Durga Puja 2022: ৫ দিন নয়, ১৬ দিন ধরে চলে পুরীর মন্দিরের দুর্গাপুজো! শাক্তমতে, নবমীতে পশুবলিও হয়, জানেন কি?
Puri Jaganath Temple: জগন্নাথ মন্দিরের প্রথা অনুসারে, মেয়েদের "দুর্বল-হৃদয়" মনে করা হয়। তাই বিমলার ধ্বংসাত্মিকা রূপ মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা হয় বলে, বিমলা মন্দিরে দুর্গাপূজা মেয়েদের দেখতে দেওয়া হয় না।
পুরীর মন্দিরে (Puri Temple) দুর্গা পুজো (Durga Puja 2022)! এমন কথা অনেকেই জানেন না। পুরীর জগন্নাথ মন্দির চত্বরেই রয়েছে একটি ছোট্ট বিমলা মন্দির (Bimala Temple)। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী হিন্দুরা এই মন্দিরটিকে একটি ‘শক্তিপীঠ’ (Shakti Peetha) বলে মনে করা হয়। শাক্ত ও তান্ত্রিকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ বলা যেতে পারে। জগন্নাথ মন্দিরের চেয়ে এই মন্দিরটির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তান্ত্রিক মতে, দেবী বিমলা হলেন জগন্নাথের শক্তি ও মন্দির চত্বরের রক্ষয়িত্রী। নিয়ম মেনে ভক্তরা মূল মন্দিরের জগন্নাথকে পুজো করার আগে বিমলা মন্দিরে পুজো করেন। পুরীর মন্দিরের প্রসাদকে ‘মহাপ্রসাদ’ বলা হয়ে কেন, তার উত্তরও আজ এখানে পেয়ে যাবেন। এর কারণ হল, জগন্নাথকে যে প্রসাদ দেওয়া হ, তা দেবী বিমলাকে নিবেদন করা হয়। তারপরই সেই প্রসাদ মহাপ্রসাদে পরিণত হয়। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে মানে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে পুরীর মন্দিরেও দুর্গাপুজো পালিত হয়। জগন্নাথের আরাধনা ছাড়াও এখানে দুর্গাপুজোও প্রধান উত্সবগুলির মধ্যে পড়ে।
পুরাণ মতে, বিমলা দেবী মহিষমর্দিনী। জগন্নাথধামের সর্বময়ী কর্ত্রীও বটে। কথিত আছে, বিমলা দেবীর পুজো না করে জগন্নাথের পুজো শুরু করার নিয়ম নেই। মনে করা হয়, দেবী বিমলার অনুমতিতেই এই মন্দিরের জগন্নাথ দুই স্ত্রী লক্ষ্মী ও সরস্বতী, সুভদ্রা ও বলরামকে নিয়ে বাস করতে শুর করেন। শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসের ঐতিহ্য এখনও নিষ্ঠা ভরে পালন করা হয়। ইতিহাস বলছে, জগন্নাথ মন্দির স্থাপনের বহু যুগ আগেই দেবী বিলার মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। প্রাচীনকালে নগরের মাঝখানেই এই শক্তিপীঠের আরেকটি পীঠ নামে অবস্থিত হওয়ায় স্থানীয়রা সকলেই ভক্তিভরে পুজো করতেন। পরে রাজা স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর ওই মন্দিরকে বেষ্টন করেই তৈরি হয় জগন্নাথ মন্দির।
পুরীর মন্দিরের কোথায় অবস্থিত?
