দুর্গাপুজো, এই শব্দটার সঙ্গে আপামর বাঙালির মতোই আমাদেরও অনেক আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। ভাদ্র মাস পরলেই মনটা যেন কেমন পুজো পুজো বলে ওঠে। যদিও প্ল্যানিং শুরু হয় অনেক আগেই। সেই জানুয়ারী মাস থেকেই। বছরের শুরুতে ক্যালেন্ডার পেয়েই প্রথম যে জিনিসটির দিকে চোখ যায়, তা হল দুর্গাপুজো কবে পড়েছে? সেই অনুযায়ী সারা বছরের ছুটির প্ল্যানিং করা। আসলে কর্ম সূত্রে সারা বছর যে যেখানেই থাকুক না কেন, বছরের এই পাঁচটা দিন কলকাতায় না থাকলেই নয়। আরও ভালভাবে বললে বাড়ির পুজোয় না থাকলেই নয়।
আমাদের বাড়ি, মানে সবার কাছে যা পরিচিত ‘শোভাবাজার রাজবাড়ি’ নামে। রাজা নবকৃষ্ণ দেব। জীবন শুরু করেছিলেন বণিক হিসাবে। ব্যবসার সূত্রে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ইংরেজদের সঙ্গেও। এক সময় ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন। সেখান থেকে ক্রমেই রাজা হয়ে ওঠা। রাজা নবকৃষ্ণ দেব প্রতিষ্ঠা করন শোভাবাজারের রাজ পরিবারের। শোভাবাজারের শোভারাম দাসের বাড়ি কিনে সেখানে শুরু করলেন স্থায়ী বসতি। অবশ্য বাড়ি বললে ভুল বলা হয়। বরং বলা ভাল মহল। নাম হল ‘শোভাবাজার রাজবাটী’।
সে যুগে সমাজের প্রভাবশালীদের পরিবারদের তালিকায় যে সব পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম হল এই শোভাবাজারের দেব পরিবার। তখন ১৭৫৭ সাল। স্বাধীন ভারতের তকমা ঘুচে গিয়েছে পলাশীর প্রান্তরে। সেই বছর কলকাতার বুকে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব। কেবল পুজো তো নয়, পুজোকে কেন্দ্র করে নানা আমোদপ্রমোদের ব্যবস্থা থাকত সেই সময়ে। সেই পুজোয় আমন্ত্রিত ছিলেন খোদ লর্ড ক্লাইভ। কবিগানের লড়াই, যাত্রাপালা, নাটক, খেউর আরও কত কিছু। পুজো যে উৎসব হয়ে উঠতে পারে, প্রথম তার নিদর্শন পাওয়া গেল রাজা নবকৃষ্ণ দেবের পুজোর আয়োজন, জাঁকজমক আর উন্মাদনা দেখেই।
তবে হিন্দুদের মূর্তি পুজো নিয়ে কোনও আগ্রহ ছিল না সাহেবদের। তাই আমন্ত্রণ যখন করা হয়েছে তখন অতিথি সৎকারের জন্যও সব রকম বন্দোবস্ত রাখতেই হবে।
এদিকে চামড়ার জুতো পরে বিজাতীয় সাহেবকে ঠাকুরবাড়িতে ঢুকতে দেওয়াও যায় না। এখানে একটা বলে রাখি, ঠাকুরবাড়ি মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি নয়। ঠাকুরবাড়ি, অর্থাৎ যেখানে আমাদের কূলদেবতা গোপীনাথ-রাধারানির বাস। বাড়ির মূল অংশ, যেখানে আজও পুজো হয়, সেটাই ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত।
যাই হোক, বাড়ির বড়দের কাছে গল্প শুনেছি তাই সাহেবদের জন্য রাতারাতি বাড়ির উল্টোদিকে রাজা নবকৃষ্ণ দেব তৈরি করেছিলেন নাটমন্দির। সেই নাটমন্দির তৈরি করতে বাইরে থেকে আনা হয়েছিল দক্ষ রাজমিস্ত্রী। এমনকি তাঁর নকশা তৈরিতে ছিল অভিনবত্ব। সেই নাটমন্দিরেই পুজোর সময় রাতভর চলত আনন্দ-আয়োজন।
এতো গেল রাজা নবকৃষ্ণের আমলে পুজো শুরুর গল্প। এখন আমাদের বাড়ির দুটি পুজো। একটি বড় বাড়ি অন্যটি ছোট বাড়ির পুজো। আসলে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। তাই বিপুল সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে নিজের ভাইপো গোপীমোহন দেবকে দত্তক নেন তিনি। এই ঘটনার আট বছর পরে নিজের পুত্র সন্তান নেয়। তাঁর নাম রাখেন রাজকৃষ্ণ দেব। নিজের সন্তান জন্ম নিলে পুরনো বাড়ি বড় ছেলে বা দত্তক পুত্র রাজা গোপীমোহন দেবকে দিয়ে দেন রাজা নবকৃষ্ণ দেবকে। আর ওই বাড়ির দক্ষিণে আরও একটি সুন্দর প্রাসাদ নির্মাণ করান তিনি। যা আজ ছোট বাড়ি নামে পরিচিত। ছোট বাড়িতেও দুর্গাপুজো শুরু করেন ১৭৯০ সালে।
