ডেমোক্র্যাট নেতাই আমেরিকার ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট। তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিশ্বের রাষ্ট্র নায়করা। তিনি জো বাইডেন (Joe Biden)।

বাইডেন না রবার্ট ব্রুশ! তোতলা ছেলের শ্বেত প্রাসাদ অভিযান, ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের গল্প
অলঙ্করণ- অভীক দেবনাথ

Follow Us

BIO-বৃত্তান্ত: সবচেয়ে ব্যতিক্রমী মার্কিন নির্বাচন ২০২০ (US Election 2020)। এই নির্বাচন ‘ঐতিহাসিক!’ চিরাচরিত অনেক নিয়ম ভেঙেছে। বদলেছে নির্বাচনের সংজ্ঞা। উলটে পালটে গিয়েছে সব পরিসংখ্যান। ক্লাসের মেরিট লিস্টের উল্টো দিক থেকে টপার ছেলেটা রেকর্ড গড়ল। তোতলামির সমস্যা কাটিয়ে বাইডেন (Joe Biden) জনসভায় আগুন ঝরালেন। বার বার ব্যর্থ হয়েও আজ তিনি সফল। মাত্র ২৯ বছর বয়সে মার্কিন সেনেটে পা রেখেছিলেন। তারপর কেটে গিয়েছে লম্বা ৪৮ বছর। তিন বার বিফল হয়ে অবশেষে হোয়াইট হাউসের (White House) মসনদে। মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভোট তাঁর নামে। স্ক্রেন্টন থেকে যাত্রা শুরু হয়ে হোয়াইট হাউস! তাঁর দীর্ঘ চলার পথ। বারাক ওবামা (Barack Obama) তাঁর জন্য সকলকে ফোন করে ভোট চেয়েছেন, তিনি আমেরিকার ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

বেড়ে ওঠা (Early life):

পেনসিলভানিয়ার স্ক্রেন্টনে জন্মেছিলেন জো বাইডেন। বাবা জোসেফ রবিনেটে বাইডেন, মা জিন বাইডেন। স্বাচ্ছন্দেই কাটছিল জো বাইডেনের ছেলেবেলা। কিন্তু ১৯৫০ সাল নাগাদ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় স্ক্রেন্টনে। জীবিকার সন্ধানে ১০ বছরের জো-কে নিয়ে স্ক্রেন্টন থেকে ডেলাওয়্যারের ক্লেমন্টে চলে যান জো-র বাবা। সেখানে পুরনো গাড়ি বিক্রির কাজ করতেন জোসেফ রবিনেট বাইডেন। এই শহরকেই নিজের শহর বলেন জো বাইডেন।

শৈশবের বাইডেন

শিক্ষা (Education):

বাইডেনের পড়াশোনা শুরু ক্লেমন্টের আর্কমেরে অ্যাকাডেমিতে। কখনওই পুঁথিগত বিদ্যায় খুব মেধাবি ছিলেন না তিনি। তবে ছোটবেলা থেকেই নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ ছিল তাঁর। ঝোঁক ছিল খেলাধূলার প্রতিও। হাই স্কুলের ফুটবল টিমের নিয়মিত সদস্য ছিলেন জো। খেলেছেন বেসবলও। পাশপাশি ছোটবেলা থেকেই স্কুলের ক্লাস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ১৯৬৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়্যার থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক হন তিনি। সেই পরীক্ষায়ও ভাল ফল করেননি জো বাইডেন। ৬৮৮ জনের মধ্যে ৫০৬ নম্বর স্থানে পাস করেছিলেন তিনি। প্রাপ্ত গ্রেড ছিল ‘সি’। এরপর আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন জো বাইডেন। ১৯৬৮ সালে সিরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়াশোনা শেষ করেন তিনি।

তরুণ জো বাইডেন

পরিবার (Family):

সহপাঠী নেইলিয়াকে বিয়ে করার পর জো-র ৩ সন্তান হয়। ১৯৬৯ সালে প্রথম সন্তান বো বাইডেন। ১৯৭০ সালে হান্টার বাইডেন ও ১৯৭১ সালে মেয়ে অ্যামি বাইডেন (Amy Biden) জন্মায়।

রাজনীতি (Political career):

সিরিউকাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন জো বাইডেন। এই সময় রিপাবলিকান উইলিয়াম প্রিকেটের ফার্মে কাজ করেছেন তিনি। তারপর ডেমোক্র্যাট এক নেতার ফার্মে কাজ শুরু করেন। তখনই ডেমোক্র্যাট সদস্য হন জো। সে বছরই সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ তাঁর। রিপাবলিকান অধ্যুষিত নিউ ক্যাসেল কাউন্টিতে জেতেন ডেমোক্র্যাট(Democratic) নেতা জো বাইডেন।