বিমলা মন্দির জগন্নাথ মন্দির চত্বরের ভিতরের অংশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এবং জগন্নাথের মিনারের পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এই মন্দিরের পাশেই পবিত্র জলাধার রোহিণীকুণ্ড অবস্থিত। মন্দিরটি পূর্বমুখী এবং বেলেপাথর ও ল্যাটেরাইটে নির্মিত। এই মন্দির “দেউল” স্থাপত্যশৈলীর একটি নিদর্শন। মন্দিরের চারটি অংশ দেখা যায়: বিমান (গর্ভগৃহ-সংবলিত অংশ), জগমোহন (সভাকক্ষ), নাট-মণ্ডপ (উৎসব কক্ষ) ও ভোগ-মণ্ডপ (ভোগ নিবেদনের কক্ষ)। ২০০৫ সালে মন্দিরটি সংস্কার হয়। বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ভুবনেশ্বর শাখা এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
প্রসঙ্গত বিমলার মূর্তি রাখা থাকে মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে নির্মিত একটি কক্ষে দেওয়ালে কোনও ছবি দেখা যায় না। বিমলার উপরের ডান হাতে রয়েছে একটি জপমালা, নিচের ডানহাতে বরদামুদ্রা, অন্যদিকে নিচের বাঁ হাতে একটি অমৃতকুম্ভ রয়েছে। প্রসঙ্গত, দুর্গার হাতে যে সব অস্ত্র দেখা যায়, তার কোনওটাই বিমলার হাতে দেখা যায় না। মূর্তির দুই পাশেই রয়েছে দুই সখী, ছায়া ও মায়া। উল্লেখ্যে, বিমলার মূর্তিটি লাক্ষা দিয়ে তৈরি বলে জানা যায়। জগন্নাথদেবের মন্দিরের আদলেই তৈরি হয়েছে বিমলার এই বেলেপাথরের মন্দির। বিমান, জগমোহন, নাটমণ্ডপ এবং ভোগমণ্ডপবিশিষ্ট এই মন্দির একান্নটি শক্তিপীঠের অন্যতম।
গুরুত্ব
বিমলাকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে কাত্যায়নী, দুর্গা, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী অর্থাৎ দেবী পার্বতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরের দুর্গাপূজায় তাকে একাধারে শিব ও বিষ্ণুর শক্তি মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী বা বিজয়লক্ষ্মী রূপে অঙ্কণ করা হয়েছে কোনার্ক মন্দিরের গায়ে। বিমলার মন্দিরটি ওড়িশার শাক্ত সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান মন্দির হিসেবে মনে করা হয়। প্রত্যেকটি শক্তিপীঠে মহাদেবকে ভৈরব রূপে পুজো করা হয়। প্রসঙ্গত ভৈরব হলেন শক্তিপীঠের প্রধান দেবীর স্বামী। বিষ্ণু বা কৃষ্ণের অন্যতম রূপ জগন্নাথকে বিমলার ভৈরব বলে মনে করা হয়। শাক্তমতে, বিমলা হলেন পুরীর বা পুরুষোত্তম শক্তিপীঠের প্রধান দেবী। পুরীর মন্দিরের একেশ্বরবাদী ধারণায় বিশ্বাসী। তাই বিষ্ণু ওশিবকে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। একইভাবে শিবের পত্নী বিমলা ও বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী এখানে এক। পুরান মতে দেবী পার্বতীর আদেশে বিষ্ণু ও লক্ষ্মী ,বলরাম ও সুভদ্রা মন্দিরে থাকেন।
শক্তিপীঠ না সিদ্ধপীঠ
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, প্রজাপতি দক্ষের কন্যা সতী পিতার আপত্তি সত্ত্বেও শিবকে বিবাহ করেছিলেন। পরে দক্ষ এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেন। সেই যজ্ঞে দক্ষ শিব ও সতীকে আমন্ত্রণ জানাননি। তবুও সতী যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। দক্ষ সতীকে উপেক্ষা করেন এবং শিবের নিন্দা করেন। স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী যজ্ঞের আগুনে আত্মহত্যা করেন। শিব ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সতীর অর্ধদগ্ধ দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন। শিবকে শান্ত করতে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ৫১ খণ্ড করেন। এই টুকরোগুলি পৃথিবীর এক এক স্থানে পড়ে এক একটি শক্তিপীঠের জন্ম দেয়।
পুরাণে বিমলা মন্দিরকে শক্তিপীঠ বলা হয়ে থাকলেও এই পীঠকে একাধিক নামে চিহ্নিত করা হয়। কালিকা পুরাণ গ্রন্থে ভারতের চারটি দিকে তন্ত্রসাধনার যে চারটি মহাক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পশ্চিমদিকে রয়েছে উড্ডীয়নদেশ অর্থাৎ আজকের ওড়িশা। এই শক্তিপীঠের দেবী কাত্যায়নী (বিমলা), ভৈরব জগন্নাথ। হেবজ্র তন্ত্র গ্রন্থে অনুরূপ একটি তালিকায় উড্র (ওড্র বা ওড়িশা) পীঠের ভৈরবী কাত্যায়নী ও ভৈরব জগন্নাথের উল্লেখ পাওয়া যায়। বেশ কয়েকটি গ্রন্থে বলা হয়েছে এই পীঠে সতীর নাভি পড়েছিল, আবার অনেকে বলেন সতীর পাদদেশ পড়েছিল এখানে। আবার সতীর উচ্চিষ্ট বা খাদ্যের অবশিষ্ট অংশ পড়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তন্ত্রগ্রন্থে বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি বলে মনে করা হয়। তান্ত্রিকদের বিশ্বাস, এখানে সাধনা করলে সিদ্ধি নামে একপ্রকার অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা যায়। দেবীভাগবত পুরাণ, প্রাণতোষিণী তন্ত্র ও বৃহন্নীলতন্ত্র বিমলা মন্দিরকে ১০৮ পীঠের অন্যতম বলে উল্লেখ করেছে। মৎস্য পুরাণ গ্রন্থে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলাকে পীঠশক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বামন পুরাণ মতে, এটি একটি পবিত্র তীর্থ। মহাপীঠ নিরুপণ গ্রন্থেও বিমলা ও জগন্নাথকে পীঠদেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেবীর ১০৮টি পৌরাণিক নামের তালিকা নামাষ্টোত্তরশত গ্রন্থেও পুরুষোত্তমের বিমলার নাম পাওয়া যায়। দেবী পুরাণ মতে, এই পীঠে সতীর পা পড়েছিল।
পুরীর মন্দিরে দুর্গাপুজো
পুরীর মন্দিরের বিমলা মন্দিরের প্রধান উত্সব হল দুর্গাপুজো। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের ১৬দি ধরে চলে দুর্গার আরাধনা। দুর্গাপুজোর শেষদিন মানে বিজয়াদশমীতে পুরীর গজপতি বংশের রাজা লিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পুজো করেন। জগন্নাথ মন্দিরের প্রথা অনুসারে, মেয়েদের “দুর্বল-হৃদয়” মনে করা হয়। তাই বিমলার ধ্বংসাত্মিকা রূপ মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা হয় বলে, বিমলা মন্দিরে দুর্গাপূজা মেয়েদের দেখতে দেওয়া হয় না। বিমলার “তীর্থ” বা পবিত্র জলাধার রোহিণীকুণ্ডের জল পবিত্র মনে করা হয়। তান্ত্রিকদের কাছে বিমলা মন্দিরের গুরুত্ব মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও বেশি।
ভোগ নিবেদন
সধারণত বিমলার জন্য আলাদা করে ভোগ রান্না করা হয় না। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুসারে, বিমলা জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট প্রসাদই খেয়ে থাকেন। তবে সাধারণত জগন্নাথ মন্দিরে নিবেদিত নিরামিষ ভোগই দেবীকে নিবেদন করা হয়। ভোগে নারকেল বাটা, পনির ও মাখন সহ শুকনো ভাত দেওয়া হয়। জগন্নাথের প্রসাদ বিমলাকে নিবেদন করার পরই তা মহাপ্রসাদের মর্যাদা পায়। প্রথা অনুযায়ী, পুরীর গোবর্ধন মঠের পুরীর শঙ্করাচার্য গোবর্ধন মঠ ও জগন্নাথ মন্দিরের এক পাত্র মহাপ্রসাদ ও এক থালা খিচুড়ি পান। তবে হিন্দু ধর্মে যে কোনও দেবতাকে উচ্ছিষ্ট প্রসাদ নিবেদন করা নিষিদ্ধ। ইন্যদিকে জগন্নথ মন্দিরের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। শিব একবার বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখেন, বিষ্ণুর খাবার থালা থেকে কয়েক টুকরো উচ্ছিষ্ট মাটিতে পড়েছে। শিব সেই উচ্ছিষ্ট তুলে খান। সেই সময় তার অসাবধানে দাড়িতে কিছু উচ্ছিষ্ট লেগে যায়। কৈলাশে ফেরার পর নারদ তার দাঁড়িতে বিষ্ণুর উচ্ছিষ্ট দেখে তা খেয়ে ফেলেন। শিবের পত্নী পার্বতী এতে ক্ষুণ্ণ হন। বিষ্ণুর প্রসাদে নিজের ন্যায্য অংশ না পাওয়ায় তিনি বৈকুণ্ঠে গিয়ে বিষ্ণুর কাছে নালিশ করেন। বিষ্ণু তাকে শান্ত করে বলেন, কলিযুগে তিনি বিমলা রূপে নিত্য তার উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পাবেন।
বিমলাকে যখন আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়, তখন সেই ভোগ রান্নার ব্যবস্থা আলাদা করে করা হয়। দুর্গাপূজার সময় বিমলাকে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। সেই সময় বিমলা মন্দিরে পশুবলি হয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, দুর্গাপূজার সময় বিমলা ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করেন; তাই সেই সময় তাকে শান্ত করতে আমিষ ভোগ নিবেদন করা উচিত। দুর্গাপূজার সময় খুব ভোরে গোপনে পাঁঠাবলি দেওয়া হয়। স্থানীয় মার্কণ্ড মন্দিরের পুকুর থেকে মাছ ধরে এনে তা রান্না করে তান্ত্রিক মতে বিমলাকে নিবেদন করা হয়। এই সব অনুষ্ঠান ভোরে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা খোলার আগেই সেরে ফেলা হয়। জগন্নাথের বৈষ্ণব ভক্তদের এই সময় বিমলা মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। অনুষ্ঠানের অল্প কয়েকজন দর্শকই “বিমলা পারুষ” বা বিমলার আমিষ প্রসাদ পান। বিমলা মন্দিরে পশুবলি ও আমিষ ভোগ নিবেদন নিয়ে বৈষ্ণবরা একাধিকবার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
তথ্য সৌজন্যে: উইকিপিডিয়া