সেই থেকেই দুই বাড়িতে দুর্গাপুজোর চল। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের আমলেও ঠিক যেভাবে বাড়ির উমাকে আদর আপ্যায়ন করা হত আজও প্রথা মেনে সেই ভাবেই পূজিত হন দেবী। পুজোর মূল দায়িত্ব সামলান আমাদের বাবা-কাকারাই। আর তার সঙ্গে থাকি আমরাও।
বড় বাড়িতে কাঠামো পুজো করে প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয় রথের দিন। আর আমাদের বাড়িতে অর্থাৎ ছোট বাড়িতে কাঠামো পুজো হয় উল্টো রথের দিনে। সেই থেকেই যেন শুরু হয়ে যায় পুজো পুজো ভাব। আমাদের প্রতিমা তৈরী হয় বাড়িতেই। বংশ পরম্পরায় মাতৃ মূর্তি নির্মাণ করেন শিল্পীরা।
এরপর তিথি দেখে ঠাকুর দালানে তোলা হয় প্রতিমা। সেখানেই এক কোণে চলে মূর্তি নির্মাণের কাজ। এরপর চতুর্থীর দিন প্রথা মেনে বেদীতে তোলা হয় উমাকে।
এতো গেল মূর্তি নির্মাণের কথা। এর সঙ্গেই রয়েছে পুজোর প্রস্তুতি। বড়দের সঙ্গে সঙ্গে যেখানে অংশীদার আমাদের প্রজন্মও। পুজোর দিন ১৫ আগে থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতিপর্ব। বাড়ির ছেলে-মেয়েরাই ঠাকুরদালান পরিষ্কার, ঝাড়বাতি পরিষ্কার করার মতো কাজ করে। চতুর্থীতে ঠাকুর বেদীতে উঠে গেলে তারপর থাকে বাড়ির মেয়েকে সাজানোর কাজও। চালচিত্র থেকে মায়ের সাজ এই সবই কিন্তু নিজের হাতে সারি আমরা বাড়ির সদস্য-সদস্যরাই।
এখন পুজো মানেই কে কটা ঠাকুর দেখলো তার হিসাব করা। তবে আমাদের কাছে সেটা নয়। বরং পুজোর দিনগুলি বাড়িতেই নানা কাজের মধ্যে কেটে যায়। পঞ্চমীতে মাকে সাজিয়ে তোলা। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বেলবরণ, সপ্তমীর সকাল হলেই শোভাযাত্রা করে কলাবউ স্নান। অষ্টমীতে অঞ্জলি, সন্ধিপুজোর জোগাড় করা তো আছেই। কয়েক বছর আগেও আমাদের বাড়িতে প্রচলন ছিল পশুবলির। তবে ২০১৯ সাল থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই প্রথা। নবমী হলেই মনটা যেন খারাপ হয়ে আসে। এবার বিদায় জানাতে হবে উমাকে।
মন বারবার বলে ওঠে ‘নবমী নিশি যেয়ো না চলে’। তবু সময় কারও জন্য থেমে থাকে না। রাত কাটিয়ে ভোর হয়, শুরু হয় দশমী। পুজো শেষ হলে আসে কনকাঞ্জলি দিয়ে বাবা-মায়ের ঋণ চুকিয়ে কনকাঞ্জলি দিয়ে আবার শ্বশুর বাড়ি ফিরে যান উমা।
শুরু হয় বিসর্জনের তোরজোড়। ছেলেরা সাদা পাঞ্জাবি-ধুতিতে সেজে ওঠে। আর মহিলাদের পরনে থাকে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। সকলের কপালে সিঁদুরের টিপ। এক সঙ্গে শোভাযাত্রা করে ঘাটে যাওয়া। আমাদের বাড়ির ঠাকুর কাঁধে চেপে ঘাটে যায়। প্রথা অনুসারে একবার ঠাকুর কাঁধে চাপলে সোজা ঘাটে গিয়ে তারপরেই তা নামানো হবে, এমনকি তার পা আটকনো যাবে না। সেই প্রথা মেনেই আজও হয় বিসর্জন। ঘাটে পৌঁছে দুই নৌকার মধ্যিখানে বসানো হয় মাতৃমূর্তি। মাঝগঙ্গায় গিয়ে দুই নৌকো সরে যায় দুই দিকে। প্রতিমা বিসর্জন হয়। এরপর সকলে মিলে আবার শোভাযাত্রা করে যাওয়া হয় কুমারটুলির মদনমোহন মন্দিরে। সেখানে প্রণাম করে তারপরে ফিরে আসা হয় ঠাকুরবাড়িতে।
ঠাকুরবাড়িতে ফিরে প্রথমে প্রণাম জানানো হয় শূন্য বেদীতে। তারপর গোপীনাথকে প্রণাম করে তবেই শুরু হয় বিজয়ার। বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি সকলে। পুজো শেষ মানেই আবার ফিরে যাওয়া রোজকার জীবনে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে রোজের জীবনে প্রত্যাবর্তন। এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে নানা কাহিনী। অনেক ইতিহাস আর ঐতিহ্য। তাই সেই পুজোকে একই ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। তবু আজও সব প্রথা অক্ষুণ্ণ রেখেই বাপের বাড়িতে স্বাগত জানানো হয় মেয়েকে। ঐতিহ্য আর পরম্পরাকে রক্ষা করতে তাই প্রবীণদের সঙ্গেই রয়েছি আমরাও। প্রতিনিয়ত বড়দের থেকে সেই শিক্ষা নিয়েই এগিয়ে চলেছি আমরা ছোটরাও।