** প্রথম সেনেটর:

এরপর মাত্র ৩০ বছর বয়সে জো পা রাখেন মার্কিন সেনেটে। ১৯৭২ সালে ডেলাওয়্যারে রিপাবলিকান নেতা ক্যালেব বগসের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ান তিনি। নির্বাচনী প্রচারের অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। তাঁর পরিবারের সদস্যরা হাতে হাতে ভোটারদের পোস্টার দিয়ে ভোট প্রচার করেছিলেন। তাঁর পরিবারের অসামান্য পরিশ্রম ও নিজের দক্ষতায় সেই নির্বাচনে বগসকে হারান জো বাইডেন। ৫০.৫ শতাংশ ভোটে মার্কিন সেনেটে পা রাখেন ডেমোক্র্যাট নেতা।

সেনেটর জো বাইডেন

এর মধ্যেই বাইডেনের জীবনে আসে গুরুতর এক মোড়। ১৯৭২ সালে ১৮ ডিসেম্বর এক গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বাইডেনের স্ত্রী নেইলিয়া ও তাঁর ১ বছরের কন্যা অ্যামি। গুরুতর জখম হয় ২ ছেলে। হান্টার (Hunter Biden) ও বোয়ের (Beau Biden) সেবা করার জন্য তখন পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন বাইডেন। কিন্তু সেনেটের ‘লিডার’ মাইক মেনসফিল্ডের কথায় তা করেননি।

১৯৭৩ সালের ৫ জানুয়ারি সেনেটর হিসাবে শপথ নেন জো। ওয়াশিংটনের (Washington) হাসপাতালে ভর্তি ছিল তাঁর দুই ছেলে বো ও হান্টার। তাদের বেডের পাশে দাঁড়িয়েই শপথ বাক্য পাঠ করেছিলেন জো বাইডেন। তিনি ছিলেন ডেলাওয়্যারের সর্ব কনিষ্ঠ ও আমেরিকার ষষ্ঠ কনিষ্ঠ সেনেটর। এরপর নিয়ম করে রোজ ডেলওয়্যারের বাড়ি থেকে ৯০ মিনিট ট্রেনে সফর করে ২ ছেলের সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে আসতেন বাইডেন। সেই অভ্যাস বদলায়নি তাঁর ৩৬ বছরের সেনেটর জীবনে। ১৯৭৫ সালে জিলের সঙ্গে পরিচয় হয় জো-র। ১৯৭৭ সালে জিলকে বিয়ে করেন জো বাইডেন। জো ও জিলের মেয়ে অ্যাসলে একজন সমাজ কর্মী।

জো বাইডেন ও জিল বাইডেন

** প্রথমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী:

সেনেটে প্রথম থেকেই সপ্রতিভ জো বাইডেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই টাইমস ম্যাগাজিনের তাঁকে ভবিষ্যতের ২০০ মুখের একজন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এরপর সেনেটের একের পর এক কমিটির সদস্য হিসাবে কাজ করেছেন জো বাইডেন। সেনেটের জুডিসিয়ারি কমিটির সদস্য ছিলেন একাধিক বার। নারকোটিক কন্ট্রোল বোর্ডের হয়েও কাজ করেছেন। ১৯৮৮ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে নামেন বাইডেন। ১৯৮৭ সালের মধ্যে জোগাড় করে ফেলেন অনেক টাকা। কিন্তু সেই সময় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ব্রিটিশ ল্যাবর পার্টির নেতা নেইল কিনকের বক্তব্য চুরির। এমনও অভিযোগ ওঠে, বাইডেন কলেজে পড়াকালীন অন্যের গবেষণা চুরি করেছেন। যদিও বাইডেন দাবি করেছিলেন, তিনি নিয়ম বুঝতে পারেননি। পরে ডেলওয়্যার সুপ্রিম কোর্ট বোর্ডও তাঁকে নির্দোষ বলে। এই সময় বাইডেনের মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার হয়। ফলে প্রেসিডেন্টের লড়াই থেকে ছিটকে যান তিনি।

** ফের মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী:

২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সেনেটের বিদেশ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন জো। ১৯৭২ থেকে ২০০৮, টানা ৩৬ বছর প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে সেনেট হয়েছেন বাইডেন। ২০০৮ সালে ফের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নাম লেখান তিনি। বিদেশ কমিটি, জুডিসিয়ারির দীর্ঘ দিনের সদস্য বাইডেনের কাছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে ছিলেন বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিন্টন (Hilary Clinton)। স্বাভাবিক ভাবেই নির্বাচনের টাকা তুলতে অক্ষম হন বাইডেন। তাঁর প্রচারের থেকে বেশি ভিড় হয় ওবামা কিংবা হিলারি ক্লিন্টনের প্রচারে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াই থেকে সরে আসেন বাইডেন।

বিদেশনীতি কিংবা সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞতা বাইডেনের তাই তাঁকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব দেন ওবামা। প্রথমে না বললেও পরে রাজি হন জো। ওবামা আমলে একা হাতে ওবামাকেয়ার (Obamacare) সামলেছেন জো বাইডেন। ওবামার মতোই প্রতিক্ষেত্রে সপ্রতিভ ছিলেন তিনিও। ২০১২ নির্বাচনে ফের বাইডেনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব দেন ওবামা। সে সময় জনপ্রিয়তার শিখরে ছিলেন না ওবামা। কিন্তু বাইডেনের সমকামী বিবাহে সম্মতির মন্তব্য-সহ একাধিক ইস্যুতে জন সমর্থন ফেরে ওবামার দিকে। ফের প্রেসিডেন্ট হন ওবামা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হন বাইডেন।

জো বাইডেন ও বারাক ওবামা

** ২০২০-তে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী:

২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে নামেননি জো। ডেমোক্র্যাট পদ প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনকে ইলেক্টোরাল ভোটে পরাজিত করেন ট্রাম্প (Donald Trump)। ভাইস প্রেসিডেন্ট হন মাইক পেন্স (Mike Pence)। সে সময় অধ্যাপনার কাজ করতেন জো। এরপর সব দিক সামলে ছক কষে ২০২০ মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন জো বাইডেন। প্রথমে ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট পদের দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন বার্নি সেন্ডার্স। কিন্তু পরে মনোনয়ন প্রত্যাহার তুলে নেন তিনি। সে সময় সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় একমাত্র জো বাইডেন।

তাই ২০২০ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী নির্বাচিত হন তিনি। নির্বাচনে ট্রাম্পকে করোনা বাণে বিধ্বস্ত করেন বাইডেন। বারবার দাবি তোলেন সমকামী বিবাহ ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের স্বার্থে। পরিবেশ নিয়ে তাঁর ভাবনা, তাঁর অর্থনীতি সবটাই প্রচারের অস্ত্র করে তোলেন জো বাইডেন। বিপুল জন সমর্থন পান তিনি। যার ফলে মার্কিন নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট তাঁর নামে। ম্যাজিক ফিগার ছুঁয়ে রিপাবলিকানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন হোয়াইট হাউসের মসনদ। ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও এই ডেমোক্র্যাট নেতাই আমেরিকার ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট। তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিশ্বের রাষ্ট্র নায়করা। তিনি জো বাইডেন।

জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস

বিতর্ক (Controversy):

এত কিছুর পরেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি বাইডেনের। তাঁর ছেলে হান্টারের সঙ্গে চিনা (China) যোগ নিয়ে একাধিক বার অভিযোগ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে যে বিতর্ক বাইডেনকে বিপাকে ফেলেছিল তা হল নারীদের সঙ্গে তাঁর কুরুচিকর ব্যবহারের অভিযোগ। তিনি নাকি যখন তখন মহিলাদের চুমু খান, তাদের অস্বাভাবিক ভাবে স্পর্শ করেন এই ধরনের একাধিক অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নেভাডার (Nevada) রাজনীতিবিদ লুসি ফ্লোরস অভিযোগ করেন লাস ভেগাসে বাইডেন তাঁর কাঁধে আস্বাভাবিক স্পর্শ করেছেন।

কয়েক দিন পর জিম হিমস নামে এক মহিলা অভিযোগ করেন বাইডেন তাঁকে অস্বাভাবিক ভাবে ধরে তাঁর শরীরে নাক ঘষেছেন, তবে তাতে নাকি যৌনতার ইঙ্গিত ছিল না। এক দিন পরে আরও ২ মহিলা একই ধরনের অভিযোগ করেন। কাইতিলিন কারুসো জানান, বাইডেন তাঁর উরুতে অস্বাভাবিক স্পর্শ করেছেন। অন্য দিকে ডিজে হিল জানান, বাইডেন তাঁর পিঠে অস্বাভাবিক স্পর্শ করেছেন। এখানেই শেষ নয়, তারা রিড নামে এক মহিলা অভিযোগ করেন, বাইডেন তাঁর ঘাড়ে সেনেট অফিসের মধ্যেই অস্বাভাবিক স্পর্শ করেছেন। বাইডেনের নামে যৌন হেনস্থারও অভিযোগ করেন রিড। তবে সে অভিযোগ ধোপে টিকতে দেননি বাইডেন। তিনি জানান, তিনি দুঃখিত যে তাঁর স্পর্শে অনেকে এমন মনে করেছেন। তবে তাঁর স্পর্শে কখনওই কোনও অভিসন্ধি ছিল না, তাই তিনি ক্ষমাপ্রার্থী নন।

আরও পড়ুন: শুধু সময়ের অপেক্ষা! বছর শেষেই হাতে মিলতে পারে ২ করোনা ভ্যাকসিন

Next Article